কাপ যুদ্ধ
পিটার্সবার্গের আকাশ লাল হবে, না নীল?
‘অল ইউরোপিয়ান সেমিফাইনাল’, এই শব্দবন্ধনের মধ্যে ইউরোপিয়ান ফুটবলেরই জয়গান। বিশ্বকাপ জয়ের উন্মাদনায় এবার ঝাঁপাবে শুধুই ইউরোপিয়ানরা! বাকি পৃথিবীকে শুধু দেখতে হবে। তবে ফুটবলান্ত প্রাণ হলে আপনি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগও করতে পারবেন। কারণ, এটা তো বিশ্বকাপ। যেটা বিশ্বজয়ের মুকুট পরার মঞ্চ।
সেই মঞ্চে ওঠার দৌড়ে আপাতত চারটা দল, যারা সবাই ইউরোপিয়ান। অল ইউরোপিয়ান সেমিফাইনাল, সেটা তো আর এই প্রথম হচ্ছে না বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের শৈশবে সেই ১৯৩৪-এও ফুটবল বিশ্ব দেখেছে অল ইউরোপিয়ান সেমিফাইনাল। তারপর আরো তিনবার। গেল শতাব্দীতে তিনবার। আর এই শতাব্দীতে হতে যাচ্ছে দুবার। এই নিয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসে পঞ্চমবার সেমিফাইনালে শুধুই ইউরোপিয়ানরা।
এবার রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালেই মুখোমুখি দুই প্রতিবেশী ফ্রান্স আর বেলজিয়াম, যাদের ফুটবল দ্বৈরথটা অনেক পুরোনো। সেই ১৯০৪ সাল থেকে। কিন্তু বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে আগে কখনো মুখোমুখি হয়নি তারা। ৩২ বছর আগে মিশেল প্লাতিনির ফ্রান্স আর এনজো শিফোর বেলজিয়াম মুখোমুখি হয়েছিল তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে। যে ম্যাচটা জিতেছিল প্লাতিনির ফ্রান্স।
এরপর পেরিয়ে গেছে ৩২ বছর। পাল্টে গেছে ইউরোপ। বদলে গেছে ইউরোপিয়ান ফুটবল। প্লাতিনিদের কাপ জিততে না পারার হতাশাকে ভুলে গেছে ফরাসিরা ২০ বছর আগে নিজেদের মাঠে বিশ্বকাপ জিতে। জিদান-দেশম-অঁরিরা ফরাসি ফুটবল সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন গত শতাব্দীর শেষ বিশ্বকাপটা জিতে। তারপরও একবার ফাইনাল খেলেছে। কিন্তু এবার ফাইনাল খেলতে হলে ফরাসিদের টপকাতে হবে বেলজিয়ামদের লাল দেয়াল। যে দেয়ালের পেছনে থাকছেন আরেক ফরাসি। দেশম-জিদানদের সেই কাপজয়ী দলের আরেক বড় তারকা। থিওরি অঁরি। এখন যার পরিচয় বেলজিয়ামের সহকারী কোচ। আরো পরিষ্কার করে বললে বলতে হবে, ফরাসি দুর্গ ভাঙার ছক তৈরি হচ্ছে যার মস্তিষ্ক থেকে। অথচ তিনিও এক ফরাসি! পেশাদারিত্ব যাকে এ ম্যাচে বসিয়ে দেবে প্রতিপক্ষের ডাগআউটে!
ফ্রান্স-বেলজিয়ামের যোগাযোগটা শুধু পেশাদারিত্বের নয়। দুটো দেশের ভাষা-সংস্কৃতিও প্রায় এক। বেলজিয়ামের বড় একটা অংশের মানুষের ভাষা ফরাসি। বাকিরা ফ্লেমিশভাষী। ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশমের চিন্তা বাড়িয়ে দিতে পারেন যিনি, সেই এডেন হ্যাজার্ড জন্মসূত্রে বেলজিয়াম। কিন্তু বড় হয়েছেন ফ্রান্সে। আবার খেলেন ইংলিশ লিগে। যেখানে তাঁর বেশিরভাগ বন্ধু ফরাসি। তবে বন্ধুত্ব ভুলে আজ তাঁরা সবাই মাঠে নামবেন কাপ যুদ্ধে। এই যুদ্ধটা জিততে পারলেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার হাতছানি। প্রহর গুনছে ফরাসিরাও। ফরাসিরা নিজেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, বেলজিয়ানরা ব্রাজিলকে হারাতে পারে, কিন্তু ফ্রান্সকে পারবে না। বেলজিয়ামের এই সোনালি প্রজন্মের ফুটবলারদের গতি আছে। স্কিল আছে। জয়ের খিদেও আছে। নেই কাপ জয়ের ইতিহাস আর ঐতিহ্য। তবে এসব তো ফুটবলীয় ব্যাখ্যা। ফরাসিরা আবার দার্শনিকের মতো বলতে শুরু করেছেন, ‘বেলজিয়ানদের সব আছে। নেই শুধু ফরাসিদের সঙ্গে লড়ার দম। কারণ,ফরাসিদের আছে ভ্যালিয়ান্ট হার্ট!’
তবে বেশিরভাগ ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে লালের ছাপ! হ্যাঁ, বেলজিয়াম। আর ফুটবল পণ্ডিতদের মস্তিষ্কে নীলের জোয়ার! ফ্রান্স। আর্জেন্টিনাকে ছিটকে দিয়েছে ফ্রান্স। এ দেশের আর্জেন্টাইন সমর্থকরাও চাইছেন বেলজিয়াম জিতুক। আবার বেলজিয়াম ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে এসেছে। কাপ জিতলে ওরাই জিতুক। সেই ভাবনা উঁকি দিচ্ছে ব্রাজিল সমর্থকদের মনের কোনায়।
কিন্তু ফুটবল ফরাসিদের কাছে মুক্তিসাধনের ঠিকানা। সেই মুক্তির প্রথম স্বাদ পায় তারা ’৯৮ সালে। তারপর ফরাসি ফুটবলে সত্যিই বিপ্লব ঘটে গেছে। ফুটবল ওদের কাছে পেয়ে গেছে রূপকথার রূপ। ফুটবলের খোঁজটা সবাই রাখেন। ফুটবল তো একটা দলগত খেলা। তার মাঝেই ওরা খুঁজে বেড়ায় এক ধরনের সাম্য। ফুটবল ফরাসিদের কাছে শুধু একটা খেলা নয়। একটা দর্শন। তাই জঁ পল সার্ত্রের মতো নামী দার্শনিকের বই হাতে নিয়ে বসেও ফরাসিরা ফুটবল দেখেন। বিশ্বকাপ ফুটবল। তার আবার ব্যাখ্যাও আছে। ‘দর্শন তো মানুষের। মানুষ থেকে আলাদা হয়ে সেটা পড়বেন কীভাবে! দর্শন খেলার মাঝে। রাজনীতির মাঝে।’ হ্যাঁ, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাক্রো যাচ্ছেন রাশিয়ায়। দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি স্থগিত রেখেই রাশিয়ায় যাচ্ছেন তিনি। বিরোধীরা খোঁচা দিচ্ছেন, ‘উনি তো বড়লোকদের প্রেসিডেন্ট!’ কিন্তু পাল্টা যুক্তি সেটাও দর্শন আশ্রয়ী। প্রেসিডেন্ট যাচ্ছেন ফুটবলারদের উৎসাহ জোগাতে। বিশ্বকাপটা জিতলে ফরাসি ফুটবল আরো সমৃদ্ধ হবে।
জঁ পল সার্ত্রের ‘অস্তিত্ববাদ’-এ ফুটবল ঢুকে পড়েছে। বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেমিফাইনালটা ফরাসিদের কাছে বিশ্বকাপে টিকে থাকার অস্তিত্বের লড়াই। সেই লড়াইয়ের মাঠে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গোলাবারুদও থাকছে ফরাসিদের সঙ্গে। আর বেলজিয়ানদের সোনালি প্রজন্মের সঙ্গে থাকছে সোনালি রঙের বিশ্বকাপটা ছুঁয়ে দেখার অদম্য এক ইচ্ছা। সেন্ট পিটার্সবার্গের আকাশ আজ হৃদয় থেকে উৎসারিত আবেগের লাল আবীরে রাঙিয়ে যাবে নাকি মস্তিষ্কজাত বিপ্লবের নীল জোয়ারে ভাসবে পিটার্সবার্গের গ্যালারি থেকে রাজপথ।
আবেগ বলছে লাল। যুক্তি বলছে নীল। লাল আর নীল, জয় যারই হোক, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিদায়ে রং হারানো বাঙালির বিশ্বকাপে আজ আবার নতুন রং লাগতে পারে ফ্রান্স-বেলজিয়ামের দুর্দান্ত এক ম্যাচের সৌজন্যে।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।