নেইমার বোঝালেন আরো অনেক কিছু দেখার বাকি
পেলে + পেলে অ্যাকটিং = নেইমার। এবারের বিশ্বকাপের শুরু থেকে এ রকম একটা কথা বলার চেষ্টা হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে, খেলার চেয়ে অভিনয়টা একটু বেশি করছেন নেইমার। সোশ্যাল মিডিয়ায় তা নিয়ে আবার আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। নেইমারকে ফাউল করলেই তিনি পড়ে যাচ্ছেন। গড়াগড়ি খাচ্ছেন। এসব কিছু নাকি একটু বেশি বেশি। বাংলাদেশের একটা মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ভাষা হচ্ছে, ‘আমরা এমনই বেশি দেওয়ার বেলায়।’ ফাউল করলে নেইমারও এমনই। একটু বেশি গড়ায়। হ্যাঁ, গড়ান। কারণটা খুঁজে পাবেন ওই বিজ্ঞাপনের শেষ বাক্যটায়। অল টাইম চ্যাম্পিয়ন। নেইমার অলটাইম চ্যাম্পিয়ন কি না সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে তাঁর ব্রাজিল কাপ জিতুক বা নাই জিতুক, তিনি চ্যাম্পিয়নদের দলেই থাকবেন। সেটা নিশ্চয়ই অভিনয়ের নয়। ফুটবলে।
পেলে + পেলে অ্যাকটিং = নেইমার। এই সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। আসলে এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রোল। ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের ঘোষণা। জনমাধ্যমের গণতন্ত্রে এখন সকলেই বিশিষ্ট। সবাই তাৎক্ষণিকতার ধারাবিবরণী দিয়েই যাচ্ছেন তারকা-মহাতারকাদের নিয়ে। তাঁদের বাগাড়ম্বরে নেইমার, মেসি, রোনালদোদের কী এসে যায়। তাঁদের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা। আবার সাফল্যকে কখনো কখনো অতি বড় করে তুলে ধরা। বিশ্বকাপের সময় সেটা মহামারী কারণ ধারণ করেছে। প্রিয় দলের হারে কিংবা প্রিয় ফুটবলারের ব্যর্থতায় অনেকের জীবন মনে হচ্ছে অন্ধকারে তলিয়ে গেল। আবার কারো সাফল্যে মনে হচ্ছে অন্যদের জীবন আনন্দ আলোয় ভরে যাচ্ছে। আবার এক কারণেই বোধ হয় ফুটবল বিশ্বজনীন এক খেলা। বিশ্বকাপ মানে ফুটবল উৎসব। সেটা শুধু রাশিয়ায় হচ্ছে বলে কী মনে হয়। কিংবা এর আগে উরুগুয়ে, ব্রাজিল-ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়ায় হয়েছে তাও কী মনে হবে। না। কারণ, ওই সব দেশ শুধুই আয়োজক। বিশ্বকাপটা গোটা বিশ্বের। এ মহামিলনের এক উৎসব। এ জায়গায় ফুটবল অন্য সব খেলা থেকে আলাদা। বলা যায়, ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্বকাপের রং ছড়িয়ে যায় পৃথিবীর সব প্রান্তে। সব গোলার্ধে। সেখানে জার্মানি, আর্জেন্টিনা, স্পেন খুব তাড়াতাড়ি বিদায় নিলেও বিশ্বকাপ থেকে যায়। তার রং হারায় না। এক মাসের এই উৎসবে একটা দলই কাপ হাতে নিয়ে মহা উৎসবে মেতে ওঠে। বাকিরা আগামী দিনের নতুন স্বপ্নের জাল বুনে। এবার