কাপ যুদ্ধ
বিদায় মিছিলে জার্মানির পর ফ্রান্স না আর্জেন্টিনা?
বিশ্বকাপ? তার জন্য তো জিততে হবে আর মাত্র চারটা ম্যাচ। এ রকম একটা সহজ সমীকরণের কথা জানেন বিশ্বকাপে টিকে থাকা দলগুলোর সবাই। কিন্তু সবাই কি কাপ জিততে পারবে? কাপ উঠবে একটা দলের হাতে। সেই দলটার নাম কী? টিয়া পাখি, বিড়াল থেকে গ্ল্যামার গার্ল, ফুটবল পণ্ডিত কত নামই বলছেন। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপ এই ফুটবল জ্যোতিষদের ভুল প্রমাণ করতে শুরু করেছে।
চোখের জলে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেবে বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। ভুল করেও বিশ্বকাপ শুরুর আগে কিংবা শুরুর পর কারো মুখ থেকে সেটা বের হয়নি। কিন্তু জার্মানি দেশে ফিরে গেছে। কাপটা রেখে গেছে রাশিয়ায়।
দেশে ফেরার লাইনটা এখন প্রতিদিন লম্বা হবে। কাপ জয়ের দাবিদারের সংখ্যাও কমে আসবে। বাড়বে কারো কারো কাপ জয়ের সম্ভাবনা। সর্বজনগ্রাহ্য না হলেও বিশ্বকাপ ঐতিহ্য নিয়ে একটা ‘তত্ত্ব’ আছে। কাপ তারাই জেতে, যাদের কাপ জয়ের অভ্যাস আছে! কিন্তু অনেকের আবার ঐতিহ্যের ঘটি ফুটো হয়ে গেছে অনেক আগে। যেখান থেকে আভিজাত্যের ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে বছরের পর বছর ধরে। দশকের পর দশক। কিন্তু কাপ জয়ের সম্ভাবনার কথা উঠলেই তাদের নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়! আবার কাপ জয়ের ঐতিহ্যের পতাকা গায়ে জড়ানো আছে অথচ যুগের পর যুগ সাফল্য খরায় ভুগছে এমন দলও আছে। তাদের নিয়ে আবার আবেগের বন্যা বয়ে যায়! সাফল্য খরা কী, সেটা বোঝে তারা বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার পর। তাদের সমর্থকদের বুকেও তখন খরাটা টের পাওয়া যায়। শুধু মুখে থাকে আশা। এবার হলো না, পরের বার হবে! কারো কাছে সেই ‘পরের বার’ এসেছে হয়তো দুই যুগ পর। কারো অপেক্ষা শেষ হয় না তিন দশকে। কারো শেষ হয় না পাঁচ যুগেও। আটষট্টি বছর ধরে অপেক্ষা করছে আবার বিশ্বকাপ জেতার জন্য। এমন দলও আছে রাশিয়ায় এখন শেষ ষোলোতে। তাদের নিয়ে অবশ্য খুব বেশি আশা কেউ করছে বলে মনে হয় না।
প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দল বিশ বছর পর, যারা আবার মারাকানায় ব্রাজিলকে হতাশায় ডুবিয়ে কাপ জিতেছিল, সেই উরুগুয়ে কাপ জিততে পারে, এই কথাটাই হয়তো এখন আর কেউ বিশ্বাস করতে পারেন না। বিশ্বাস হারালে তাদের দোষ দেবেন কীভাবে! আটষট্টি বছর! কতগুলো প্রজন্ম পার করেছে তারা, কিন্তু কাপ জিততে পারেনি! সে কারণে উরুগুয়েকে নিয়ে আবেগের বুদবুদ নেই। হারলে-জিতলে তাদের নিজেদের চোখেও বোধ হয় এখন আর পানি আসে না! তাদের অবস্থা হচ্ছে, পোড়া বুকে দারুণ খরা, চোখের পানি চোখে নেই!’
