কাপ যুদ্ধ
ব্রাজিলের আলোকিত রাতে জার্মানি ডুবল অন্ধকারে
ব্রাজিল মাঠে আলো ছড়াবে। সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়বে। ব্রাজিলীয় ফুটবল মানে তো তাই। আর ব্রাজিল সমর্থকদের কাছে সেই ফুটবলের সঙ্গে বাড়তি আরো কিছু থাকতে হবে। যার নাম জয়। শিল্পের ছোঁয়া লাগা সৃষ্টিশীল ফুটবলও তাদের কাছে অর্থহীন। যদি তা থেকে জয় না আসে! সার্বিয়ানরা খানিকটা টের পেল ব্রাজিলিয়ান ফুটবল আসলে কী। গতি, ছোট ছোট পাস আর বুদ্ধিদীপ্ত নিখুঁত ফিনিশিং—এই তিনের যোগফলে সার্বিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত জয় পেল ব্রাজিল। এবং যে রাতে এ রকম একটা জয় পেল তারা, সেই রাতেই তাদের আক্ষেপ বেড়ে গেল কি! বাড়তেই পারে। জয়োৎসবটা তারা গলায় আওয়াজ তুলেই করেছে হয়তো। কিন্তু অস্ফুট স্বরে হয়তো আক্ষেপটা উচ্চারিত হয়েছে। ‘হায়! প্রতিশোধটা তাহলে এবার আর নেওয়া হলো না!’
হ্যাঁ, প্রতিশোধ। গত বিশ্বকাপে নিজেদের দেশে সেমিফাইনালে ব্রাজিল যে জার্মানির কাছে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল, লজ্জার সেই হারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই চার বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলেন ব্রাজিলিয়ানরা। কিন্তু রাশিয়ায় আর সেই সুযোগ পাচ্ছেন কোথায় নেইমার-কোতিনহো-পোলিনহোরা! ব্রাজিল যে রাতে সার্বিয়াকে বিধ্বস্ত করে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেল, সেই রাতেই রাশিয়ায় গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে জার্মানি। পরিসংখ্যানের পাতা ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, গত আশি বছরের কখনো বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়নি জার্মানি। এবার নিল। এটাই বোধ হয় নিয়তি ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! রাশিয়া এসে কাপ হারিয়েই লজ্জাজনক বিদায় হলো হিটলারের দেশের। জার্মানির এই বিদায়ে জার্মানদের চোখে জল। গ্যালারিতে জার্মান সমর্থকরা তাকিয়ে ছিলেন একরাশ শূন্যতা বুকে নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে! কিন্তু চ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিদায়ে ফুটবলবিশ্বে কি কোনো হাহাকার শোনা গেল; ‘হায় জার্মানি!’ বলে।
চার-চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। ফুটবলবিশ্বে কত নক্ষত্র, মহানক্ষত্র উঠে এসেছেন জার্মানি থেকে। অথচ সেই দেশটা কী রকম লজ্জাজনক বিদায় হলো রাশিয়া থেকে। জার্মানির বিদায়ে রাশিয়ার সঙ্গে ব্রাজিলের একটা জায়গায় দারুণ এক মিল খুঁজে পাওয়া গেল। ব্রাজিলে গত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন স্পেন প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল। এবার রাশিয়া থেকে বিদায় নিল জার্মানি! জার্মানি ছাড়া চলছে বিশ্বকাপ যুদ্ধ। ভাবা যায় কি! হয়তো যাচ্ছে। কারণ, চার-চারবারের আরেক চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে ছাড়াই যে বিশ্বকাপ শুরু হয়েছিল। তাদের না থাকা নিয়ে কি তেমন কোনো হাহাকার শোনা গেছে? যায়নি। কারণ, জার্মানি বা ইতালির ফুটবল নিয়ে বাকি পৃথিবীর মানুষ সেভাবে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে না। তাদের জয় যেমন সেভাবে আন্দোলিত করে না, পরাজয়ও সেভাবে মর্মাহত করে বলে মনে হয় না। অন্তত বাংলাদেশের মানুষকে তো নয়ই।
