আন্তর্জাতিক
সিরিয়ার শরণার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ঝুঁকি নয়
(যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার অজস্র মানুষ এখন জীবনের ভয়ে দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছেন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয়। এ পরিস্থিতিতে বেশ কিছু দেশ এখন শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে চাইছে না, কারণ তারা শঙ্কিত। তারা ভয় পাচ্ছে, এই শরণার্থীরা একসময় জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে দেশগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এই আশঙ্কা কি আদৌ যৌক্তিক? রয়টার্সের ‘দ্য গ্রেট ডিবেট’ বিভাগে প্রকাশিত এই কলামে লেখক ডোরিস ক্যারিওন কিন্তু মোটেও তেমনটা মনে করেন না। লেখাটি রয়টার্সের অনলাইন সংস্করণে গতকাল, ১৫ সেপ্টেম্বর, প্রকাশিত হয়েছে।)
লেবানন, জর্ডান ও তুরস্কের বিভিন্ন শহরে আর ক্যাম্পে স্রোতের মতো আসছিলেন সিরিয়ার শরণার্থীরা। শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে। এই আশ্রয় ছেড়ে অন্য কোথাও এখন চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন এসব মানুষ, কারণ জীবন সেখানে জটিল হয়ে উঠেছে। আরো ভালোভাবে বললে, সেখানে জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়েছে তাঁদের জন্য। সাহায্য বা ত্রাণের প্রাদুর্ভাব, তার ওপরে ত্রাণের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। কোনো ধরনের কাজ মিলছে না তাঁদের। খাবার থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন উপকরণ কেনার জন্য অর্থ নেই তাঁদের কাছে। শিক্ষা বা অন্যান্য মৌলিক চাহিদার জোগান তো মিলছেই না। এ অবস্থায়, তাঁদের জীবনযাপন ওই স্থানগুলোয় আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সে সঙ্গে বেড়েছে স্থানীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ।
কিন্তু সিরিয়ার এই শরণার্থীদের নিরাপত্তা বিষয়ে হুমকি মনে করার কোনো কারণ নেই। সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর পতনোন্মুখ নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায় হিসেবে এই শরণার্থীদের বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় জনগণ, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকার জনগণ মনে করছেন, এই শরণার্থীরা তাঁদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক ধরনের হুমকি তৈরি করছে। দেশগুলোর দায়িত্বশীল সরকারও এই মতামতকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে অনবরত নিজেদের ন্যূনতম স্বাভাবিক চলাফেরায়ও বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন এই অসহায় শরণার্থীরা, যেমন একদম নিকটবর্তী স্থানে সংঘর্ষ চললেও ক্যাম্পের মধ্যেই শরণার্থীদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করছে তুরস্ক। অথচ এ সময় রীতিমতো মারা পড়ছেন শরণার্থীরা। লেবাননে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অর্ধেকের বেশি শরণার্থী, এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট জোসেফের সমীক্ষায়।
যাঁরা এই ভয় পাচ্ছেন যে এই শরণার্থীরা জঙ্গিগোষ্ঠী হয়ে উঠতে পারে, তাঁরা জর্ডান ও লেবাননে গেড়ে বসা ফিলিস্তিনি জঙ্গি গ্রুপের উদাহরণ দিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফ্রি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্ট পার্টির রাজনীতিবিদরা বারবারই তাঁদের দেশে গৃহযুদ্ধে ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সম্পৃক্ততার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন এবং বলছেন, একই ঘটনা এই সিরিয়ার শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
তবে ইতিহাস কিন্তু অন্য কথাও বলছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, শরণার্থীরা তাঁদের আশ্রয়দাতা দেশগুলোর নিরাপত্তার ওপরে কখনোই হুমকি হয়ে দাঁড়াননি। ইরাকি বা লেবানিজ শরণার্থীরা কখনোই জর্ডান বা সিরিয়ায় কোনো ধরনের সংঘাত সৃষ্টি করেননি। শরণার্থীদের এই সামান্য উপস্থিতিতে আসলে সেভাবে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি তৈরি হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সত্যি বলতে, সিরিয়ার এই শরণার্থীরা কেবল নিজেদের জীবনটা বাঁচাতে চায়, টিকে থাকতে চায়।