এই উরুগুয়ে যদি পর্তুগালের কাছে হেরে দেশে ফেরে, তাতে খুব বেশি খুব হতাশামাখা মুখ আপনি দেখবেন না আপনার চারপাশে। আর উল্টো হলে বরং অনেক বেশি আক্ষেপ আর হতাশার আগুনে পুড়তে থাকা মানুষের মুখ খুঁজে পাবেন আপনি এই বাংলাদেশে। কারণ, পর্তুগিজদের দলে একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আছেন! সুয়ারেজ-কাভানির মতো তারকা আছেন উরুগুয়ে দলে। কিন্তু তারকা আর মহাতারকার মাঝে পার্থক্য অনেক। তারকারা ম্যাচে গোল করতে পারেন। ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু মহাতারকারা একাই একটা ম্যাচের রং পাল্টে দিতে পারেন। একাই দলকে খাদের কিনার থেকে টেনে তুলতে পারেন। তবে বিশ্বকাপে এখন যদি কোনো দলের একজন ফুটবলার এককভাবে চারটা ম্যাচ বের করে দিতে পারেন, তাহলে তাঁকেও বিশেষদের তালিকায় রাখতে হবে। যেমন আছেন পাওলো রোসি, রোমারিও-জিদানরা।
তবে হ্যাঁ, কাপ জিতলেই সবাই মহান হয়ে যান না। সবাইকে গ্রেট বলা হয় না। গ্রেটনেস শুধু বিশ্বকাপ দিয়ে মাপা হবে না। মহাকাল সেভাবে মাপে না। তাহলে কাপজয়ী কত লোকই ছিলেন। আছেন। যদি তাই হতো, তাহলে গ্যারিঞ্চার মতো ফুটবলার ভাগ্য বিড়ম্বিত হতেন না। নিয়তি তাঁর ভাগ্য নিয়ে ওভাবে খেলত না। ফুটবলীয় আভিজাত্য, সামাজিক অবস্থান, আর্থিক সমৃদ্ধি সব হারিয়ে তাঁকে নিঃস্ব হয়ে জীবনের প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছাতে হতো না। নিয়তির দুষ্টচক্রে নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হতে হতো না। অথচ ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের প্রাপ্তির শুরু তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে। অতএব, মহাতারকা হতে হলে ভাগ্য লাগবে। বিশ্বকাপ জিততেও ভাগ্য দরকার পড়বে। বিশ্বকাপেও তাই চলে আসে সাহিত্যের সেই পুরোনো কথাটা। সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সব চ্যাম্পিয়নই তাই চ্যাম্পিয়ন নয়। উরুগুয়ে চ্যাম্পিয়ন। ইংল্যান্ডও চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু তাদের ঘিরে ফুটবল বিশ্বে সেই উন্মাদনা কোথায়!
আবার যাদের ঘিরে উন্মাদনা বা উচ্ছ্বাসটা একটু বেশি, তারা শুধু চ্যাম্পিয়ন নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। ফুটবলটা তাদের কাছে শুধু খেলা নয়, শিল্প। তাদের শুধু ম্যাচ জিতলেই হয় না। জিততে হয় কোটি কোটি মানুষের হৃদয়। মাঠে ফুটবলকে তারা রূপ দেয় চিত্ররূপময় কবিতায়। তাই তাদের ঘিরে আবেগটা একটু বেশি দর্শকদের। বিশেষ করে বাঙালির। বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মানে শুধু কাপ যুদ্ধ নয়। বাঙালির কাছে বাকযুদ্ধও বটে। সেই যুদ্ধটা এখনো চলছে। কিন্তু সেই আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলও খুব তাড়াতাড়ি বিদায় হয়ে যেতে পারে। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালেই আর্জেন্টিনার সামনে আরেক সাবেক চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। এই ম্যাচের পর এক সাবেক চ্যাম্পিয়নকে বিদায় নিতেই হবে। একই দিনে উরুগুয়ে যদি পর্তুগালের কাছে হারে, তাহালে বিদায় নিশ্চিত হবে আরেক সাবেক চ্যাম্পিয়নের।
জার্মানিকে দিয়ে চ্যাম্পিয়নদের বিদায় পর্ব শুরু হয়েছে রাশিয়ায়। বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা দেশে ফিরেছে। কাপ মহলার সাত কাহনের সাত চ্যাম্পিয়নের মধ্যে রাশিয়ায় এখনো আছে পাঁচ দেশ। কাপটা কি তাদের কারো হাতে উঠবে? নাকি পুতিনের দেশ উপহার দেবে নতুন কোন বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে?
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।