কাপ যুদ্ধ
নতুনের কেতন কি উড়বে আজ?
রূপকথা লেখা হলো না রুশদের। কিন্তু রূপকথা দিয়েই শেষ হতে পারে রাশিয়া বিশ্বকাপ। নতুন এক চ্যাম্পিয়নকে পেলে সেটাকে রূপকথা ছাড়া অন্য কী বলবেন? সেই রূপকথার জন্ম দিতে পারে ক্রোয়েশিয়া। আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে ফ্রান্স। ফরাসি বিপ্লব নাকি ক্রোয়াট রূপকথা? রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। উত্তর পাওয়া যাবে আজ রাতেই।
ক্রোয়াটদের সামনে নতুন ইতিহাস গড়ার হাতছানি। আর ফরাসিদের সামনে নিজেদের ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করার সুযোগ। প্রথমবার ফাইনাল খেলতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া। ৪২ লাখ মানুষের আবেগের স্রোত বইছে গোটা ক্রোয়েশিয়ায়। যে আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে ১১ জন ক্রোয়াটের পায়ে পায়ে মস্কোতে। সেই ঢেউয়ে ভেসে যেতে পারে ফরাসিদের কাপ জয়ের ঐতিহ্য। আবার আবেগের ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটলে তাতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে ক্রোয়াটদের ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন। ক্রোয়াটদের আবেগ-লড়াই-টিম ওয়ার্কের পাশে ফরাসিদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অস্তিত্ববাদের দর্শন। সব মিলিয়ে দারুণ এক ফাইনাল দেখার জন্য উন্মুখ গোটা ফুটবল বিশ্ব।
এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে ল্যাটিনদের কবিতার মতো ফুটবলে এবার ছন্দেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে কারণে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ের মতো দল ফাইনালের অনেক আগেই আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দেশে ফিরেছে। স্প্যানিশদের তিকি-তাকা কার্যবারিতা হারিয়েছে। জার্মানদের পাওয়ার আর প্রযুক্তিনির্ভর ফুটবল ব্যর্থ হয়েছে। ইংল্যান্ডের ফুটবলকে বাড়ি ফেরানোর স্বপ্ন অস্তরাগে চলে গেছে ফাইনালের আগে। টিকে থাকল লড়াকু ক্রোয়াটদের হার না মানা ফুটবল মানসিকতা। আর ফরাসিদের বহুত্ববাদের মহামিলনের ফুটবল দর্শন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হবে একটি দলের। নতুনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত অনেকে। তাদের মনে কাজ করছে আবেগ। আর যুক্তি বলছে ফরাসিদের অভিজ্ঞতাকে পেছনে ফেলতে পারবে তো ক্রোয়াটরা?
নবীনতম এক দেশ হিসেবে ফাইনাল খেলছে ক্রোয়েশিয়া। নব্বইয়ের গোড়ায় গৃহযুদ্ধ-দাঙ্গা-রক্তের মধ্যে ভাসতে ভাসতে যে দেশটার জন্ম, আজ তারা ফাইনালে! আবেগের বিস্ফোরণের জন্য আর কিছু লাগে! প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসে ক্রোয়াটরা চমকে দিয়েছিল বিশ্বকে সেমিফাইনালে পৌঁছে। তাই এবারের ফাইনাল তাদের কাছে যেমন নয়া ইতিহাস গড়ার মঞ্চ, তেমনি প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ। ১৯৯৮ সালে তারা ফাইনাল খেলতে পারেনি, সেমিফাইনালে এই ফ্রান্সের কাছে হেরে। এবার ফাইনালে তাদের সামনে সেই ফ্রান্স। তাই ইতিহাসের পাশাপাশি ক্রোয়াটদের সামনে প্রতিশোধের হাতছানি!
