ফুটবল বিশ্বকাপ
এবারের চ্যাম্পিয়ন ফরাসি তারুণ্য
ফুটবল নিয়ে অনেকেই আভিজাত্য বা কৌলিন্যের গল্প শোনান। কথিত কুলীনরা বাদে বাকিরা ভালো ক্রীড়ানৈপূণ্য উপহার দিলেও তাকে বলা হয় ‘অঘটন’। বিশ্বকাপ মানেই তারা ধরে নেন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইটালি, স্পেন বা ফ্রান্সের মতো গুটিকয়েক দেশ ছাড়া আর কেউ ফুটবলের নান্দনিক ভাষা বুঝে না, এমনকি ঠিকঠাক খেলতেও পারে না! খুব সংগত কারণেই সর্বদা ফেভারিট তকমা পাওয়া নামকরা এসব দেশের ভক্তের সংখ্যাও বিশ্বব্যাপিই খুব বেশি। বিশেষকরে বাঙালির প্রায় সবাই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বলতে ফুটবল অজ্ঞান। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া যারা কিনা এবারের বিশ্বকাপের বাছাইপর্বও সরাসরি পেরোতে পারেনি, তারাও নিজেদের ফুটবল শৈলির ম্যাজিক দেখিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সাথে দুর্দান্ত খেলে গেল। হৃদয় নিংড়ানো ধন্যবাদটা তাই অবশ্যই পাওনা এই ক্রোয়াটদের। আর বিশ্বের কোটি দর্শককে সাথে নিয়ে রাশিয়ার লুঝকিনির সন্ধ্যাটা মাতিয়ে দেয়ার জন্য টুপি খোলা অভিনন্দন ফ্রান্সকে। যারা দেখিয়ে দিয়েছে বয়সীদের অভিজ্ঞতা না থকলেও তারুণ্যের বিজয় মশাল কিভাবে জ্বালতে হয়। ফ্রান্স হিসেবি ফুটবল খেলেই বিজয়ী হলো আর দারুণ ফুটবলীয় রোমাঞ্চ দেখিয়েও ক্রোয়াটরা হয়ত এ যাত্রা পেরে ওঠলেন না। কিন্তু তাদের ফুটবল যাত্রার ভবিষ্যৎ নিশ্চিতই একদিন আরো বড় ইতিহাসে নিয়ে দাঁড় করাবে।
সমান অংশ্রগ্রহণ ও দুর্দান্ত প্রতিযোগিতামূলক ছিল এবারের ফাইনাল ম্যাচ। যদিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ক্রোয়াটদের হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তুলল তারুণ্যদীপ্ত ফরাসিরা। কিন্তু কোচ জালাতকো দালিচের ক্রোয়াটরাও কোনো অংশে কম নৈপূণ্য দেখাননি। ক্রোয়াট মারিও মানজুকিচের আত্মঘাতী গোল কিংবা ইভান পেরিসিচের হ্যান্ডবল ঘটনার খানিকটা এদিক-সেদিক হলে ম্যাচের ফলাফল ভিন্নতরও হতে পারত। খেলাতে জয় পরাজয় এক অনিবার্য পরিণতি। এখানে একপক্ষের বুক ভেঙ্গে বিদীর্ণ হয়, অশ্রু ঝরে আর অন্যপক্ষ আনন্দের আতিশয্যে উদ্বেলিত হয়। ফরাসি গ্রিজম্যান, পগবা বা এমবাপ্পেরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের সৌরভ ছড়িয়ে শেষ হাসিটা হেসে মাথায় বিজয়ীর মুকুট পরল। ওরা এখন আগামী চার বছরের জন্য ৬ কেজি ওজনের সুবর্ণ কাপের মালিক। সাথে থাকল ৩৮ মিলিয়ন ডলার তথা ৩১৮ কোটি টাকার নগদ নারায়ণ।
১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলতে এসেই চমক দেখিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। উঠেছিল সেমিফাইনালে। এরপর পরের বিশ্বকাপে হতাশ করেছে তারা। তিনবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে, আর একবার মূল পর্বে খেলার সুযোগই পায়নি। দীর্ঘদিন পর আবার তারা বিশ্বকাপে খেলতে গিয়েছিল আত্মপ্রত্যয়ী প্রাজ্ঞপ্রজন্ম নিয়ে। দারুণ ফর্ম দিয়ে লুকা মদ্রিচ, ব্রোজোভিচ, ইভার রাকিটিচরা নিজেদের চিনিয়ে দিয়ে ছিনিয়ে নিল সম্মানজনক রানার্সআপ সম্মাননা। আর এই দলের লুকা মড্রিচ নিজের করে নিল এডিডাস গোল্ডেন বল অ্যাওয়ার্ড। আর এভাবেই ঘুচে গেল চিরায়ত ফুটবল মহাভারত, বিশ্বকাপ মানেই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল!
