ঢাকা
নগর পরিষ্কারের দায় ও নগরপিতার কৈফিয়ত
দীর্ঘদিনের অভিভাবকহীন ঢাকাবাসী মাত্র কিছুদিন হলো দু-দুজন অভিভাবক পেয়েছেন। দুজনেই তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে জনগণকে মোটামুটি ওয়াকিবহাল করে ফেলেছেন। তাঁদের ‘হানিমুন পিরিয়ড’ চলতে চলতেই দুটো বড় চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়ায়—এক হলো হঠাৎ বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা আর অন্যটি ঈদুল আজহার বর্জ্য। প্রথমটি আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার ওপর কারো কোনো হাত নেই। তবে জলাবদ্ধতা নিয়ে দুজনই তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখালেও বাস্তবে তাল সামলাতে হিমশিম খেয়েছেন।
জনগণের তোপের মুখে ঝানু রাজনীতিবিদদের মতোই বলেছেন, দীর্ঘদিনের সমস্যা, এত অল্প সময়ে আলাউদ্দিনের জাদুর চেরাগের দৈত্যও সমাধান করতে পারবে না। তবে জনগণকে তাঁরা আশ্বাস দিলেন, আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই জলাবদ্ধতা দূর করার সামর্থ্য তাঁরা অর্জন করতে পারবেন।
জলাবদ্ধতার পর এলো পবিত্র ঈদুল আজহা। এটা আগে থেকেই সবার জানা, ঈদ আসছে, তাই আগেভাগে দুই মেয়র রীতিমতো যুদ্ধে নেমে পড়লেন। প্রায় প্রতিদিনই তাঁদের যুদ্ধ প্রস্তুতির নানা খবর মিডিয়াগুলোতে হুলস্থূল ফেলে দেয়। দুই মেয়র ঘোষণা দিলেন, নগরবাসীকে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দিতে হবে। সব ধরনের ব্যবস্থা থাকবে। জনগণ বিভ্রান্ত, কোরবানির পশু নিয়ে যাওয়া, কোরবানির পর মাংস যার যার বাড়িতে নিয়ে আসা, খোলা জায়গায় এতগুলো পশু কোরবানির পর দুস্থদের ভিড় সামলে মাংস বিতরণ—এত ধরনের ঝক্কি সামলাতে সিটি করপোরেশন তাদের কী ধরনের সহযোগিতা দেবে। জনগণ কতটা বিভ্রান্ত হয়েছেন, তার প্রমাণ মিলল ঈদের দিন। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে সাধারণ মানুষ যায়নি। আমরা যাঁরা মাঠের সংবাদকর্মী, দিনভর উত্তর-দক্ষিণের অলিগলি চষে বেড়ালাম। কেন গেলেন না তাঁরা? এই প্রশ্নের জবাব তাঁরা আমাদেরই খুঁজতে বললেন। অনেক জায়গাতেই মাথার ওপর কোনো ছাউনি নেই, খোলা মাঠ, নেই পানির ব্যবস্থা। দক্ষিণের কিছু কিছু স্থানে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দিতে দেখা যায়। পুরান ঢাকার লোকজন বরাবরই অনেকে মিলে এক জায়গায় কোরবানি দেন, পরিষ্কারও করেন সবাই মিলে। এটা তাঁদের সামাজিক ঐতিহ্য।
আর যেহেতু তাঁরা ঈদের দিন আর তার পরদিনও কোরবানি দেন, বাড়ির সামনে দিতেই পছন্দ করেন সেটা। আর অভিজাত উত্তরের বাসিন্দারা তো বাড়ির মূল ফটকের ভেতরে কোরবানি দিয়েছেন। তবে উত্তর কিংবা দক্ষিণ সব এলাকার বাসিন্দাই কিন্তু কোরবানির পর যাঁর যাঁর বাড়ির আঙিনা নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করেছেন। সিটি করপোরেশন থেকে কোরবানির বর্জ্য ফেলার পলিব্যাগ যাঁরা পেয়েছেন এবং যাঁরা পাননি, তাঁরাও বর্জ্য ফেলেছেন বাড়ির কাছের নির্ধারিত স্থানেই, যাতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সহজেই সেটা সংগ্রহ করতে পারেন। নগরবাসীর সচেতনতা এখন অনেকখানিই বেড়েছে, এই দাবি অন্তত আমরা এটিএন নিউজের কর্মীরা খুব ভালোভাবে বুঝেছি। কারণ, আমাদের স্টেশনের জন্মলগ্ন থেকেই আমরা প্রতি ঈদুল আজহায় ‘আমার শহর আমার ঢাকা’ শিরোনামে পুরো শহর চষে বেড়িয়ে জনগণকে সচেতনতার কাজটি করেছি, যাঁরা নিজ বাড়ির বর্জ্য পরিষ্কার করেছেন, তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছি টেলিভিশনের পর্দায়। যার প্রতিফলন আমরা তার পরের বছরই পেয়েছি, যখন দেখেছি ফি বছর উত্তরোত্তর বেড়েছে সচেতন মানুষের সংখ্যা।
অভিভাবকহীন ঢাকাবাসী যতদূর পেরেছে কোরবানির বর্জ্য অপসারণে এগিয়ে এসেছে। এবারে যখন দুই ভাগে বিভক্ত ঢাকার নগরপিতারা ঝাড়ু হাতে নামলেন কোরবানির বর্জ্য অপসারণে, তখন ঢাকাবাসী আরো উদ্যমী হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। কিন্তু নগরবাসীকে আশাহত হতে বেশি সময় পার করতে হয়নি। দেখা গেল, দুই মেয়রই যত না কাজ করলেন তার চেয়েও বেশি স্টান্টবাজি করলেন মিডিয়ায়। ঈদের দিন, তার পরদিন যখন আমরা নগরের বিভিন্ন এলাকায় গেলাম বর্জ্য অপসারণের কী অবস্থা দেখতে, নগরবাসী হতাশ হয়ে জানালেন, মেয়ররা বলছেন বটে, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলেছে অনেক ধীরগতিতে। রাজধানীর মগবাজার, মালিবাগ, সিদ্ধেশ্বরী, কমলাপুর, খিলগাঁও, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, সেগুনবাগিচা, আজিমপুর, সাতমসজিদ রোড, গ্রিন রোড, ফার্মগেট, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, আদাবর, মিরপুর, বাড্ডা, উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে ময়লার স্তূপ দেখা গেছে ঈদের তৃতীয় দিনও। অনেক জায়গায় ময়লা নেওয়া হলেও ব্লিচিং পাউডার দেওয়া হয়নি।
এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো, আমরা সংবাদকর্মীরা যেখানেই গিয়েছি, এলাকার কাউন্সিলর আর তাঁর সমর্থকদের বাধার মুখে এলাকাবাসী অনেকেই ভয়ে মুখ খোলেননি। অনেকে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে সাহস করেননি, তবে গোপনে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশন থেকে যে ব্যাগ বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে, সেটা স্থানীয় ক্ষমতাবানরা নাকি ৩০ টাকা দামে বিক্রি করেছেন এলাকাবাসীর কাছেই। অনেক এলাকায় বর্জ্য চোখের সামনে দেখে যখন আমরা সরাসরি তা টেলিভিশনে দেখিয়েছি, তারা এসে বারবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এই বলে যে, প্রধান সড়কের বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে, অলিগলিরগুলো খুব শিগগির করা হবে। এসব স্থানীয় প্রভাবশালীই এবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে গায়ের জোরে চামড়া সংগ্রহ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে না হয় আরেক দিন কথা বলব, আজ সীমাবদ্ধ থাকি বর্জ্য অপসারণ নিয়েই।
ঈদের তৃতীয় দিন দুই মেয়র সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের পিঠ নিজেরাই চাপড়ালেন। উত্তরের মেয়র আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বললেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট এলাকা সম্পর্কে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে বলেন, আমি ইন্সট্যান্ট ব্যবস্থা নেব।’ নির্দিষ্ট এলাকা সম্পর্কে অভিযোগ করা হলেও মেয়র জোর দাবি জানালেন, পুরো শহরে তিনি নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে ঘুরেছেন, কোথাও কোনো দুর্গন্ধ পাননি। এখন তিনি যদি এসি গাড়িতে কাচ তুলে ঘোরেন, সে ক্ষেত্রে গন্ধ পাওয়ার তো কোনো উপায় নেই। ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে ২৭ ঘণ্টায় শহর পরিষ্কার করে ফেলেছেন বলে নিজেই নিজেকে প্রশংসিত করলেন। তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজই বলে দিচ্ছিল, কোনো ধরনের সমালোচনা নেওয়ার অবস্থায় নেই তিনি।
মুদ্রার অপর পিঠও আমরা দেখলাম দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের সংবাদ সম্মেলনে। তিনিও নিজেকে সফল দাবি করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন। তবে দুজনেই চরম সত্যটা মেনে নিলেন, জনগণের সচেতনতা তাঁদের সাফল্য এনে দিয়েছে, যদিও তাঁদের আরো অনেক কিছু করার ছিল। আমরা বলছি না, দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় ১৭ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেননি। তা যদি না করতেন, তবে ঢাকার রাস্তায় বের হওয়াই অসম্ভব হতো। কিন্তু আমরা সংবাদকর্মীরা মেয়রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছি, যাতে তাঁরা স্থানীয় পাতিনেতাদের খেলার পুতুল না হয়ে যান। সমালোচনা গ্রহণ করার ধৈর্য যদি তাঁরা এখনই হারিয়ে ফেলেন, পথ চলতে হবে আরো বহুদূর। দুই মেয়রই অনেক বড় বড় পরিকল্পনার কথা বলতে পছন্দ করেন। এমনকি সরকারের সদয় দৃষ্টি তাঁদের ওপর আছে বলে তাঁরা নগরবাসীর জন্য যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন বলেও প্রচারণা করেন। কিন্তু কোরবানির বর্জ্য অপসারণের জন্য খুব সাধারণ উদ্যোগ কিংবা সিটি করপোরেশনের ডাম্পিংয়ের প্রতিকূলতা নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা যদি নিরপেক্ষ থেকে না নিতে পারেন, তাহলে সময়ে তার চরম মূল্য দিতে হবে।
দুই মেয়র এখনই এমপি-মন্ত্রীদের মতো বলতে শুরু করেছেন, এতদিনের ভুলত্রুটি সমস্যা একদিনে সমাধান সম্ভব নয়। সেটা যে সম্ভব নয়, সেটা সচেতন নাগরিকরা বোঝেন। তাহলে নির্বাচনী ইশতেহারে সেই সীমাবদ্ধতার কথাটুকু উল্লেখ করে দিলেই পারতেন। নগরপিতাদের বলব, রাস্তায় বেরোলে মাঝেমধ্যে গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালা খুলে চারপাশে একটু তাকান, বাতাসের গন্ধ নিন। চাটুকারদের মুখে ঝাল না খেয়ে নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রতি আস্থা রাখেন।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।