প্রচণ্ড পরিশ্রমী আর লড়াকু ক্রোয়াটরা। সেটা দেখিয়েছে তারা আগের তিন ম্যাচে। পিছিয়ে পড়েও কীভাবে ফিরতে হয়, সেটা যেন তারা নামতা পড়ার মতো মুখস্ত করে ফেলেছে আগের তিন ম্যাচে। তিনটা ম্যাচকে তারা টেনে নিয়ে গেছে ১২০ মিনিট পর্যন্ত। প্রথমে পিছিয়ে পড়ে সমতা ফিরে টাইব্রেকারে জিতেছে তারা নক আউট আর কোয়ার্টার ফাইনাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ মিনিটে গোল হজম করে একের পর এক আক্রমণের ঢেউ তুলে সমতায় ফিরেছে। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা জিতে ফাইনালে। এই দলটায় মেসি-নেইমার-রোনালদোর মতো মহাতারকা নেই। কিন্তু গোটা দল তারা বড় বিপজ্জনক। সেটা প্রমাণ করতে করতে ফাইনালে। নিজেরা বড় তারকা হয়তো নন। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে বড় তারকাদের পাশে খেলার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। বড় ক্লাবে হয়ে শিরোপা জিতেছে তারা। কিন্তু এটা বিশ্বকাপ ফাইনাল, সেটাও জানেন লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিটিচরা। ইতিহাস গড়ার এই সুযোগ পায়ে মাড়িয়ে ফরাসিদের হাতে তারা তুলে দিতে চাইবে না।
অন্যদিকে ফ্রান্স কাপ জয়ের এই সুযোগকে হাত ছাড়া করতে চাইবে না। ১৯৯৮ সালে একজন জিদান তাদের কাপ জিতিয়েছিলেন। আবার ২০০৬ সালে একজন জিদানই মেজাজ হারিয়ে তাদের ফাইনাল হারিয়েছিলেন। ফাইনালের দুটো পিঠ দেখা ফরাসিদের। গ্রিজম্যান-এমবাপে-পগবারা জানেন ফরাসি বিপ্লবের ঝাণ্ডা ওড়ানোর সেরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারা। ইউরো ফাইনালের দুঃসহ স্মৃতি তাদের এখনো পোড়ায়। সেই অন্তরদহন আর বাড়াতে নারাজ তারা বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে।
কাপ যার হাতেই উঠুক, দারুণ এক ফাইনালের স্বপ্ন দেখতেই পারে ফুটবল বিশ্ব। কারণ, দুটো দলের আছে দারুণ এক ঝাঁক ফুটবলার। যাঁরা সোনায় মোড়ানো বিশ্ব ফুটবলের অনেক খণ্ড চিত্রকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ফ্রান্সের এক সময়ের সেরা মাঝমাঠের চার তারকা ছিলেন মিশেল প্লাতিনি, টিগানা, জিরেস আর ফার্নান্দেজ। দুর্দান্ত কম্বিনেশন ছিল তাঁদের। তাঁরা প্রত্যেকে জানতেন কাকে কখন বল জোগান দিতে হবে। কাকে কখন কোথায় দাঁড়াতে হবে। কীভাবে ছুঁটতে হবে। ক্রোয়েশিয়া দলে এবার ওই রকম চার ফুটবলার লুকা মদ্রিচ-ইভান রাকিটিচ-পেরিসিচ আর মানদুকিচ। এরা কেউ এক সঙ্গে এক ক্লাবে খেলেন না। কিন্তু জাতীয় দলে কী অসাধারণ তাঁদের বোঝাপড়া! মদ্রিচ দলের ফিল্ড মার্শালের ভূমিকায়। রাকিটিচের পায়ের ছোঁয়া কাঁপন ধরাচ্ছে বিপক্ষের ডিফেন্সে। পেরিসিচ সামনে নিখুঁত পাস বাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আর মানদুকিচ? ক্রোয়াটদের ফাইনালে তুলে আনলেন অসাধারণ এক গোল করে। এ রকম একটা দলকে আটকানোর সহজ হবে না।
ফ্রান্সেও আছেন গ্রিজম্যানের মতো মাঝমাঠের শিল্পী। যিনি খেলাটাকে গড়ে দিতে পারেন। গোল করতে পারেন। গোল করাতে পারেন। আছেন স্বপ্ন জয়ের দৌঁড় দেওয়ার মতো এক ফুটবলার এমবাপে। আছেন পল পগবা। যিনি মাঝমাঠ দখলে রাখার দেঁশমের এক বিশ্বস্ত সৈনিক। এরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন এখন আর একজন পেলে, একজন ম্যারাডোনা বা একজন জিদানের সৌজন্যে বিশ্বকাপ জেতার দিন শেষ। এখন বিশ্বকাপের নতুন ফর্মুলা আছে, সেটি হলো টিম ওয়ার্ক বা দলীয় সংহতি।
আপনার আমার আবেগ, অনুভূতি যাই বলুক, দলীয় সংহতি যাদের যত সুদৃঢ় থাকবে, কাপ তাদের হাতেই উঠবে। তাতে নতুনের জয়গান গাইতে পারে বিশ্ব। নতুনের জয়গান বা পুরোনো ইতিহাসের চর্চা, ফাইনালে যাই হোক, ফুটবলে বিবর্তন আর বিপ্লব দুটোই দেখে ফেলল বিশ্ব। সেটাই বা রুশ রূপকথার চেয়ে কম কি! ক্রোয়েশিয়ার মতো একটা দল বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলছে, বিপ্লব ছাড়া কী বলবেন একে! আর ফরাসিরা যাদের হাত ধরে ফাইনালে উঠল, তারা আফ্রিকা, মধ্য এশিয়ার উদ্বাস্তু জীবনের বস্তি থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন! সভ্যতার বিবর্তনে মানবতার অন্য এক রংও কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ফাইনালে?
সোনালি রঙের একটা কাপ ঘিরে এই যুদ্ধে জয় হবে মানবতার রঙের। মহামিলনের শেষ হবে রাশিয়ায় ফ্রান্স বা ক্রোয়েশিয়ার জয়োল্লাসে। কিন্তু সাদা-কালোর মিশেলে জয় হবে মানবতার। ফুটবল ঘিরে রুশ রূপকথা পাচ্ছে নতুন এক মাত্রা। ক্রোয়েশিয়া জিতলে তাদের জার্সিতে যোগ হবে একটা তারকা। আর ফ্রান্স জিতলে তাদের জার্সিতে একটা তারকার জায়গায় দেখা যাবে আরো একটা তারকা। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপ শেষ হোক সব অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে আলো ছড়ানো এক ফাইনালের মধ্য দিয়ে। যেখানে জয় হবে ফুটবলের। জয় হবে মানবতার।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিষ্ট ও কলাম লেখক