মাত্র ২৭ বছর বয়সী একটা দেশ, যাদের কিনা নিজেদের শান সৌকতপূর্ণ স্টেডিয়াম পর্যন্ত নেই, মূল ভূখন্ডের তিনভাগই জঙ্গলাকীর্ণ সেই ৪০ লাখ মানুষের ছোট্ট দেশই এখন বিশ্ব ফুটবলের আলোচিত এক কান্ট্রি। একটা সময় বাংলাদেশেরও নিচে ছিল ক্রোয়েশিয়ার ফিফা ফুটবল র্যাংকিং। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা, প্রত্যয়, নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা আজ ওদেরকে নিয়ে গেছে চূড়ায়। আর আমরা ক্রমশ তলানিতে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। নারী ফুটবলাররা কিছুটা আশা জাগানিয়া পারফর্মেন্স করলেও ছেলেদের ফুটবল নিয়ে নতুন কোনো আশাবাদের জায়গা আর আমাদের অবশিষ্ট নেই। শোনা যায় বাফুফে’র বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের আমলে নাকি বঙ্গবন্ধু ফুটবল স্টেডিয়ামে এখন সবজি চাষ হয়।
আপাত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপের মতো আসরে রানার্সআপ হওয়ার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হলো যে, ক্রীড়াশৈলি হিসেবে একমাত্র ফুটবলেরই আছে সর্বজনীনতা। আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই এই খেলাটা যেমন খেলতে পারে তেমনি সমান্তরালভাবে উপভোগও করতে পারে। ক্রিকেটের মতো তথাকথিত মোড়ল রাষ্ট্র বলে ফুটবল ভুবনে তেমন কিছু আর রইল না।
অন্যদিকে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে তৃতীয়বারের মতো ফাইনাল খেলে দ্বিতীয়বার কাপ জিতল ফ্রান্স। এই আসরে সবচে’ কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে ফিফা ইয়ং প্লেয়ার অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী এমবাপের বিধ্বংসী গতি আর পায়ের ঝলকও সবার মন কেড়েছে। এমনকি বয়স ২০ বছর হওয়ার আগেই বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করে কিংবদন্তি পেলেকেও স্পর্শ করলেন এই কিলিয়ান এমবাপে। অন্যদিকে খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিলের মারিও জাগালো ও জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার পাশে বসার সুযোগ পেলেন ফ্রান্সের সফল কোচ দিদিয়ের দেশমে। ২০ বছর পর ফ্রান্সের আকাশে এখন জাজ্বল্যমান আরেকটি বিশ্বকাপ তারা। ফ্রান্সের তরুণ তুর্কিরা নিজেদের ইস্পাতসম দৃঢ়তা, দলীয় চেতনা আর নিজেদের অতীত বিজয় ইতিহাসের অনুপ্রেরণা দিয়ে জিতে গেল রাশিয়া বিশ্বকাপ-২০১৮।
আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে রাশিয়া বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ভিডিও এসিস্ট্যান্ট রেফারি ব্যবহার করে ভালো ফলাফল মিলেছে। এবং সামগ্রিক রেফারিং নিয়ে পক্ষপাতদুষ্টতারও অভিযোগ তেমন পাওয়া যায়নি। যদিও ফিফার বর্তমান রুলস অনুযায়ী ক্রোয়াটদের বিপক্ষে আর্জেন্টাইন রেফারির হ্যান্ডবল পেনাল্টি নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। হোস্ট হিসেবে রাশিয়ার ভূমিকাও সবার প্রশংসাই পেয়েছে। সবমিলিয়ে গেল একমাসের ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে’র আনন্দযজ্ঞে মেতে থাকাটা সার্থকই হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে যে প্রাণবন্ত সম্মিলনী তা আরেকবার দেখিয়ে দিল ফুটবল বিশ্বকাপ। এখানে আর্য-অনার্য বা জাতপাত বলে বিভাজনের বক্ররেখা বলে কিছু ছিল না। মানুষের হৃদ্যতা যেন রেললাইনের মতো সমান্তরালে বহমান থেকেছে।
