ক্রিকেট
আশরাফুল, শেষ বিকেলে ভোরের ফুল!
ভেবেছিলাম খোলা চিঠি লিখবো। কিন্তু পরক্ষণেই সেই ভাবনার দরোজায় তালা লাগাতে হলো। যাঁর ফেরার বন্ধ রাস্তা খুলে গেল তাঁকে আর খোলা চিঠি লিখে কী লাভ! তিনি নিজে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, স্পট ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত থাকার। তারপর ট্রাইবুনাল ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করেছিল তাঁকে। বাইশ গজে যাতে ঢুকতে না পারেন; তারজন্য পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পায়ের সেই বেড়ি খুলে দেওয়া হয়েছে এক বছর আগে। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। প্রিমিয়ার লিগে গোটা পাঁচেক সেঞ্চুরি করে বুঝিয়েছেন; নিষেধাজ্ঞার বেড়ি পায়ে পরানো হলেও তাঁর ক্রিকেটীয় প্রতিভায় মরিচা পড়েনি। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেট আর আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট! মাঝখানে কাঁটা তারের বেড়া নয়, ইট-পাথরের দেয়াল দাঁড়িয়ে! তাই আরো এক বছর পর খুলে দেওয়া হলো সেই প্রাচীরের দরোজা। সব মিলিয়ে পাঁচ বছর পর আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে ফেরার রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সঙ্গী হিসেবে থাকলো তাঁর ছায়ার চেয়ে বড় এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন! ফিরতে পারবেন তো মোহাম্মদ আশরাফুল?
পারবেন। খুব জোরালো গলায় বলতে পারছেন না কেউ। কারণ, তিনি দাঁড়িয়ে এক ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। বয়স এখন তাঁর ৩৪। ক্রিকেটীয় কয়েদ খানায় কাটানো পাঁচ বছর নিশ্চিতভাবে কেড়ে নিয়েছে তাঁর ফিটনেস। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট এখন অনেকে কিছু দাবি করে একজন ক্রিকেটারের কাছে। শুধু স্কিল আর পারফরম্যান্স নয়। তাঁকে সবার আগে মেটাতে হবে ফিটনেসের দাবি। তারপর নীতিগত সিদ্ধান্তে ক্রিকেট কর্তাদের সদয় সহানুভুতিও পেতে হবে। ফিটনেস, পারফরম্যান্স, এক্সপেরিয়েন্স, সব কিছু দিয়ে তিনি হয়তো ফেরার দাবিটা জোরালো করলেন। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যাবে। তাঁকে দলে স্বাগত জানাবেন কি তাঁর এক সময়ের টিমমেট এবং বর্তমান ক্রিকেটাররা? অতএব তাঁর ফেরার আশার ঢেউয়ের মধ্যে হতাশার চোরা স্রোতও মিশে আছে!
সফল ক্রীড়াবিদদের ব্যাপারে একটা বহুচর্চিত কথা আছে। বয়স? ওটা নিছক শুধুই একটা সংখ্যা। ৩৪ বছর বয়সে অনেকে ক্রিকেটারের টেস্ট অভিষেক হয়েছে। বহু উদাহরণ আছে। ক্রিকেটীয় প্রতিভা তাঁর বিশ্বজনীন স্বীকৃত। তা না হলে ষোল বছর বয়সে টেস্ট আবির্ভাবে ইতিহাস গড়ে সেঞ্চুরি! তাও মুরালিধরন-চামিন্ডাভাসদের ঠ্যাঙিয়ে তাঁদের মাঠেই! ওটা যদি ফ্লুক হয়, তাহলে কুম্বলে, জহির খান, হরভজনদের পিটিয়ে চট্টগ্রামে ১৫৮ রানের ক্ল্যাসিক্যাল ইনিংস! আবার ইংলিশ কন্ডিশনে ত্রিদেশীয় সিরিজে ম্যাকগ্রা-ওয়ার্নদের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে ম্যাচ বের করে নিয়ে আসা। ক্রিকেট বিশ্বকে রীতিমত ভুমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দেওয়া! পরের ম্যাচে ইংলিশ বোলাদের বেধড়ক পিটুনি। আরও একটা ক্রিকেটীয় ভূমিকম্প। যার মাত্রা মাপার ক্রিকেটীয় রিখটার স্কেলের নাম- মোহাম্মদ আশরাফুল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে বিশ্বকাপের সুপার এইটে সাউথ আফ্রিকানদের হতাশায় ডোবানোর ইনিংস এলো যাঁর ব্যাট থেকে তাঁর নামও মোহাম্মদ আশরাফুল। তিনি পারতেন। পারেন। ইতিহাস সেই সাক্ষী দিচ্ছে। কিন্তু তিনি পারবেন, কোনো ক্রিকেট জ্যোতিষ সেটা বলতে পারছেন না।
তবে হ্যাঁ, বয়স তাঁর লড়াই করার পুরো জমিনটা কেড়ে নিতে পারেনি এখরো। ফেরার লড়াই তিনি চালাতেই পারেন। তিনি ফিরতে চান। ভিডিও বার্তায় সেটা পরিষ্কার করেছেন লন্ডন থেকে। ক্রিকেটে মস্তিষ্কে যুদ্ধ চলে। সেটা মোহাম্মদ আশরাফুলকে নতুন করে বোঝানোর দরকার পড়ছে না। সেটা তিনি বোঝেন। তাই সেই যুদ্ধটা শুরু করেছেন তিনি। সে কারণেই হয়তো ইংল্যান্ডে বসে নিজের প্রস্তুতির প্রাক পর্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। আগামী বছর বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে। তিনিও ফেরার জন্য ‘পাখির চোখ’ করেছেন বিশ্বকাপকে।
