কাপ যুদ্ধ
ক্রোয়াট ফুটবলে লড়াই-সংগ্রাম-সংহতি
লড়াই। সংগ্রাম। সংহতি। এই তিনটা শব্দ দিয়েই দাঁড় করানো ক্রোয়াটদের গোলপোস্ট! নকআউট, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল। এই তিনটা ম্যাচেই প্রতিপক্ষ ক্রোয়াটদের গোলপোস্টে আগে বল পাঠিয়েছে। কিন্তু ওদের পোস্টে জমা রাখা গোল সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিয়েছে ক্রোয়াটরা। একবার, দুবার নয়, তিন-তিনবার! এবং তিনবারই ম্যাচের নির্ধারিত সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর। প্রথম দুবার ১২০ মিনিট খেলার পর টাইব্রেকারে। আর সেমিফাইনালে ১২০ মিনিটের লড়াইয়ের মধ্যে। এই ক্রোয়েশিয়াই ইতিহাস গড়ে ফাইনালে। বিশ্বকাপে নতুন ইতিহাস গড়ার অপেক্ষায়।
মেসি-নেইমার-রোনালদোর মতো মহাতারকা নেই ক্রোয়াটদের। কিন্তু সেই দলটাই কি না ফাইনালে! বিশ্বকাপের ইতিহাসে এভাবে ফাইনালে উঠে আসার নজির খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনটা ম্যাচ অতিরিক্ত সময় কিংবা টাইব্রেকারে জিতে ফাইনালে! কীভাবে সম্ভব!
হ্যাঁ, সম্ভব। শুধু ক্রোয়াটদের পক্ষে সম্ভব। ওরা সেটা সম্ভব করে দেখাল। ৪২ লাখ মানুষের ছোট্ট একটা দেশ এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলছে। ভাবা যায়! অনেকে বলছেন, তিন লাখ ৩২ হাজার মানুষের দেশ আইসল্যান্ডও তো বিশ্বকাপ খেলল। খেলেছে। কিন্তু বিশ্বকাপ খেলা আর বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা নিশ্চয়ই এক কথা নয়। বিশ্বকাপ যুদ্ধে ক্রোয়াটদের লাস্ট ফ্রন্টিয়ার হচ্ছে ফাইনাল। সেখানে তারা পৌঁছে গেছে। সামনে ফ্রান্স। ২০ বছর আগে ওই ফ্রান্সের মাটিতেই তারা প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছিল। বিশ্বকে চমকে দিয়ে সেমিফাইনালে খেলেছিল। সেবার তাদের কাপের স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় সেমিফাইনালে। ২০ বছর পর তাদের স্বপ্নের সীমানা বেড়ে গেছে। কাপ ছুঁয়ে দেখার খুব কাছাকাছি দূরত্বে দাঁড়িয়ে ক্রোয়াটরা।
কাপ ছুঁয়ে যদি দেখতে তারা নাও পারে, তবে বিশ্বের অনেকের মন ছুঁয়ে ফেলেছে ক্রোয়াটরা। সেটা ক্রোয়াটরা করেছে মাঠে তাদের লড়াই-সংগ্রাম-আর সংহতি দিয়ে। ক্রোয়াটরা জন্মগতভাবেই যোদ্ধা। হার না মানা কঠিন মানসিকতার। লড়াকু মনোভাবই ওদের বড় সম্পদ। যে সম্পদকে পুঁজি করে তারা রাশিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দেশকে হারিয়ে দিল। রাশিয়া বিশ্বকাপকে অনেকে বলছেন ‘অঘটন’-এর বিশ্বকাপ! সত্যিই কি তাই? নাকি রাশিয়া বিশ্বকাপ হচ্ছে বিপ্লবের বিশ্বকাপ! ক্রোয়েশিয়া সেই বিপ্লবের পতাকাটা উঁচিয়ে ধরেছে। ওদের পতাকা নামিয়ে দিতে হলে ফরাসিদের সত্যিই আরো বড় বিপ্লব ঘটাতে হবে ফাইনালে।
বিপ্লব। লড়াই। সংগ্রাম। যুদ্ধ। যুদ্ধ জয়। এর সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় আছে ক্রোয়াটদের। মধ্যে ইউরোপের দেশ যুগোস্লাভিয়ায় আশির দশকের শেষ দিকে টালমাটল অবস্থা। জাতিগত দাঙ্গা, রক্তারক্তির কারণে যুগোস্লাভিয়া ভাঙনের মুখে। সার্বিয়ানরা, ক্রোয়াটরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করলো। সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়া ভেঙে গেল। ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হলো। কিন্ত অনেক ক্রোয়াট প্রাণ হারাল। তাদের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে ’৯৮-এ প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল ক্রোয়েশিয়া। প্রথমবার তারা চমকে দিয়েছিল। ডেভর সুকার নামের এক ফুটবলার ‘গোল্ডেন বুট’ জিতে নিলেন। জানান দিয়ে গেলেন উঠে আসছে তার দেশ। হ্যাঁ, সুকার দেশ ক্রোয়েশিয়া রাশিয়ায় জানান দিল, তারা উঠে এসেছে। ফুটবল নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সেই সুকার এখন ক্রোয়েশিয়া ফুটবলের প্রধান। তার মস্তিষ্ক থেকে নতুন বিপ্লবের চিন্তা বেরিয়েছে। যার প্রায় সফল বাস্তবায়ন করে ফেলেছেন লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিটিচ, পেরেসচি, ভিদাররা!