এই ক’টা দিন মানুষের এই যে ফুটবলে মজে থাকা, দুঃখশোক ভুলে থাকা এর মূল্য অপরিসীম। হতে পারে আমাদের দেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে বাস্তবে ও সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে বাহাস বা গুঁতোগুঁতি ছিল, এটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভ্রাতৃত্বেই রূপপরিগ্রহ করেছে। ট্রলের মজাটা ঝগড়ার মতো দৃশ্যমান হলেও তা বরাবর কৌতুক হয়েই থেকেছে। মানুষ তার নিত্যনৈমিত্তিক যাতাকলে পড়ে মজা করতে ভুলে গেছে। যাপিতজীবনে হারিয়ে ফেলা সেই মজাটা ফুটবল ফিরিয়ে দিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে একে অপরের নিন্দামন্দ চর্চা থেকে বিরত হয়ে আমরা আবার আমাদেরকে ফিরিয়ে আনতে পারি মিলনাত্মক অনবদ্য জীবনকাহিনীতে।
ফুটবলে ধর্মীয় কোনো উগ্রবাদিতা ছিল না, সাদা-কালো বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছিল না, ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমানের জাতিভেদ ঘৃণ্যতাও ছিল না। সবাই একমাঠে খেলেছে, একইধারার পোষাক পরেছে, একই ড্রেসিংরুমে ভাববিনিময় করেছে। নারীরা স্বাধীনভাবে স্টেডিয়াম মাতিয়ে নিজেদের পছন্দের দলকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এই অনুপ্রেরণার প্রধান প্রতিভূ যে লাস্যময় ও সদা হাসিখুশি ক্রোয়াট প্রেসিডেন্ট কলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচ তা বললে অতিশয়োক্তি হবে না। নিজ দেশের ফুটবল জার্সি পরে ফিফা প্রসিডেন্ট জেয়ানি ইনফান্তিনো, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে সাথে নিয়ে ফাইনাল ম্যাচের ভিআইপি গ্যালারি যেমন তিনি রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন, তেমনি বৃষ্টিভেজা পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটাকেও স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়ে গেছেন। ফুটবল সংশ্লিষ্টরা ভিন্ন ভাষাভাষী হয়েও কথা বলেছেন অনিন্দ্য এক ফুটবলের সুরে। খেলোয়াড়রা সবাইকে মাতিয়ে রেখেছেন ছান্দসিক পায়ের জাদুতে।
তথাকথিত ফুটবল আভিজাত্য, সাম্রাজ্যবাদ বা কৌলীন্যপ্রথা ভেঙ্গে দিয়েছে ক্রোয়েশিয়া। আর ফ্রান্সের তরুণরা প্রমাণ করেছে শিল্প বা নিপূণতার ঐন্দ্রজালিক রাজ্যে সবাই সমান। কেউ নয় আশরাফ বা আতরাফ। যেন এক ঈশ্বরের সুবর্ণসন্তান সবাই। ফুটবল তবে মানুষকে মানুষের কাছে মেলায়, গড়ে দেয় আত্মিক বন্ধন। উদার ছন্দে পরমানন্দে দু বাহু বাড়িয়ে চিত্তের পূণ্য তীর্থ থেকে আমরা বরাবর এমন প্রেমময় ক্রীড়ানন্দেরই জয়গান করি। আর মননে রাখি, রাবীন্দ্রিক সত্য, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে।
লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।