কাপ যুদ্ধ
কাজানে চ্যাম্পিয়নদের শাপমুক্তির দায় ব্রাজিলের!
শৈল্পিক নিদর্শন নাকি ঝড়ো গতি? রাশিয়ায় জয় হবে কার? স্পেন নামক একটা ইউরোপীয় দল ছিল রাশিয়ায়। ইনিয়েস্তা নামক এক শিল্পী ফুটবলারও ছিলেন সেই দলে। কিন্তু মাঠে তাদের শিল্পকর্মের কোনো মূল্য দেননি ফুটবল দেবতা। রাশিয়া থেকে খালি হাতে বিদায় নিতে হয়েছে স্পেনকে। শিল্প সৌন্দর্য উপহার দেওয়ার জন্য ইনিয়েস্তা শুধু একটা ধন্যবাদই পাচ্ছেন। রোনালদো নামক এক পর্তুগিজ তারকার ফুটবলে গতি আর শিল্পের মিশেল । তিনিও ফিরেছেন। এবং আশাহত হয়ে। রাশিয়ায় এসেছিলেন আরো একজন। যাকে ঠিক ফুটবলার হিসেবে দেখে না বিশ্ব! কারো কাছে তিনি ফুটবল ঈশ্বর। কারো কাছে অন্য জগৎ থেকে আসা এক ফুটবল অবতার। তিনিও ফিরেছেন। এত ফুটবল শিল্পীর বিদায়ের পর রাশিয়া বিশ্বকাপে টিকে আছে একটা দল। যারা মাঠে ছবি আঁকে। ছন্দ মিলিয়ে ফুটবল নিয়ে কবিতা লেখে। তাদের মাঝে বিশ্ব খোঁজে ফুটবলের নান্দনিকতার অন্য রূপ! তাদের ঘিরে প্রত্যাশার চাপও বেশি। সেই চাপটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করছেন যিনি, তিনি আবার বেশি আলোচনায় গোলের চেয়ে মাটিতে গড়াগড়ির কারণে! সেই নেইমারের ব্রাজিল আজ বিদায় নিলে লিখে ফেলা যাবে, ফুটবলে সৌন্দর্য এখন ‘অকার্যকর’ এক শব্দ!
কাজান অ্যারেনায় অনেক চ্যাম্পিয়নের বিদায় হয়েছে চোখের জলে। কাজানকে বলা হচ্ছে চ্যাম্পিয়নদের জন্য অভিশপ্ত এক ভেন্যু! সেই কাজানেই বেলজিয়ামের মুখোমুখি হবে ব্রাজিল। কিন্তু ব্রাজিল যে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন! কাজানে চ্যাম্পিয়নদের শাপমুক্তি ঘটাতে পারবে কি ব্রাজিল? জার্মানি, আর্জেন্টিনা পারেনি। ব্রাজিল পারলে কাজানের গ্যালারিতে নীল-সবুজের ঢেউ আছড়ে পড়বে। যার খানিকটা ছিটকে আসতে পারে, এই বাংলাদেশেও।
ব্রাজিল-বেলিজিয়াম। এই দুটো দেশের লড়াইটা শুধু একটা ফুটবল ম্যাচ হিসেবে দেখবে কি বিশ্ব? নাকি এই লড়াইয়ের সীমানা দেশ ছাড়িয়ে মহাদেশের আঙিনায় ঢুকে পড়বে। একটা লাতিন আমেরিকান দল। অন্যটা ইউরোপিয়ান। যাদের ফুটবলীয় দর্শন ভিন্ন। ঘরানাটাই আলাদা। দর্শন-ঘরানা এসব বাদ দিলেও ফুটবলীয় সাফল্যে ব্রাজিল অনেক এগিয়ে থাকবে বেলজিয়ামের চেয়ে। কিন্তু ফর্ম? সেটা বিবেচনায় নিলে আপনি বেলজিয়ামকে খুব পেছনে রাখতে পারছেন না। হয়তো বলতে পারেন, যে দলটা জাপানের কাছে দুই গোল হজম করেছে, তারা ব্রাজিলের সামনে কি করবে? কিন্তু বেলজিয়াম কী করতে পারে, সেটাও তারা দেখিয়েছে ওই ম্যাচের শেষ আটত্রিশ মিনিটে! ০-২ গোলে পিছিয়ে পড়েও ৩-২ গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে বেলজিয়াম। ওরা জয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। গতি দিয়ে কাঁপিয়ে দিতে পারে। রোনালদো, কুতিনহো, পাওলিনহোদের আটকে দিতে পারে। আবার লুকাকু নামের এক ফরোয়ার্ড দুর্দান্ত শটে কাঁপিয়ে দিতে পারেন ব্রাজিলের জাল।
কিন্তু কাজান, অনেক তারকা-মহাতারকা, ফুটবল দেবতার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দিয়েছে। অনেক দেশের কাপ জয়ের স্বপ্নকে সমাহিত করেছে। সেই কাজান কার দিকে মুখ তুলে তাকাবে তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে, বিড়াল-টিয়া-পাখির দলে নাম না লেখানোই ভালো।
তবে একটা কথা খুব জোর দিয়ে লেখা যাচ্ছে, কাজানে যে দুটো দল মুখোমুখি হবে সেই ব্রাজিল বা বেলজিয়াম কিন্তু কোনো একজন ফুটবল মহাতারকাকে নিয়ে রোমান্টিসিজিমে ভুগছে না। তারা কোনো তারকার দিকে তাকিয়ে থাকবে না জয়ের জন্য। ব্রাজিল দলে সে রকম বড় তারকার নাম যদি নেইমারও হয়, তাও নয়। ব্রাজিল টিমগেমে বিশ্বাস রেখে এ পর্যন্ত উঠে এসেছে। আর তারাই গত আসরের একমাত্র সেমিফাইনালিস্ট দল, যারা রাশিয়ায় কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত টিকে আছে। বেলজিয়ামেও রোমেল লুকাকু নামের এক গোল ক্ষুধার্ত ফরোয়ার্ড আছেন, যিনি বক্সের ভেতর-বাইরে গোলের সুযোগ খুঁজে বেড়ান। তারপরও বেলজিয়ানরা আস্থা রাখবে এগারোজনের একটা দলের ওপর। যারা তাদের সমর্থকদের মনে বিশ্বাস আর আস্থার সঞ্চালন করতে পেরেছেন : ‘আমরাও পারি’!