এর আগে যেসব শরণার্থী মিলিট্যান্ট গ্রুপ তৈরি করেছিলেন, তাঁরা সেটা করতে পেরেছিলেন বিভিন্ন উৎস ও শক্তি থেকে তাঁদের রসদ জোগানো হয়েছিল বলেই। শরণার্থীদের সশস্ত্র সেনাদল হয়ে ওঠা থেকে বিরত রাখা একটি বহুমাত্রিক বিষয়। এখানে কেবল শরণার্থীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিই একমাত্র প্রশ্ন নয়; সেখানে আঞ্চলিক শক্তির নীতিমালাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবস্থানগত দিক থেকে ইসরায়েলবিরোধী হওয়ায় মিসর ও সিরিয়া অতীতে বিভিন্ন সময় ফিলিস্তিনি মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে সহায়তা করেছে। নব্বইয়ের দশকে কৌশলগত কারণে তালেবান অধ্যুষিত অঞ্চলের আফগান শরণার্থীদের সহায়তা করেছিল পাকিস্তান, অবশ্যই অবস্থানগত কারণে ভারতবিরোধী হওয়া সেখানে ছিল মুখ্য কারণ। সুতরাং সিরিয়ার শরণার্থীদের তখনই মিলিট্যান্ট গ্রুপে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যখন এ রকম কোনো বহিঃশক্তি তাদের সেদিকে ধাবিত করবে, নচেৎ নয়। আর এখন সিরিয়ার যুদ্ধে সম্পৃক্ত আঞ্চলিক শক্তি এমন নীতিমালাই গ্রহণ করেছে যে, শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া দেশগুলোকে তারা মোটেও লড়াইয়ের ময়দান বানাবে না বা সেগুলোর বিষয়ে কোনো ধরনের কৌশলগত লক্ষ্যও তাদের নেই।
সিরিয়ার শরণার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করে আবারো সিরিয়ার যুদ্ধে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চিন্তা করে দেখার মতো। তবে সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোয় কিছু বিচ্ছিন্ন আক্রমণের বিষয়ে এই শরণার্থীরা নয়, স্থানীয়রাই সম্পৃক্ত। যেমন একজন তুর্কি জঙ্গি এ বছরের জুলাইয়ে ইসলামিক স্টেটের বোমাবর্ষণের ঘটনায় জড়িত ছিলেন। জানুয়ারি মাসে লেবাননের ত্রিপোলিতে বোমা হামলার জন্য দায়ী ছিলেন। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ সিরিয়ান শরণার্থী কিন্তু এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
শরণার্থী সংকট সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে অস্থিতিশীল তৈরি করতে পারে ভিন্নভাবে। সেটি হলো, শরণার্থীদের স্থান দেওয়া দেশগুলোর মানুষকে যদি শরণার্থীদের সাহায্য করার উপযোগী সহায়তা না দেওয়া হয়, তখন এমন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। শরণার্থীদের স্থান দেওয়ার জন্য, সাহায্য করার জন্য যে রসদ দরকার, তা অনেক দরিদ্র জর্ডান নাগরিকেরই নেই। সরকার এবং আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তা না পেলে এই স্বল্পোন্নত অঞ্চলের অবহেলিত মানুষেরা আচরণগত দিক থেকে বিপজ্জনক হয়ে উঠতেই পারেন।
শরণার্থীদের হুমকি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নগণ্য। এটা আপাতদৃষ্টিতে কেবলই অতিরঞ্জিত ভাবনা ছাড়া আর কিছু নয়। শরণার্থীদের ন্যূনতম সম্মান এবং সহায়তা না করা হলেই তাঁদের কেবল বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে, কারণ বিপদগ্রস্ত মানুষকে প্রত্যাখ্যান করা হলে বা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলে সে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতেই পারে। ইয়েমেনের সোমালিয়ান শরণার্থীদের বিষয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শরণার্থী স্কুলগুলোয় শিক্ষকদের কাছে অবাঞ্ছিত, অবহেলিত বা দুর্ব্যবহারের শিকার হতো, তারাই পরবর্তী সময়ে আল-কায়েদায় গিয়ে যোগ দিয়েছে। শরণার্থীদের প্রতি সহজ আচরণই বরং তাদের জঙ্গিগোষ্ঠী হয়ে ওঠার ঝুঁকি থেকে বিরত রাখে।
অসহায় শরণার্থীদের প্রতি এই আচরণ বা মনোভাব যদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পরিহার না করে, সে ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টোই হতে পারে বরং। যে বিষয়ের আশঙ্কা করে তারা শরণার্থীবিরোধী অবস্থান নিয়েছে, এ অবস্থানই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিরাপত্তাবিষয়ক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে।