কাপ যুদ্ধ
হ্যারি কেন নিভিয়ে ইংল্যান্ডকে অন্ধকারে ডুবাল ক্রোয়েশিয়া
হ্যারি কেনের আলোয় ইতিহাসের পাতা উল্টাতে শুরু করেছিল ইংলিশরা। ৫২ বছর আগে ববি মুরের ছবির পাশে হ্যারি কেনের মুখটাও আবছা আবছা দেখতে শুরু করলেন তাঁরা। তাতে অবশ্য ইংলিশদের দোষ দেওয়া যায় না। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেট পিস থেকে টিপিয়ার দুর্দান্ত গোল। ইংলিশ গ্যালারিতে উচ্ছ্বাসের ঝড়। ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। এই বিশ্বাস সঞ্চারিত হতে শুরু করে গোটা গ্যালারিতে। গোটা ইংল্যান্ডে। পঞ্চাশ বছরের বেশি আগে ইংল্যান্ডকে ফাইনালে তুলেছিলেন ববি মুর। কাপটাও জিতেছিল ইংল্যান্ড। এটাই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষবার। বাকি সময়ে ইংলিশদের স্বপ্নের দৌড় ছিল ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার।
কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে তাদের কাছে বারবার। এবারও স্বপ্ন ভাঙাল, হতাশা সঙ্গী হলো ইংল্যান্ডের। বরি মুরের পাশে ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেনের ছবি দেখার স্বপ্নটা ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেল। ’৬৬-এর পর থেকে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের পথচলা যেন অন্ধকারে সাফল্য খোঁজা। সাউথগেটের কোচিংয়ে হ্যারি কেনের এই তরুণ দলটা নতুন এক আলোর রশ্মি ফেলেছিল ইংলিশ ফুটবলে। যা দেখে অনেকে আশাবাদী হয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে নিয়ে। হ্যারি কেনের আলোয় শুধু ইতিহাস ছুঁয়ে দেখা নয়, ইতিহাসের পাতায় জায়গা পাবে তারা, এই স্বপ্ন নিয়ে ইংলিশ সমর্থকরা রাশিয়ায় জড়ো হতে শুরু করেন। মুখে সেই থিম সং ‘কাপ এবার বাড়ি ফিরবে!’
কিন্তু শুধু হ্যারি কেনের আলো কেন? ইংল্যান্ডের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে হতাশার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিল ক্রোয়াটরা। লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিটিচরা পুরোনো ইতিহাসকে অন্ধকারে পাঠিয়ে দিলেন। কারণ, নিজেরাই ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন দেখনে। ক্রোয়েশিয়াকে ফাইনালে তুলেছে তারা। তাদের স্বপ্নটা আরো বড় হলো। এবার ক্রোয়াটরা কাপ জয়েরই স্বপ্ন দেখছে। কাপ যুদ্ধে কী হবে, সেটা ১৫ জুলাই রাত বলে দেবে। সেমিফাইনালে ক্রোয়াটরা দেখিয়ে দিলেন, দলটা কোনো একজনের ওপর নির্ভরশীল নয়। হ্যাঁ, সেই দলে রাকিটিচ, লুকা মদ্রিচের মতো তারকা থাকার পরও। এরা একতাবদ্ধ। সংকল্পে অটল। নতুন ইতিহাস ঘটার স্বপ্ন নিয়ে মস্কোতে এসেছে। ইংল্যান্ডের মতো দলকে সেমিফাইনালে বিদায় করে দিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ ফাইনালে।
মেসির মতো মহাতারকাকে আটকে দিয়েছিল তারা। আর্জেন্টিনার মতো দলকে উড়িয়ে দিয়েছিল। রাশিয়ার মাটিতে রুশদের হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে এসেছে। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারাল। তাও আবার ম্যাচের পাঁচ মিনিটে এগিয়ে থাকা ইংল্যান্ড। এই ক্রোয়েশিয়াকে ডার্কহর্স বলুন বা যা-ই বলুন, এরা লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। টানা তিনটা ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে এসে জিতল। তার দুটো আবার টাইব্রেকারে। সেমিফাইনালে ম্যাচের শুরুতেই পিছিয়ে পড়া। সেখান থেকে ম্যাচটাকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যাওয়া। ইভান পেরিসিচের গোলে দলকে ফাইনালে নিয়ে যাওয়া। পুরোটাই প্রায় এক অবিশ্বাস্য কাহিনী মনে হচ্ছে। তবে বিশ্বাস করতেই হবে, ক্রোয়াটরা জানান দিল ইউরোপিয়ান ফুটবলে নতুন শক্তির উত্থানের।
