কাপ যুদ্ধ
মেসি-রোনালদোর বিদায়, তারপর কি নেইমার?
নক্ষত্রের পতন। চ্যাম্পিয়নদের বিদায়। এই সুরটাই বেজে চলেছে রাশিয়া বিশ্বকাপে। আর সেই সুর যে জায়গায় সবচেয়ে করুণভাবে বাজছে, তার নাম কাজান। তাতারস্তানের এই শহরে চ্যাম্পিয়নরা দেখেছেন ফুটবল মাঠ সত্যিই বড় নির্মম জায়গা। এই কাজান থেকে বিদায় নিয়েছে চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। সেখানে তার পরের ম্যাচেই বিদায় নিল আগেরবারের ফাইনালিস্ট আর্জেন্টিনা। থমাস মুলারের জার্মানি গেল নকআউট শুরুর আগে। আর মেসিরা গেল নকআউটের প্রথম ম্যাচেই, যারা কি না দু-দুবারের চ্যাম্পিয়ন। কাজান চ্যাম্পিয়নদের বিদায়স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ জানেন না, এরপর কে!
মেসির বিদায়ের রাতে বিদায় নিলেন আরেকজন। তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বিদায় নিল তাঁর পর্তুগালও। তারকা-মহাতারকাদের বিদায়ের করুণ সুর যেখানে বাজছে, সেখানেই নতুন তারকার আগমনী বার্তা শোনা যাচ্ছে। বিশ্বকাপ ছাড়াই যদি মেসি-রোনালদোর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়, তারপরও হয়তো ফুটবল গ্রেটদের তালিকা থেকে নাম দুটো ছেঁটে ফেলা খুব সহজ হবে না। মেসি-রোনালদো চিরকালীন তারকাই থাকবেন। কিন্তু বুকের ভেতর বিশ্বকাপ না পাওয়ার দুঃখটা বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। অবসরোত্তর জীবনে হয়তো বারবার স্মৃতিতিয়াশা দ্বারা আক্রান্ত হবেন তাঁরা। ফিরে তাকাবেন নিজেদের কেবিনেটে সযত্নে রাখা ট্রফিগুলোর দিকে। কিন্তু খুঁজে পাবেন না একটা ট্রফি, যার নাম বিশ্বকাপ। তখন নিজেদের এত আলো ছড়ানো জীবনটাও কি ধূসর মনে হবে!
মুলার-মেসিরা যেখানে হতাশার অন্ধকারে ডুবলেন, সেই কাজানে আলো ছড়ালেন এক ফরাসি। যাঁর নাম কিলিয়ান এমবাপে। উনিশ বছরের এক তরুণ। যিনি দেখেননি জিদানকে বিশ্বকাপ জিততে। কারণ, ফ্রান্স যখন বিশ্বকাপ জিতেছে, তখন তাঁর জন্মই হয়নি। এবার ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটা বেঁচে থাকল তাঁর সৌজন্যে। চার মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল করে মেসিদের স্বপ্ন শেষ করে দেন এমবাপে।
মেসির অস্তরাগের আভায় নতুন সূর্য হয়েই যেন উঁকি দিয়ে গেলেন কিলিয়ান এমবাপে। বিশ্বকাপে মেসিদের সরণিতে নয়, উনিশ বছরের এই ফরাসি তরুণ জায়গা করে নিলেন ‘পেলে সরণি’তে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে পেলে ছাড়া আর কোনো তারকা নকআউট পর্বে দুই গোল করতে পারেননি। মেসি তো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে এখন পর্যন্ত গোলের দেখাই পাননি! সেটাও হয়তো বিশ্বকাপের বড় এক বিস্ময়! আসলে এটাই ফুটবল। বড় নির্মম ফুটবল! এই ফুটবল প্রমাণ করে দিল মেসি ঈশ্বর নন। তিনি ভিনগ্রহ থেকে আসেননি। তিনি মর্ত্যের এক মানব। এই মেসির অসাধারণ সব গোলের পেছেন কোনো জাদু নেই। নেই কোনো ঈশ্বরের হাত কিংবা পা। আর রোনালদো? তিনি রিয়ালকে টানা দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাতে পারেন। পর্তুগালকে ইউরোপ-সেরা করতে পারেন। কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে হলে কিছুটা ভাগ্য লাগে। সেই ভাগ্য তাঁর নেই। তাঁদের নেই। হতাশার প্রতীক হয়ে ভেজা চোখে বিশ্বকাপ থেকে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হলো তাঁদের।
