ক্রিকেট
যুক্তরাষ্ট্রেও উড়ল বাঙালির জয়পতাকা
ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যাট হাতে। বল নিয়ে রানআপের দিকে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে মুশফিকুর রহিম! দৃশ্যটা ফ্লোরিডার। এই কল্পচিত্রটা যদি বাস্তবে দেখা যেত তার কি প্রতিক্রিয়া হতো দেশজুড়ে? প্রতিক্রিয়া যাই হোক, ফেসবুকজুড়ে ছবিটা ভাইরাল হতো নিশ্চিত। হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ মন্তব্য লেখা হতো নিচে। কেউ হয়তো বলতেন—বাহ, সাকিব-মুশফিকরা ট্রাম্পকে গলফ কোর্স থেকে ক্রিকেট মাঠের দিকে টেনে আনতে পেরেছেন। কেউ হয়তো ভাবতেন, যাক, যে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, সেই দেশটার প্রেসিডেন্টকে অন্তত ক্রিকেটটা শেখানোর সুযোগ পেলেন বাংলাদেশের ছেলেরা। বাস্তবে ট্রাম্পের দেশে বাংলাদেশের ক্রিকেট পতাকাটা কিন্তু ঠিকই উড়িয়ে এলেন সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবাল-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা। সেটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের সৌজন্যে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ। সেন্ট কিটসে হেরে তিন ম্যাচ সিরিজে ০-১-এ পিছিয়ে থেকে মার্কিন মুল্লুকে পা রেখেছিল বাংলাদেশ। সেখানেই বদলে গেল বাংলাদেশের চেহারা। কেন? কীভাবে? এ রকম হাজার প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন মতমত থাকতে পারে ক্রিকেট বিশ্লেষকদের। কেউ বলবেন, ফ্লোরিডার উইকেট একটু স্লো। অনেকটা বাংলাদেশের মতো। কেউ বলবেন, অনেক দিন পর সাকিব ক্যাপ্টেন্সি করেছেন অনেক অঙ্ক কষে। যে অঙ্কগুলো দারুণভাবে মিলে গেছে শেষ পর্যন্ত। কারো বক্তব্য হবে—তামিম ইকবাল নিজের অভিজ্ঞতার প্রমাণ রেখেছেন ধারাবাহিকভাবে। দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন। কিন্তু এসব কিছু বাইশ গজের রসায়ন। এর বাইরেও বড় একটা অনুঘটক ছিল মাঠের বাইরে। গ্যালারিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালিদের ক্রিকেটপ্রেম।
হাজার হাজার মাইল দূর থেকে কেউ প্লেনে চড়ে, কেউ নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে ছুটে এসেছেন ফ্লোরিডায়! সেটা ক্রিকেটের টানে। ক্রিকেটারদের মাঝে নিজের দেশটাকে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন তাঁরা। ফ্লোরিডায় অন্তত তাঁরা হতাশ হননি। বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপেক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে। পকেটের ডলার খরচ করে প্রচুর কর্মঘণ্টা দূরে সরিয়ে রেখে তাঁরা ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশের খেলা দেখতে। হতাশ হয়ে ফিরতে হয়নি তাঁদের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, এমপি, অনেকেই যান। সেখানে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক পতাকা-ব্যানার লেখা দেখা যায়। কিন্তু ফ্লোরিডিয়ায় মার্কিনিরাও একখণ্ড বাংলাদেশকে দেখলেন। সেটা ক্রিকেটের সৌজন্যে। যেখানে কোনো বিভাজনের রেখা খুঁজে পাওয়া যায় না। সবার মুখে বাংলাদেশ শব্দ। বুকেও লেখা বাংলাদেশ। অন্তরে বিশ্বাস বাংলাদেশ। হাতে হাত ধরে তাঁরা গ্যালারিতে উঁচিয়ে ধরেছিলেন তাঁরা বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে। যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে এর আগে কবে বাংলাদেশের এ রকম বিশাল পতাকা ওড়াতে পেরেছে বাঙালি? সাকিব-তামিমদের ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে।