কিন্তু বিশ্বকাপ খেলতে হলে ঘরোয়া ক্রিকেটে আপনাকে দুর্দান্ত কিছু করে দেখাতে হবে। প্রতিভা, অভিজ্ঞতা, গড়পড়তা পারফরম্যান্সে অন্য যার জায়গা হোক, জাতীয় দলে মোহাম্মদ আশরাফুল নামের কারো জায়গা হবে না। এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আপনাকে অসাধারণ কিছু করে ফেরার দাবিটা জোরালো করতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটেও আপনাকে দেখার দূরবীণ চোখ নিয়ে বসবেন নির্বাচকরা। একই রকম চোখ নিয়ে গ্যালারি কিংবা টিভির সামনে বসার লোকেরও অভাব হবে না। অতএব উচ্চাঙ্ক্ষাকে সঙ্গী করে ব্যাটিংয়ে উদ্ধত, আধুনিক উদারবাদী মননের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র এক নতুন আশরাফুলকে খুঁজবে ক্রিকেট বিশ্ব এখন। খুঁজে পেলে সেটাই হতে পারে, আপনার ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের নয়া অ্যাখ্যান।
তারুণ্য বিকশিত হওয়ার আগেই পেলেন খ্যাতি। যে কারণে রাতারাতি আপনি হয়ে গেলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন। দেশজ ক্রিকেটের প্রথম বড় তারকা। তারপর বদলাতে শুরু করল আপনার পৃথিবীও। খ্যাতির আলোয় উদ্ভাসিত আপনি কীভাবে, কার বা কাদের হাত ধরে ঢুকে পড়লেন অন্ধকার সুড়ঙ্গে! বিখ্যাত সেই আপনি আবার ক্যামেরার ফ্ল্যাশের সামনে দাঁড়ালেন! আপনার খ্যাতির আগে আর একটা শব্দ যোগ হলো ‘কু’! নামি তারকা মোহাম্মদ আশরাফুলের দুর্নাম হলো বিপিএলে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি স্বীকারোক্তি দিলেন। কাঁদলেন। আপনার সেই স্বীকারোক্তি আর কান্নায় স্তব্ধ, বিস্মিত দেশের ক্রিকেটমহল। গোঙানির মতো অস্ফুট স্বরে অনেকের মুখ থেকে শুধু একটা বাক্য বেরিয়েছিল; ‘আশরাফুল! তুমিও!’ কারণ, আপনার কান্না, চোখের জলকে কেউ ড্রামাবাজি মনে করেনি। তবে তাদেরও ছিল নিখাদ ক্রিকেটীয় হতাশা। কান্না ক্রিকেট বিশ্ব অনেক দেখেছে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বোমা বিস্ফোরণের পর কিংসমিডে হান্সি ক্রোনিয়ের চোখের জল দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। মনোজ প্রভাকরের মুখ থেকে কপিল দেবের মতো ভারি নাম বেরিয়ে পড়ার পর শক্ত মানসিকতার লড়াকু এক জাঠ ক্রিকেটারকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব! ইতিহাস সেই সব কান্নার মর্মবাণী ধারণ করে আছে। আপনার কান্নাকে আর যাই হোক কেউ মেকি মনে করেননি। তবে চোখের জলে আপনার ক্যারিয়ারে লাগা কালির চোপ মুছে যায়নি।
পাঁচ বছর পর সেই কলঙ্কের দাগ কিছুটা হলেও মুছে ফেলার চেষ্টা করতে পারেন আপনি। কারণ, আপনি যাদের বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন, সেই কোটি কোটি মানুষের বড় একটা অংশ এখনও বিশ্বাস হারায়নি আপনার দক্ষতার ওপর থেকে। তারা বিশ্বাস করেন, আশরাফুল পারবেন। আপনি ভুল করেছিলেন। তারা ‘বেনিফিট অব ডাউট’ আপনাকে এখনো দিতে চায়।
এক সময় যারা আপনাকে ‘আশার ফুল’ মনে করেছেন, তাদের আপনি হতাশ করেছেন। কিন্তু ফেরার বন্ধ রাস্তা খুলে গেছে। এবার আপনার ফেরার পালা। ফেরার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে, বাস্তববাদী হয়ে, সময়ের সাথে দ্রুত পা মিলিয়ে আপনি ফিরতে পারলে পাঁচ বছর আগে যা ঘটেছিল সেটাকে ‘দুর্ঘটনা’ ভাবতে পারে মানুষ। ফেরার খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনি কিন্তু এখন চিরন্তন বিচারের মুখোমুখি। বঙ্গজ ক্রিকেটে আশার ফুল ঝরে গেছে! শুকিয়ে গেছে। কিন্তু নতুনভাবে ফেরার অনেক নজির ক্রিকেট বিশ্বে আছে। মারলন স্যামুয়েলস, মোহাম্মদ আমির অনেকে ফিরেছেন। আপনি অনুপ্রাণিত হতেই পারেন। আপনি লিখতে পারেন, আপনার ক্রিকেটীয় এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের নয়া অ্যাখ্যান। যার নাম হতেই পারে; ‘শেষ বিকেলে আবার ভোরের ফুল!’
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক