কাপ যুদ্ধ
অভিশপ্ত সেই কাজান থেকে ব্রাজিলেরও বিদায়
কাজান। ভলগা আর কাজানাঙ্কা দুটো নদী যে শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে, সেখানেই একে একে স্বপ্নের সমাধি হলো জার্মানি, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন! কাজান অ্যারিনায় স্বপ্নের খাজনা মিটিয়ে দেশে ফিরতে হলো জার্মানি-আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের মতো চ্যাম্পয়িনদের! কাজান অ্যারিনা চ্যাম্পিয়নদের জন্য হয়ে থাকল অভিশপ্ত এক ভেন্যু। জার্মানি পারেনি। পারেনি আর্জেন্টিনা এবং শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলও পারল না! কাজান কাউকে বিদায় করেছে প্রথম পর্ব থেকে। কাউকে নক আউট পর্ব থেকে। কাউকে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। কাজানে ব্রাজিল যখন চ্যাম্পিয়নদের ‘শাপমুক্তি’ ঘটাতে পারল না, তখনই বিশ্বকাপ আর বিশ্বকাপ রইল না!
হ্যাঁ, বিশ্বকাপ এখন রূপ নিয়েছে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে! কথাটা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ব্রাজিলের বিদায়ের পর কাপের স্বপ্ন নিয়ে এখন যারা টিকে রয়েছে তারা সবাই ইউরোপিয়ান দল। কারণ, ব্রাজিল-ই ছিল ল্যাটিনদের শেষ প্রতিনিধি। তারাও বিদায় নিল। একই রাতে বিদায় নিয়েছে দুবারের চ্যাম্পিয়ন আরেক ল্যাটিন আমেরিকান দল উরুগুয়ে। এডিসন কাভানি আর লুইস সুয়ারেসকে ঘিরে উরুগুয়ে স্বপ্ন দেখেছিল কাপ জয়ের। কিন্তু কাভানির ইনজুরি সুয়ারেসকেও জুটিহীন করে দিয়েছিল মাঠে। ফরাসিরা সেই উরুগুয়েকে বিদায় করে দিয়ে সবার আগে চলে গেলে সেমিফাইনালে। ১২ বছর পর ফ্রান্স বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। গ্রিজম্যান-এমবাপেরা এখন দেঁশম-জিদানদের দেশকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ২০ বছর পর কাপ জয়ের। তবে ব্রাজিলের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়ে যে বেলজিয়াম উঠে এসেছে, সেমিতে তাদের মুখোমুখিই হতে হবে ফ্রান্সকে। ৩২ বছর পর বেলজিয়াম সেমিফাইনালে।
উরুগুয়ে ও ব্রাজিল একই রাতে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ায় সাবেক চ্যাম্পিয়নদের বিদায় মিছিলটা আরো লম্বা হলো। পুতিনের দেশে এখন সাবেক চ্যাম্পিয়নের মধ্যে টিকে রয়েছে এখন শুধু ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড। কিন্তু তারাও কতক্ষণ! ফাইনালের আগে এরা চলে গেলে বলতেই হবে রাশিয়া নতুন কোনো চ্যাম্পিয়নকে উপহার দিতে যাচ্ছে। তবে একটা কথা কোয়ার্টার ফাইনাল শেষ হওয়ার আগেই লিখে দেওয়া যাচ্ছে, বিশ্বকাপ ইউরোপেই থাকছে। সেই দেশটার নাম ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, সুইডেন, ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম বা রাশিয়া যাই হোক। এই টুর্নামেন্ট এখন ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের ‘নয়া সংস্করণ’হয়ে পড়েছে!
আর্জেন্টিনার পর বিদায় নিল ব্রাজিল। বাঙালির কাছে বিশ্বকাপ কী আর বিশ্বকাপ রইল! তাদের বিশ্বকাপ শেষ! একই রাতে শেষ হয়ে গেল ল্যাটিনদের বিশ্বকাপও। রাশিয়া এবার তা হলে কি নতুন কোনো ফুটবল বিপ্লবের ইঙ্গিত দিচ্ছে? বিপ্লব যাই হোক বিশ্বকাপ নিয়ে আবেগের স্রোতে ভাটার টান। তার কারণ, প্রিয় দলের পাশাপাশি প্রিয় তারকা, মহাতারকাদের বিদায়। প্রায় এক দশক ধরে ফুটবল বিশ্বে তিনটা নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছে মেসি-রোনালদো-নেইমার। তাঁদের বিদায়ে শেষ বিশ্বকাপের গ্ল্যামারও। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই এই মহাতারকাদের ঘিরে যে মহাউন্মাদনা শুরু হয়েছিল সেটা উবে গেল! এদের নিয়ে মতামাতি-উন্মাদনা কত কিছুই ছিল। তার সব কিছু থিতিয়ে গেল! বিশ্বকাপের আগে মেসির আর্জেন্টিনা ইসরাইলে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলতে যায়নি অনেক কিছু চিন্তা করে। তারপর কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল এক বিখ্যাত ছবি, মেসি আর রোনালদোর জার্সি পরে রমজানে নামাজ পড়ছে দুই শিশু সিরিয়া অথবা প্যালেস্টাইনে! এদের নিয়ে শুধু গণহিস্টিরিয়া নয়, আরো অনেক বেশি আবেগ ফুটবলপ্রেমীদের। তাঁরাই যখন বিশ্বকাপে নেই, তখন বিশ্বকাপ একটু পানসে মনে হবেই।
মেসি-রোনালদো যুগের শেষ হয়ে গেল হয়তো এই বিশ্বকাপে। এরা বিশ্বকাপ থেকে একটু আগে-ভাগে বিদায় নিয়েছেন। তারপর বাঙালির আবেগের স্রোতে বেশি আবর্তিত হচ্ছিল যাকে ঘিরে তাঁর নাম-নেইমার। কিন্তু তিনিও রইলেন না। পারলেন না তাঁর দলকে সেমিফাইনালেও নিতে! গত বারের কোনো সেমিফাইনালিস্ট থাকল না আর এবার রাশিয়ায়। ব্রাজিল আর নেইমারের বিদায়ের পর আবার নতুন আলোচনা। পাল্টে গেছে বিশ্ব ফুটবল। কোনো তারকার ওপর নির্ভর করে কাপ জেতার দিন শেষ। হোক তাঁর নাম মেসি, রোনালদো কিংবা নেইমার। সমালোচনাটা একটু বেশি নেইমারকে নিয়ে। ফাউলের শিকার হলেই তিনি মাটিতে পড়ে যেভাবে গড়াগড়ি খেয়েছেন সেটা অনেকের কাছে অতিনাটকীয়! তা নিয়ে জনমাধ্যমে ট্রল কম হয়নি। ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ অনেক হয়েছে। এবার তাকে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করা হচ্ছে অন্যভাবে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার তাঁর যোগ্যতার চেয়ে প্রচার আর গুরুত্ব একটু বেশি পেয়ে গেল!
কে বিশ্বকাপ জিতল, কে যোগত্যার চেয়ে বেশি প্রচার আর গুরুত্ব পেলেন, সেটা ভুলে যান। মসি-রোনালদো-নেইমার তো কম আনন্দ দেননি আপনাদের। মেসি-রোনালদো যুগের অবসান হলে, ফুটবল ইতিহাসের এক অতি রোমান্টিক পর্বেরও অবসান হবে। বিশ্বকাপ হয়তো আর জেতাই হলো না মেসি-রোনালদোর। কিন্তু বিশ্ববাসীর মন তো তাঁরা জিতেছেন। সেটাকে অস্বীকার করবেন কীভাবে! বিশ্বকাপ থেকে এদের চোখের জলে বিদায়। বিশ্বকাপ থেকে এদের চলে যাওয়া বিশাল এক শূন্যতা। নতুন তারকারা আগামীতে সেই শূন্যতা ভরাট করতে পারবে কি না সেটা নিয়েও সংশয়। তবে সংশয় আর সন্দেহহীন চিত্তে বলতে পারি, আপনি আমি অনেক ভাগ্যবান। একই সঙ্গে এ রকম মেসি-রোনালরদো-নেইমারদের মতো খেলা বহু বছর ধরে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। ফুটবলের মধ্যে দিয়ে উপভোগ করছি অন্য এক স্বর্গীয় সুখ! বিশ্বকাপের কাজান সেই সুখের খাজনাটা একটু বেশি নিল!
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জানালিস্ট ও কলাম লেখক।