অভিমত
ইমরানের ডাক, সিধুর গমন ও ওঝাঁদের লালবাতি
মরুর বুকে ক্রিকেট! কথাটা এক সময় ক্রিকেটপ্রেমীদের বুকের ভেতর অন্যরকম এক স্পন্দন তৈরি করত। কারণ, সংযুক্ত আরব-আমিরাতে ক্রিকেটে যাত্রা শুরুই হয়েছিল পাক-ভারত ম্যাচের বাড়তি আঁচ নিয়ে। সেই আশির দশকের প্রথম ভাগে শারজায় এশিয়া কাপ। তারপর প্রায় নিয়মিত বিভিন্ন টুর্নামেন্ট। কিন্তু সব ছাপিয়ে মরু ক্রিকেটে বাড়তি আকর্ষণ মানে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। যেখানে শ্বাসরুদ্ধকর বহু ম্যাচের সাক্ষী হাজার হাজার ক্রিকেটপ্রেমী। মরুর বুকে জন্ম হয়েছে কত ক্রিকেট ইতিহাসের। জন্ম হয়েছে কত নতুন অধ্যায়ের। এক সময় মনে হত সংযুক্ত আরব আমিরাতে ম্যাচ মানে ক্রিকেট গ্রহের সেরা ইভেন্ট! চেতন শর্মার বলে জাভেদ মিয়াঁদাদের শেষ বলে ছক্কা! কিংবা ত্রিদেশীয় সিরিজে ক্যাসপ্রোইভিচ-ওয়ার্ন-পল রাইফেলদের ঠ্যাঙিয়ে শচীনের ঝড়ো সেঞ্চুরি! ইউটিউবে সার্চ দিলে এখনো মরুরবুক থেকে ক্রিকেট আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মত বেরিয়ে আসে টুকরো টুকরো অনেক কিছু।
সেই মরুর বুকে আবার ফিরছে এশিয়া কাপ। তবে শারজাহ নয়। ম্যাচ হবে দুবাই আর আবু ধাবিতে। সময় পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে বিশ্ব ক্রিকেট। পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতিতে বদলে গেছে মরুর চেহারাও। সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘দ্বিতীয় হোম’। পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বি-পাক্ষিক সিরিজে সবাই খেলে সেখানে। কিন্তু পাক-ভারত দ্বিপাক্ষিক সিরিজ সেটা আটকে আছে দুই দেশের কুটনীতি আর রাজনীতির লকারে! দুটো দেশ আইসিসির বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলে। এসিসির এশিয়া কাপ খেলছে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সিরিজ! সেখানেই যত আপত্তি! এবং এই জায়গায় আইসিসিও মোটামুঠি ঠুটো জগন্নাথ! অথচ তারা বিভিন্ন দেশের র্যাংকিং ঠিক করছে! অনেকদিন পাকিস্তান-ভারত কোন টেস্ট ম্যাচ খেলছে না একে অপরের বিপক্ষে, অথচ আইসিসি র্যাংকিং ঠিক করছে! আইসিসির এই র্যাংকিং পদ্ধতি রীতিমত হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিরাট কোহলি এই মুর্হুতে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান। তা নিয়ে দ্বিমত করার লোক বা বিশেষজ্ঞ আপাত খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু ইতিহাসের একটা দায় থেকে যাবে। কারণ, ইতিহাস চলে তার নিজের ধারায়। কথা বলে নিজের ভাষায়। আগামীতে ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোন ক্রিকেট পন্ডিত যদি প্রশ্ন করেন; বিরাট কোহলি তার সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন ভাল কথা। হয়তো সর্বকালের অন্যতম সেরাদের তালিকায়ও এক সময় তাঁকে রাখতে হতে পারে। কিন্তু পাক-ভারত ক্রিকেট সম্পর্ক যদি এরকম থাকে, তাহলে অনিবার্যভাবে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে- ‘আচ্ছা, পাকিস্তানের বিপক্ষে ক’টা সেঞ্চুরি আছে বিরাটের? পাকিস্তানি বোলারদের বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্স কেমন?’ গুগলও নিরুত্তর থাকবে! থাকতে বাধ্য হবে। কারণ, দোষ গুগলের নয়। দোষ বিরাট কোহলিরও নয়। তিনি তো পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট খেলার সুযোগই পাচ্ছেন না! এইভাবে চলতে থাকলে ইতিহাসের প্রশ্নে বিরাট কোহলির মত আক্রমনাত্মক ব্যাটসম্যানকেও খুব অস্বস্তিতে পড়তে হতে পারে। এই অস্বস্তির দায় যদিও তাঁর নয়।
তাহলে দায় কাদের? উত্তরটা খুব সহজ। ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, কুটনীতিবিদদের। পাক-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ মানে সেটা রাজনীতির বাইশগজ! পাক-ভারত দ্বিপাক্ষিক ম্যাচ হলেই সেই বাইশ গজে জঙ্গীবাদের ছায়া হানা দেয়। কাশ্মির ইস্যু হানা দেয়। মৌলবাদ হাজির হয়। একই সঙ্গে উগ্রজাতীয়তাবাদও গরহাজির থাকতে পারে না। অথচ তারা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বিশ্বকাপ খেলছে। ইংল্যান্ডের মাটিতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনাল খেলছে। বাংলাদেশে এশিয়া কাপ খেলছে। তখনও তাদের জার্সির রং একই থাকে। শুধু সমস্যা তৈরি হয় দ্বিপাক্ষি সিরিজ হলেই! যাই হোক আইসিসির হেড কোয়ার্টারের পাশে দুবাই এবং আবু ধাবতিতে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে এশিয়া কাপ শুরু হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তান একই গ্রুপে আছে। হয়তো সুপার ফোরেও খেলবে তারা। দর্শকরা একাধিক ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে পাবেন। কিন্তু সেই ম্যাচগুলো হবে তো আমিরাতে। তার আগে ইসলামাবাদে পাক-ভারত সম্পর্কের যে চিত্রনাট্য দেখা গেলো সেটা এক দিক থেকে ভাল। শুধু তার প্রতিক্রিয়াটা খুব স্থুল।