কিন্তু কাজানে জার্মানির পরাজয়ে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের একটু আক্ষেপ হতে পারে, চার বছর বুকের ভেতর বয়ে বেড়ানো প্রতিশোধের আগুনে এবার জার্মানকে পোড়ানো গেল না। এশিয়ার আরেকটা দেশ কিন্তু ১৬ বছর পর প্রতিশোধ নিল জার্মানদের বিরুদ্ধে। ২০০২ সালে এই জার্মানির কাছেই সেমিফাইনালে হেরেছিল দক্ষিণ কোরিয়া। এবার তারা জার্মানিকে শেষ ষোলোতেই উঠতে দিল না! নিজেরাও উঠতে পারেনি। তবে এশিয়ান ফুটবলের পতাকাটা আরো একটু উঁচুতে উড়িয়ে দিল তারা। হ্যাঁ, বিশ্বচ্যাম্পিয়নদেরর হারাতে পারে এশিয়ানরা! কাজানে জার্মানির বিদায়ের করুণ সুর যেমন বাজল, তেমনি এশিয়ান ফুটবলের জয়গানও শোনা গেল। এবারের বিশ্বকাপে ৩২টি দলের মধ্যে একমাত্র জার্মানিই এসেছিল কিছু হারানোর শঙ্কা নিয়ে। কারণ, বিশ্বকাপ ছিল তাদের হাতে। সেটাই তাদের হারিয়ে গেল। ভলগা আর কাজানাকা দুটো নদী বয়ে গেছে কাজান শহরের বুক চিরে। সেই নদীর বুকে আরো কিছু পানি জমা হলো জার্মান আর কোরিয়ানদের সৌজন্যে। জার্মানদের চোখে জল ঝরেছে কাপ বিসর্জন দিয়ে যাওয়ার জন্য। সেটা তাদের বেদনার অশ্রু। আর কোরিয়ানদের চোখ থেকে যে জল গড়িয়ে পড়ল, সেটা আনন্দের! ১৬ বছর আগের সেই হারের প্রতিশোধ নিল তারা। তাদের চোখে ছিল তাই আনন্দাশ্রু। মানুষ আনন্দেও কাঁদে। যেমন কাঁদল কোরিয়ানরা। আর বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যাওয়া জার্মানদের কান্না বিশ্বজয়ের রাজমুকুটটা হারানোর জন্য। বেকেনবাওয়ার, গার্ড মুলার, লোথার ম্যাথিউস. ক্লিসমান, ক্লোজাদের দেশ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল রাজা থেকে নিঃস্ব হয়ে! ভলগা নদীতে এত জল, তবু কাজানে জার্মানরা ভুগল গোলখরায়! গোলের দুর্ভিক্ষেই জার্মানির বিদায়।
এ রকম বিদায় যদি হতো ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার মতো দলের, তাহলে আবেগের বিস্ফোরণ কি সেটা টের পাওয়া যেত এই বাংলাদেশে বসেও। সেই বিস্ফোরণের মাঝে চারপাশে খুঁজে পাওয়া যেত বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, বিপন্ন কত মানুষের মুখ। হয়তো দেখা যেত কারো চোখে জল! কেউ গুমরে কাঁদছেন। আবার কেউ কেউ চেঁচাচ্ছেন অন্য রকম আনন্দে! কারণ, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে থাকা মানে বাঙালির বিশ্বকাপে টিকে থাকা! বাকি চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ার মতো কিছু খুঁজে পায় না বাঙালি! জার্মানি কিংবা ইতালি চার-চারবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, কিন্তু বাঙালিকে তাদের ফুটবল মাদকতায় বুঁদ করে রাখতে পারেনি। নেশা ধরাতে পারেনি।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।