আসলে ক্রিকেট বাংলাদেশের খুব বড় এক ব্র্যান্ড। ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের বড় অ্যাম্বাসাডর। আমরা মাঝেমধ্যে সেটা ভুলে যাই। ধৈর্যহীন বাঙালি মাঝেমধ্যে এতটাই ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন যে একটু খারাপ খেললেই ক্রিকেটারদের ব্যক্তিজীবন নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে যায়! সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কারণে, নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড! ডিজিটাল বিশ্বে ইন্টারনেট, ফেসবুকে ক্রিকেটারদের কথা, ছবি, ভিডিও ট্রল করতে কতক্ষণ। যা খুশি তাই লিখে নিজেকে সবচেয়ে বড় ক্রিকেটভক্ত, দেশপ্রেমিক প্রমাণে নেমে পড়ার লোকের অভাব নেই। তখন মনে হবে আমরাই শুধু দেশপ্রেমিক। ক্রিকেটাররা সবাই খলনায়ক। ভিলেন। কিন্তু বাস্তবে ওরা হিরো বলেই আমরা উল্লাস করার সুযোগ পাই। উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার উপলক্ষ পাই। আসলে আমাদের চিন্তনপ্রণালিতে কোথায় যেন একটা গলদ আছে। যেখানে সাফল্য ছাড়া আমরা জীবনকে খুঁজতে চাই না। আবার কখনো কখনো দলীয় সাফল্যকে ব্যক্তির সাফল্যের মোড়কে বিপণনে নেমে পড়ি। কাউকে ‘সুপার হিরো’ বানাতে চাই। কাউকে খুব ছোট করে দেখতে চাই। দেখাতে চাই।
তবে আমরা যা-ই দেখি, যেভাবেই দেখি, মার্কিনিরা দেখলেন, বাংলাদেশ নামক ছোট দেশটা এখন আর ঠিক ততটা ছোট নেই। সেটা শুধু ক্রিকেটের কারণে নয়। ক্রিকেট মাঠে পণ্য বিপণনের মধ্যে দিয়েও সেটা প্রমাণিত হলো। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বাংলাদেশি বিভিন্ন কোম্পানি আর পণ্যের বিজ্ঞাপন! ক্রিকেটকে পুঁজি করে বাংলাদেশ তার আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ দিচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। সেটা এশিয়া থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে আমেরিকা। সাতচল্লিশ বছরের বাংলাদেশে ক্রিকেটের চেয়ে বড় ব্র্যান্ড আর কটা পেয়েছে?
কিন্তু একটা জায়গায় বাংলাদেশ তার ব্র্যান্ড ভেলুটা ঠিকমতো তুলে ধরতে পারেনি। সেটা হচ্ছে গণতন্ত্র। যে কারণে নির্বাচন এলে এ দেশের রাজনীতিবিদরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন! আর সেই বিদেশিরাও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার সুযোগটা পান! আমরা সুযোগটা করে দিই। তারাও আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, গণমাধ্যম অনেক কিছু নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান। জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেন।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ক্রিকেট-জ্ঞান আহরণে আগ্রহের বিষয়টি আপনি ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পাবেন। জুনিয়র বুশ থেকে বারাক ওবামা। অনেককেই দেখবেন ক্রিকেটের মনোযোগী শিক্ষার্থীর ভঙ্গিতে। তবে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, সেটা গুজব নয়। বাস্তব সত্যি। বিশ্বাস না হলে ইন্টানেটে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন, পাকিস্তান সফরে এসে বুশ ক্রিকেট ব্যাট ধরেছিলেন। পাশে পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ইনজামাম-উল-হক। পোর্ট অব স্পেনে বারাক ওবামাকে ব্যাটিংয়ের গ্রিপ শিখাচ্ছেন এক ক্রিকেটার। আর ভদ্রলোকের নাম? ব্রায়ান চার্লস লারা।
অতএব, ডোনাল্ড ট্র্যাম্প ব্যাট করছেন। বল হাতে সাকিব। আপাত কল্পচিত্র মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে রূপ নিতে কতক্ষণ?
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।