লুকা মদ্রিচ। রাকিটিচের নাম হয়তো কিছুটা পরিচিত। সেটা লা লিগার সৌজন্যে। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনায় খেলেন বলে। কিন্তু মেসি, রোনালদো, নেইমারদের মতো এত ভারী নাম কি তাঁদের আছে! না। সে কারণে কখনো ব্যালন ডি’অরের জন্য তাঁদের নাম শোনা যায়নি। কিন্তু এবার তাঁরা বিশ্বমঞ্চে দেখালেন, ক্লাব তাঁদের রুটি-রুজির জায়গা। কিন্তু দেশ? সেটা তাঁদের পরিচয়। সেই পরিচয়টা বিশ্বে নতুনভাবে তুলে ধরতে ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়েও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে মাঠে নামতে পারেন রাকিটিচ! দেশের যুদ্ধে বাড়িঘর সব পুড়তে দেখেছেন লুকা মদ্রিচ, দেখেছেন নিজের পিতামহকে খুন হতে, যে দেশের জন্য ছোটবেলায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল অনেক দূরে সমুদ্রপাড়ে একটা হোটেলে। সেই হোটেলের লবিতে ফুটবলে লাথি মারতে মারতে যার বড় হওয়া, সেই তিনি নিজের দেশ ক্রোয়েশিয়াকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন! ক্রোয়াটরা অসম্ভব পরিশ্রমী। তার প্রমাণ আগের তিন ম্যাচে ১২০ মিনিট করে লড়াই। ওরা ভেঙে পড়ে না। তার প্রমাণ আগের তিন ম্যাচে গোল হজম করে আবার পাল্টা আক্রমনের ঝড় তুলে ম্যাচ বের করে নেওয়া। লৌহ কঠিন মানসিকতার প্রমাণ তারা দিয়েছে। আর ওরা তারকা নয়, দলীয় সংহতিতে বিশ্বাসী। বিশ্বাস করে বলেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পেরেসিচ, যার পাস থেকে গোলটা করে দলকে ফাইনালে তুললেন, সেই ভিদার তাঁর আগে কুড়িটা মিস পাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের দিকে বিরক্তি মেশানো কোনো অভিব্যক্তি দেখাননি তাঁর কোনো সতীর্থ!
ক্রোয়াটরা হার মানতে পারে না। হারকে বড্ড ঘৃণা তাদের। আর অনেক পরিশ্রম, সংগ্রাম, লড়াইয়ের পর জয়টাকেও উদযাপন করতে পারে দারুণভাবে। সেটা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের পর কোচকে মাটিতে ফেলে দিয়ে কী দারুণ উদযাপন তাদের! আর রাশিয়াকে হারানোর পর ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট যেভাবে ড্রেসিংরুমে ফুটবলারদের সঙ্গে উদ্দাম নাচ নচালেন, তাতে কে বলবেন তিনি দেশটার প্রেসিডেন্ট! তিনিও যেন ক্রোয়েশিয়া টিমের এক সদস্য! এবারের বিশ্বকাপে জয় উদযাপনের সেরা মুহূর্ত হিসেবে জায়গা পেয়ে যেতে পারে সুন্দরী ক্রোয়াট প্রেসিডেন্টের ওই ড্যান্স! মেসি-রোনালদো-নেইমার-লুকাকু-হ্যারি কেনদের ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব আলো এখন ক্রোয়াট প্রেসিডেন্টের ওপর। সেটা দেখে ভ্লাদিমির পুতিন থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঈর্ষাকাতর হতেই পারেন!
ফাইনালে যদি এই ক্রোয়েশিয়া হারেও ফ্রান্সের কাছে, তারপরও তারা হারিয়ে যাবে না খুব তাড়াতাড়ি। মানুষের মনে গেঁথে গেছে ক্রোয়াটদের লড়াই করার মানসিকতা। দলীয় সংহতিতে বিশ্বাস। আর জয় উদযাপনের অভিনবত্ব! ক্রোয়েশিয়া বার্তা দিয়ে গেল পাল্টে যাচ্ছে ফুটবল বিশ্ব।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।