সমুদ্রের সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল আছে ফুটবলের। সেটা হয়তো বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে। কত বড় বড় ঢেউ এসে সমুদ্রতটে মিলিয়ে যায়! রেখে যায় নুড়ি-পাথর-ঝিনুক। আর ফুটবল কত মানুষের উজ্জ্বল জীবনকে বেদনার নীলে ভরিয়ে দিয়ে যায় গোলখরায়। ইংল্যান্ডের সাবেক তারকা ওয়েন রুনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন : ‘ফুটবল যদি জলের নিচে হাঁসফাঁস করা হয়, তাহলে গোল হলো ভেসে উঠে শ্বাস নেওয়া।’ জীবনদায়ী শ্বাস। সেই গোলই করতে পারলেন না মেসি-রোনালদো এবারে বিশ্বকাপের নকআউটে! আর এই না পারা মানে তাঁদের বিশ্বকাপ থেকে করুণ বিদায়! এভাবে মেসি-রোনালদোর একই রাতে বিদায় হবে, কী কেউ ভেবেছিলেন!
মেসি-রোনালদো চলে গেছেন। বাকি থাকলেন কে? নেইমার। রাশিয়ায় যা ঘটছে, তাতে নেইমার কাপ হাতে নিয়ে রিওতে পৌঁছালে মনে হবে ফুটবল ঈশ্বর হয়তো একেবারে চোখ বন্ধ করে নেই। কিন্তু পারবেন তো নেইমার? সেইন্ট জার্মেইতে পেনাল্টি কিক নেওয়া নিয়ে যার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন নেইমার, সেই কাভানি কিন্তু দুই গোল করে রোনালদোকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দিয়েছেন। তাঁর আরেক টিমমেট এমবাপের দুই গোলে বিদায় হলো মেসির। তাহলে নেইমারকে বিদায় করার জন্য কি অন্য কেউ অপেক্ষা করে আছেন?
মেসি-রোনালদো-নেইমার। বর্তমান বিশ্বে কে সেরা, তা বিচারের সময় প্রায় এক নিশ্বাসে উচ্চারিত তিন নাম। বিশ্বকাপ মঞ্চে এখন কিন্তু আছেন একজন। কিন্তু তিনিও কতক্ষণ! মেসি-রোনালদোরা দেশে দেশে স্বপ্ন বিক্রি করে বেড়ান। কিন্তু নিজের দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিতে পারলেন না। এই বাংলাদেশে কত মানুষের কাছে স্বপ্নের ফেরিওয়ালদের নাম মেসি-রোনালদো-নেইমার। পেটে খিদে নিয়ে ভিক্ষুকও ঘুরে বেড়ায় পিঠে মেসি অথবা নেইমার কিংবা রোনালদো লেখা জার্সি পরে! কত হকার মেসি-নেইমার লেখা জার্সি পরে ফেরি করে বেড়ান ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা! হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কত মুমূর্ষু রোগীও জানতে চান, মেসি গোল পেয়েছেন কি!
মেসি-রোনালদোরা চলে যান। কিন্তু হারিয়ে যান না। ওদের পথ ধরে নেইমার চলে গেলেও হারিয়ে যাবেন না। কারণ, নেইমার-মেসিদের দেশ থেকে ফুটবল হারাবে না। কাপ দেওয়ার সময় মাঝেমধ্যে ফুটবল ঈশ্বর চোখ বন্ধ করে রাখলেও ওদের দেশে ফুটবলার দিতে কাপর্ণ্য করেন না। যাঁরা বাঁচিয়ে রাখেন বাকি বিশ্বের ফুটবলীয় হৃদস্পন্দন।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।