রাশিয়ায় অনেক চ্যাম্পিয়নের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। স্বপ্নজাল ছিঁড়ে গেছে। তাতে একটুও রং হারায়নি বিশ্বকাপের। রাশিয়ায় কে কার স্বপ্নকে গ্রাস করছে, সেটা নিয়ে খুব বেশি মাতামাতির কী আছে। আক্ষেপ-হতাশা বা উচ্ছ্বাসেরও তেমন কিছু নেই। তবুও রাশিয়া নিয়ে বিশ্বকাপের মৌসুমে কত বড় বড় শিরোনাম হচ্ছে। রাশিয়ায় অনেক নতুন কিছুর জন্ম হচ্ছে প্রতি ম্যাচে। নতুন কিছুর সাথে পরিচিত হচ্ছে ফুটবল বিশ্ব। তবু কত মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদ, হাহাকার বেরিয়ে আসছে। গেল, গেল, সব চ্যাম্পিয়ন চলে গেল। মনে হয় সব দোষ রাশিয়ার। তারা ভুলে যান, ইতিহাস আর স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপে আসে দলগুলো। কাপ হাতে নেয় শুধু একটা দল। সবাই চ্যাম্পিয়ন হয় না। অনেক চ্যাম্পিয়নকে চলে যেতে হয় বলে একটা দল চ্যাম্পিয়ন হয়। এখনো বলার সময় আসেনি সেই চ্যাম্পিয়ন দলটা কারা। বলা যাবে শুধু কাপ হাতে নেওয়ার পরই।
ফ্রান্স-উরুগুয়ে-ব্রাজিলের মতো সাবেক চ্যাম্পিয়নরা কোয়ার্টার ফাইনালে। ব্রাজিল পাঁচবারে চ্যাম্পিয়ন। তাদের ঘিরে বিশ্বজুড়ে মানুষের আবেগ-উন্মাদনা সীমাহীন। আর বিশ্বকাপ এলে ব্রাজিল আর বাংলাদেশ কে কোথায়, সেটা বোঝা বড় দায়। আসলে বিশ্বকাপ সব সীমান্ত রেখা মুছে দিয়ে যায়। আবার এই বিশ্বকাপ কত বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলে তার প্রামণ। তার কারণও ফুটবল। ফুটবলের প্রতি বাঙালির ভালোবাসার প্রমাণ নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। যদিও ফুটবল নামক খেলাটা এখন বাংলাদেশে প্রায় জাদুঘরে আশ্রয়প্রার্থী।
তারপরও বিশ্বকাপ মৌসুম এলে টের পাওয়া যায় বাঙালির ফুটবল ভালোবাসা দলের চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তাই মেসি-রোনালদো নিয়ে এতো মাতামাতি। এতো ভালোবাসা। এতো আবেগের রাতে এত উন্মদনা। কিন্তু বাঙালির ভালোবাসার আরেকটা উল্টোপিঠ আছে। সেটাই ভয়ংকর। মেসিকে সবকিছু পারতে হবে। না পারলে তিনিই কোনো ফুটবলারই না। আর পারলে তিনি মানুষ নন। ঈশ্বর। ভিন গ্রহের ফুটবলার। নেইমার প্রথম দুই ম্যাচে যতটা ফুটবল খেলছে তার মাঝে নাকি তেমন কোনো শিল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্রাজিলও নাকি শিল্প বিসর্জন দিয়েছে। শুধু কাপ জয়ের জন্য। আর নেইমার ফুটবল না খেলে শুধু নাকি অ্যাকটিং করেছেন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে। সেটা আবার সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ট্রোল করা হয়েছে। কিন্তু সেই নেইমার মেক্সিকোর বিপক্ষে নিজে দুর্দান্ত গোল করলেন। আর একটা গোল করালেন। এখন কী বলবেন?