এ মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন সাবেক পাক ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ইমরান খান। রাজনীতির বাইশগজে বাইশবছর কাটানোর পর পাকিস্তানের বাইশতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী ক্যাপ্টেন। তার শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী ভারত থেকে বন্ধু হিসেবে কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কার এবং নভোজ্যিৎ সিংহ সিধুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ইমরান। কিন্তু সুনীল ও কপিল ব্যক্তিগত কাজের কারণে পাকিস্তান যেতে পারেননি। অথবা যাননি। কিন্তু গিয়েছিলেন সিধু। যার এখনকার পরিচয় শুধু সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার নয়। তিনি রাজনীতিবিদও। লোকসভায় বিজেপির সাংসদ ছিলেন। আবার দল বদল করে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে পাঞ্জাবের নির্বাচনে দলকে জয়ী করে পাঞ্জাব সরকারের মন্ত্রী। সিধু পাকিস্তান গিয়েছিলেন। নয়া পাক প্রধানমন্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে কাশ্মিরী শালও নিয়ে গিয়েছিলেন। সবই সৌজন্যতা। সেটা দুটো দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্যও ভাল। সিধুর উপস্থিতিতি ইমরানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অন্যমাত্রা যোগ করেছিল। অন্যবার্তা ছিল কী না সেটা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু ভারতে তার যে প্রতিক্রিয়া, সেটা অন্তত খুব একটা স্বাস্থ্যকর, তেমন দাবি করা যাবে না। ইমরানের শপথ অনুষ্ঠানে পাক সেনা প্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া সিধুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সৌজন্যতা দেখাতে কার্পণ্য করেননি ভারতের সাবেক ক্রিকেটারও। তিনি ভদ্রতা আর সৌজন্যতার হাত বাড়িয়েছেন। বাজাওয়া তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। এবং সেটা নিয়েই ভারতে শুরু হয়েছে রাজনীতি। বিহারের এক আইনজীবী সুধীর ওঝা সিধুর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন আদালতে! সিধুকে দেশদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহীর পর্যায়ে নিয়ে যেতে উদ্যগী হয়েছেন এই বিহারী বাবু!
পাক-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে ক্রিকেট কুটনীতির হাতিয়ার হতে পারে। অতীতে তেমনটা দেখা গেছে। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় কার্গিল যুদ্ধ হয়েছে। তারপরও তিনি বাসে করে ওয়াগা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তান গেছেন। তাঁর সেই বাসযাত্রায় কিন্তু কপিল দেবের মত বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। পাকিস্তান নিয়ে ভারতীয়দের যত এলার্জি থাকুক, ক্রিকেটার ইমরান খান কিন্তু ভারতীয়দের কাছে থেকে সব সময় বাড়তি ভালবাসা-শ্রদ্ধা পেয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইমরান? সিধুর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে আসলে পাকিস্তানের উজির-এ আমিরের মসনদে নতুনভাবে স্ট্যান্স নেয়া ইমরান খানকে গুগলি দিলেন সুধীর ঝাঁ-র মত অপরিচিত, আনাড়ী বোলার!
সিধু ক্রিকেট জীবনে অনেক বেশি ব্যাকফুটে ছিলেন কথা বলার ব্যাপারে। এখন কিন্তু টেলিভিশনে শুধুই ফ্রন্টফুটে! অন্তত কথা বলার সময়। তবে সেই সিধু পাকিস্তানে যাওয়া নিয়ে খানিকটা ‘নো কমেন্ট’ অবস্থায়। অবস্থা যাই হোক, ইমরান খান কিন্তু ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ক্রিকেটকে ব্যবহার করবেন, তেমন আভাস মিলছে। ক্ষমতায় এসেই খুব দ্রুত যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন ইমরান তার মধ্যে একটা হলো, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে নয়া প্রেসিডেন্ট নিয়োগ। আইসিসির সাবেক সভাপতি, এহসান মানিকে তিনি পিসিবির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দিয়েছেন। ক্রিকেট বিশ্বে সজ্জন হিসেবে একটা পরিচিতি আছে, শিক্ষিত ও মার্জিত মানির। এশিয়া কাপের সময় হয়তো তিনি মরুর শহরের বসেই ভারতীয় ক্রিকেট কর্তাদের সাথে আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নেবেন।
কিন্তু পাক-ভারত সম্পর্কের যৌথ স্ক্রিপ্ট বা চিত্রনাট্য লেখায় বড় ভূমিকা থাকে, ইসলামাবাদের পাশে পাক সেনা সদরের এবং অবশ্যই দিল্লির সাউথ ব্লকের। ক্রিকেট সেখানে দুই এক লাইন জায়গা পেলেও পেতে পারে। তবে সম্পর্কের প্রভাব বড় করে দেখার জন্য দুই দেশের সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিবিদ, কুটনীতিবিদ সবার কাছে ক্রিকেট বড় এক মাইক্রোস্কোপ!
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।