‘আমারও পারি’ এই আওয়াজটা বেশি শোনা যাবে রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে। যেখানে লড়াইটা সাবেক দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের। যে ম্যাচের গায়েও ট্যাগ এঁটে দেওয়া হচ্ছে, ইউরোপ বনাম লাতিন লড়াইয়ের। ফরাসিরা ইউরোপিয়ান হলেও তাদের ফুটবলে কোথায় যেন একটা শিল্পের ছোঁয়া থেকে যায়। সেটা ’৯৮ সালে দেশমদের কাপ জয়ের সময় দেখিয়েছিলেন জিনেদিন জিদান নামের এক ফুটবলার। তারও আগে দেখিয়েছেন মিশেল প্লাতিনি নামের আরেকজন। সেই ফ্রান্স মুখোমুখি হচ্ছে উরুগুয়ের, যাদের ইতিহাস আছে। ঐতিহ্য আছে। ভালো একটা দলও আছে। আছেন লুইস সুয়ারেজ-কাভানির মতো দুটো গোলমেশিন। যাদের পা আর মাথা সমানভাবে সচল। এ দুই অস্ত্রের একজনকে আজ নাও পেতে পারে উরুগুয়ে। ইনজুরি কাভানিকে বসিয়ে রাখতে পারে তার সবচেয়ে অপ্রিয় জায়গা রিজার্ভ বেঞ্চে! তাহলে উরুগুয়ের ভরসা? হ্যাঁ, ওদের ভরসা তখন সত্তরোর্ধ্ব এক ভদ্রলোকের মগজাস্ত্র। তিনিও বসে থাকবেন ডাগআউটে। স্নায়ুরোগে ভুগছেন তিনি। কিন্তু তাঁর ফুটবল মস্তিষ্ক স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে অনেকের। হাতে ক্র্যাচ নিয়েই চলাফেলা করছেন উরুগুয়ের কোচ। কিন্তু ডেমবেলে, এমবাপে, গ্রিজম্যানদের গতি ঝড় কীভাবে সামলাতে হবে, সেটা বোধ হয় অজানা নয় অস্কার তাবারেজের।
মেসি-রোনালদোদের যুগের অবসান হয়ে গেছে। এবারে বিশ্বকাপ সে রকম একটা বার্তা যদি দিয়ে থাকে, তাহলে কিলিয়ান এমবাপে, হ্যারি কেনদের মতো নতুন তারকারা উঠে আসছেন আগামী দিনের মহাতারকা হয়ে ওঠার পথ ধরে, সেই বার্তাও পাওয়া গেল। ফুটবলে গতি কী জিনিস, সেটা এমবাপে দেখিয়েছেন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। বল নিয়ে ছুটেছেন তিনি ঘণ্টায় সাঁইত্রিশ মাইল বেগে। যে কারণ তাঁর ফরাসি টিমমেটদের কাছে এমবাপে এখন ‘মিস্টার থার্টি সেভেন’! ১০ নম্বর জার্সি পরা এই ফরাসি ফরোয়ার্ডকে থামানোর সামর্থ্য উরুগুয়ের ডিফেন্সের আছে কি না, তারও পরীক্ষা আজ। এখনো তাদের বলা হচ্ছে বিশ্বকাপের সবচেয়ে জমাট বাঁধা রক্ষণ। তাদের জালে বল জড়িয়েছে মাত্র একবার।
তবে ফ্রান্স-উরুগুয়ে লড়াইটাও শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই ইউরোপ বনাম লাতিন লড়াই। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের আগের শিরোনাম ‘ছয়ের বিপরীতে দুই!’ অবাক হওয়ার কিছু নেই। সত্যিই তাই। ছয়-ছয়টা ইউরোপিয়ান দলের বিপক্ষে দুটো লাতিন আমেরিকান দল টিকে আছে কোয়ার্টার ফাইনালে কাপ জয়ের দৌড়ে। আর সেই দুটো দল ব্রাজিল ও উরুগুয়ের ভাগ্যও নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে আজ। ফাইনালের আগে এরা কেউ বিদায় নিলে আগামী চার বছরের জন্য বিশ্বকাপের ঠিকানা হবে আবারও ইউরোপে। বিশ্বকাপের ঠিকানা বদল করতে পারবে কি ব্রাজিল কিংবা উরুগুয়ে? অন্য মহাদেশ থেকে কাপ জিতে আসা যায় না! এই মিথ কিন্তু ভেঙে দিয়েছে আগেই ব্রাজিল, স্পেন ও জার্মানি।
কিন্তু ব্রাজিল, উরুগুয়ে, স্পেন, জার্মানির মতো রাশিয়া থেকে আগেভাগে বিদায় নিলে ভেঙে যাওয়া সেই পুরোনো মিথ নতুনভাবে বাজতে শুরু করবে : ‘অন্য মহাদেশ থেকে বিশ্বকাপ জেতা যায় না!’
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।