ব্রাজিল বিশ্বকাপ না জিততে পারলেও ব্রাজিল ব্রাজিল-ই থাকবে। নেইমার নেইমার-ই থাকবেন। দেশের মাটিতে ব্রাজিল গত আসরের সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হেরেছিল। গোটা দেশ হতাশায় ডুবেছিল। আবার ডোবেনি। বরং বলা যায় গত আসরে সেমিফাইনালে ব্রাজিলের স্বপ্ন অস্ত গিয়েছিল যেখানে, সেখান থেকেই নতুন সূর্যের আলোক রশ্মি দেখতে পেয়েছে ব্রাজিল। এবারও যদি ব্রাজিল খালি হাতে দেশে ফেরে, তারপরও সেখানে সেই ধ্বংস থেকে সৃষ্টির পুনজাগরণ ঘটবে। সেটা জোর দিয়ে বলা যায। আর কাপ জিতলে ব্রাজিলে আর ফুটবল খনির সন্ধান মিলবে। কারণ, ব্রাজিলে প্রতিদিন ফুটবলের জন্ম হয়। ফুটবলারের জন্ম হয়। সেখানে প্রতিটি মানুষ ফুটবল নিয়ে বাঁচে। ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। আপনি আমি ব্রাজিল সমর্থক না হলেও মানতে হবে ব্রাজিল ফুটবলের বড় এক বিজ্ঞাপন। নেইমার সেখানে শুধুই একজন মডেল। কোন পণ্যের কোন বিজ্ঞাপন এক মডেল দিয়ে বেশি দিন বাজারজাত করা যায় না। হয় না। পেলে-গ্যারিঞ্চা-সক্রেটিস-জিকো-জুনিয়র-রোমারিও-বেবেতো-রোনারলদো-রোনালদিনহোরা চলে গেছেন। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান ফুটবল চলে যায়নি। ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেও তাদের ফুটবল থাকবে।
তবে বাঙালির ফুটবলপ্রেম কেন জানি একটু বেশি নায়ককেন্দ্রিক। তাই তাদের ফুটবলকে ভালোবাসতে একজন মেসি-নেইমার-রোনালদোর প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয়েছে পেলে-ম্যারাডোনার। তাই এদের দল বা এরা চলে গেলে বিশ্বকাপে অনেকের আর যেন কিছু দেখার থাকেন না। বিশ্বকাপ নিয়ে উল্লাস-উচ্ছ্বাস সবকিছু উবে যায়। আসলে এটাই বাঙালির মনস্তত্ব। তারা অনেক বেশি নায়ক মুখাপেক্ষী। নায়ক চলে গেলে গভীর শূন্যতায় ভোগে। অন্যদের জয়, আনন্দ, উল্লাস সবকিছু তাদের কাছে বিষাদময় মনে হয়। সেই বিষাদ দূর করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে দাওয়াই দেখা যায়, সেটাও মানসিক এক রোগের উপসর্গ।
মেসি-নেইমার-রোনালদোরা সময়ের বড় তারকা। মহাতারকা। তাদের সাফল্য-ব্যর্থতা-হাতাশা নিয়ে মজা করা যেতে পারে। কারণ, বড় মানুষদের নিয়ে মজা করা যায়। তাদের অক্ষমতাকে বিদ্রুপও করা যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিজেদের মজা করার অক্ষমতার প্রকাশ না ঘটানোই ভালো। কিন্ত দুর্ভাগ্য সেই অক্ষমতার সংস্কৃতি দারুণভাবে উদযাপন করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কখনো সেটা আবার প্রচার আর প্রকাশ হচ্ছে গণমাধ্যমে।
নেইমার-মেসিরা কিন্তু মজা করতে অক্ষম মানুষের বিদ্রুপের জবাব দেন নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে। যার নাম পারফরম্যান্স। নেইমার কিন্তু পারফর্ম করতে শুরু করেছেন। ব্রাজিলীয় ফুটবলে সৃষ্টিশীলতার পুনর্জাগরণেরও ইঙ্গিত মিলেছে মেক্সিকোর বিপক্ষে। সামারায় সাম্বা জাদুতে মন্ত্রমুগদ্ধ করে রেখেছিল মেক্সিকোকে। জাপান প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ভুলে যাবেন কীভাবে বেলজিয়ামের বিপক্ষে যে দুর্দান্ত ফুটবল খেলল এশিয়ার দলটা।
বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে ভালোবাসার প্রদীপটা উজ্জ্বল থাক। এবারে বিশ্বকাপটা রাশিয়ায় হচ্ছে। সেখানে অংশীদারিত্ব গোটা পৃথিবীর। মানুষের আবেগ-উন্মাদনায় পৃথিবীর সব সীমারেখা মুছে গেছে রাশিয়ায়। বিশ্বকাপ এমন এক জিনিস, যা নিয়ে আবেগে একাত্ম হয়ে যায় পৃথিবীর অজানা প্রান্তের অচেনা মানুষগুলোও। তবে নেইমার অভিনেতা নাকি শিল্পী ফুটবলার, সেটা আবার নিজস্ব আবেগের নিক্ততি দিয়ে মাপতে না যাওয়া ভালো। ওদের যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে বিদ্রুপ না করাই ভালো। কারণ, ওরাই তো আবার জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত কত মানুষের জীবনদায়ী শ্বাস।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।