টেস্ট ক্রিকেটের নতুন এক স্টেশন সিলেট
একশ চল্লিশের বেশি যার বয়স, সে তো বুড়ো। টেস্ট ক্রিকেট সত্যিই বুড়ো হতে শুরু করেছে বেশ আগে। তা ছাড়া ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির আবির্ভাবে টেস্ট ক্রিকেটের অবয়বে আরো বেশি বার্ধক্যের ছাপ। বিশেষ করে সদ্য তরুণদের কাছে। শুধু তরুণ নয়, নিখাদ ক্রিকেট প্রেম যাদের মন আর মননে, তাদের কাছেও সীমিত ওভারের ক্রিকেট এখন বাড়তি উদ্দীপনা। সাধারণ মানুষের কাছে ক্রিকেটের রোমাঞ্চ আর রোমহর্ষক লড়াই মানে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি। হোক সেটা ক্ষণস্থায়ী।
আর টেস্ট ক্রিকেট মানে? বুড়ো। যেখানে অনেক বেশি প্যাশনেট হতে হয়। একটা উইকেট পতনের উচ্ছ্বাস বা একটা ভাল বাউন্ডারি দেখার অনুভুতি প্রকাশ, সেও অপেক্ষা নামক এক শিল্পের অন্যরকম বহিঃপ্রকাশ। গ্যালারি থেকে হাততালি মানে বয়বৃদ্ধ কিছু মানুষের আভিজাত্য মেশানো দুটো হাতের মৃদ শব্দ। ইন্টারনেট-ফেসবুক-টুইটার- ইনস্টাগ্রামে সময়ের সাথে পালা দিয়ে ছুটে চলা তারুণ্য টেস্ট ক্রিকেটকে ‘বৃদ্ধ’ বলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের ক্রিকেট অলিন্দে সেই তারুণ্যেরই জয়জয়কার। দেশজ জনজীবনের সামনে ক্রিকেট মানে ওয়ানডে ম্যাচ জয়। টি-টিয়োন্টির রোমাঞ্চ।সত্যি বলতে কী— এই মুহূর্তের বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রান্তিক স্টেশন মানে বিশ্বকাপ। স্বপ্ন মানে বিশ্বকাপ জয়। অনেকের মনে বিশ্বাস জমাট বাধতে শুরু করেছে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জয়ের ক্ষমতা রাখে।
সেই রকম একটা সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট যাত্রায় সংযোজন হলো নতুন এক স্টেশন বা প্লাটফর্মের। আর সেই প্লাটফর্মের নাম- সিলেট। সেই প্লাটফর্ম থেকে টেস্ট ক্রিকেট নামক বুড়োকে সঙ্গী করে যাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে টেস্ট দিয়ে যাত্রা শুরু বাংলাদেশের অষ্টম টেস্ট ভেন্যুর। ইতিহাসের কোলে টেস্ট ক্রিকেট বুড়ো। আর ইতিহাসের পাতা ঘাটলে সিলেট ক্রিকেট বইয়ে খুব পুরোনো এক নাম। অবিভক্ত ভারতের ক্রিকেট ইতিহাস সাক্ষী দেয় সিলেটের ক্রিকেট ঐতিহ্যের। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেটা সমৃদ্ধ হয়নি। তা নিয়ে আক্ষেপ, হতাশা থাকারই কথা। সেই সব হতাশা-আক্ষেপ-দুঃখ ভুলে সিলেটের মানুষ এখন খুশিতে ভিজতে পারেন। গর্ব করে বলতে পারবেন; আরো অনেক কিছুর সঙ্গে তাদের একটা টেস্ট ভেন্যু আছে। আগামী প্রজন্ম হয়তো তাদের সেই ক্রিকেটীয় গর্বের সুচনাপর্ব হিসেবে খুঁজে পাবে, বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে টেস্ট ম্যাচটাকে। টেস্ট ক্রিকেটে ১৮ বছর পর করে আসার পর এ দেশের একটা জেনারেশনের কাছে মনে হতে পারে; ‘ধুর। একে তো টেস্ট ম্যাচ। তা আবারও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।’ ভাবলে আপনি ভাবতেই পারেন। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সাফল্যের মাস্তুল দাঁড়িয়ে আছে, এই জিম্বাবুয়েকে ঘিরে। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয় এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেটা চট্টগামে। যেখানে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের পতাকা উড়েছিল চট্টগ্রামের সেই এম এ আজিজ স্টেডিয়াম এখন ক্রিকেটের পরিত্যক্ত এক ভেন্যু। কিন্তু সিলেট অভিষেকেই অন্যরকমভাবে ঢুকে যেতে পারে ইতিহাসে। যদি সেখানে প্রথম টেস্টটা বাংলাদেশ জিততে পারে। তা হলে অতীতে যা ঘটেনি তাই ঘটবে সিলেটে। বাংলাদেশের আগের সাতটা টেস্ট ভেন্যুর কোনটিতে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে জিততে পারেনি। সিলেটে সেই প্রথা ভেঙে বাংলাদেশে বেরেয়ি আসতে পারলে, ওটাই হয়ে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের নতুন এক টার্ম অফ রেফারেন্স। সিলেটবাসীও বলতে পারবে, সিলেটে বাংলাদেশের যাত্রাই শুরু হয়েছিল জয় দিয়ে। বাংলাদেশের টেস্ট যাত্রায় ‘ সিলেট’ স্টেশন মানে প্লাটফর্ম নম্বর ‘আট’ একেবারে ইতিহাসে খোদাই করে রাখার উপলক্ষ এই ম্যাচ।
বাংলাদেশে এখন অনেক কিছুর উদ্বোধন হচ্ছে ডিজিটালি। মানে অনেক দূর থেকে। প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই দূরত্ব কমিয়ে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরা উদ্বোধন করেন। ভিডিও নির্ভর সেই উদ্বোধনে হয়তো ভিআইপিদের সময় বাঁচে। জ্বালানি বাঁচে। আম জনতার ভোগান্তি কমে। কিন্তু সেখানে আবেগও কমে যায়। সিলেট টেস্ট ভেন্যুর উদ্বোধন হবে যে ম্যাচ দিয়ে সেখানে ক্রিকেট আবেগের কমতি কিন্তু আপাত মনে হচ্ছে না। সেটা ক্রিকেট কর্মকর্তা থেকে মিডিয়ার উপস্থিতি। সব কিছুতে একটা নতুন হাওয়া বইছে। এ দেশের রাজনীতিতে যখন নতুন হাওয়া অনুভব করছে মানুষ। মিডিয়ায় যখন সেই খবর বড় বেশি জায়গা কেড়ে নিচ্ছে, তখন টেস্ট ভেন্যু হিসেবে সিলেটের আত্মপ্রকাশের খবরটা খুব বড় হয়ে সামনে আসতে পারছে না। কিন্তু ম্যাচটা জিতলে, অন্যরকম এক ইতিহাসকে আপনি আপাত দূরে রাখলেও মানুষের মনে কিন্তু গেথেঁ যাবে। আপাত ‘পজ’ মুডে থাকলেও সেটা প্লে-রিপ্লে মুডে যেতে কতক্ষণ। মানুষের মনোজগতে প্লে লেখা কী বোর্ডের উপর আঙুল রাখার দায়িত্বটা এখন মাহমুদউল্লাহ ও তাঁর টিমমেটদের।
‘সিলেট স্টেশন’ থেকে টেস্ট নামক ক্রিকেট বৃদ্ধের যাত্রা শুরু হলো। সিলেট থেকে দূরে দাঁড়িয়ে হুইসেল বাজিয়ে সেই ট্রেনের ছুটে চলার শব্দ শুনতে পাচ্ছে অনেকেই। টেস্টের এই শোভাযাত্রা কোন বিষণ্ণতায় শেষ হবে না, সেই প্রত্যাশাটুকু করলে, তাকে মোটেও বাড়াবাড়ি বলা যাবে না।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।