অবশ্য নিজেদের উঠে আসার কথা তারা জানিয়েছিল নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপেই। ’৯৮-এ বিশ্বকাপ খেলতে এসেই সেমিফাইনাল খেলেছিল ডেভিড সুকারের ক্রোয়েশিয়া। সেই সুকার এখন ক্রোয়েশিয়া ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান। গত ২০ বছরে ফুটবলে ক্রোয়াটরা এগিয়েছে, এখন তা মানছে গোটা বিশ্ব। বাকিরা ইতিহাস আর ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে চাইছে। কাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে। একে একে হেরে বিদায় নেয়। তারপর আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে চার বছর পর কাপ জিতবে। কিন্তু ক্রোয়াটরা জানেন, নতুন ইতিহাস মানে পুরোনো ধারার কোনো কিছুকে আলিঙ্গন করা যাবে না, তা নয়। তবে নতুন কিছু করে দেখাতে না পারলে ইতিহাস কাউকে মনে রাখে না।
রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ড যখন শেষবার সেমিফাইনাল খেলেছিল, সে সময় ক্রোয়েশিয়া নামের কোনো দেশ ছিল না পৃথিবীর মানচিত্রে। গত শতাব্দীতে ইতালি বিশ্বকাপে ইংলিশরা সেমিফাইনাল খেলেছিল। তারপর আঠাশ বছরের অপেক্ষা। কিন্তু সেই অপেক্ষার যাত্রায় অন্ধকারে ডুবল ইংল্যান্ডের কাপ বাড়ি ফেরানোর স্বপ্ন। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের গোড়ার দিকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেল ক্রোয়েশিয়া। বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেল ’৯৮-এ। এবং প্রথমবারই তারা গোটা বিশ্বকে চমকে দিল। সেমিফাইনাল খেলল। তৃতীয় হয়ে শেষ করেছিল সেই বিশ্বকাপ। কিন্তু এবার? ক্রোয়াটদের স্বপ্ন আছড়ে পড়ছে কাপের দিকে। যেভাবে সেমিফাইনাল জয়ের পর ক্রোয়াটদের আবেগ আর উচ্ছ্বাসের ডেউ আছড়ে পড়েছে গ্যালারিতে, সেটা দেখে মনে হতেই পারে ১৫ জুলাই রাতে মস্কোতে সেই ঢেউ আরো প্রবল আরো তীব্র হয়ে আছড়ে পড়তে পারে। দাবার ছক কাটা লাল-সাদা জার্সি পরা ক্রোয়াটরা ইতিহাস গড়ার অপেক্ষায়। নয়া ইতিহাস। নয়া শক্তির জানান দিচ্ছে তারা।
রাশিয়া বিশ্বকাপকে অনেকে অনেক নামে ডাকতে শুরু করেছে। আবেগে অন্ধ হয়ে তাদের কেউ কেউ আবার নতুন কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। আবেগতাড়িতে তাদের মুখ আর কলম থেকে বেরিয়েছে কত শব্দ। কত উপমা। চ্যাম্পিয়নদের বিদায়ের বিশ্বকাপ। অঘটনের বিশ্বকাপ। চ্যাম্পিয়নদেরও গিলে খাওয়ার বিশ্বকাপ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের শেষ বাঁশি যদি বাজে নতুনের জয়গানের সুর তুলে, তাহলে তাতে স্বাগত জানাতে না পারা সেটা নিজেদের অক্ষমতা, আর উদারতাহীন এক মানসিকতা।
জার্মানি চলে গেছে ফেভারিটদের মধ্য থেকে সবার আগে। কাপটা রেখেই চলে গেছে। ৩২টা দলের মধ্যে শুধু জার্মানদের কিছু হারানোর ছিল। রাশিয়ায় কাপটা রেখে তারা প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিল। কিন্তু সেই জার্মানিই থেকে গেল বিশ্বকাপের শেষ পর্যন্ত।
হ্যাঁ, তাই জার্মানদের স্লোগানটাই থেকে গেছে। যারা এবারের বিশ্বকাপে এসেছিল দারুণ একটা স্লোগান নিয়ে, ‘যে জেতে সে জিতুক। কেউ যেন না হারে।’ ফুটবল জিতলে বাকি কারো হার কি মনে রাখবে ফুটবলবিশ্ব। সবাই মিলে ইতিহাস লেখার আহ্বান ছিল জার্মানদের। কাপ যারাই জিতুক, এবার বিশ্বকাপ ইতিহাসে নতুন একটা অধ্যায় কিন্তু লিখেই ফেলল ক্রোয়েশিয়া। দুই চ্যাম্পিয়নদের বিদায় করল। স্বাগতিকদের বিদায় করল। টানা তিনটা ম্যাচ ১২০ মিনিট করে খেলল। এরপর ফাইনালে ফ্রান্স যদি কাপ জেতে জিতুক। কিন্তু ক্রোয়াটরা হারল কোথায়। ওরা তো ফুটবলে নতুন শক্তির জয়গান গেয়েই চলেছে।
জার্মানদের রেখে যাওয়া বাক্যটাই সত্যি হয়ে গেল। ‘লেটস রাইট হিস্ট্রি টুগেদার!’ হ্যাঁ, ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া হারালেও ক্রোয়াটদের বাদ দিয়ে কী আর রাশিয়া বিশ্বকাপের ইতিহাস খেলা যাবে।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।