পুরাণ কথা
গরু এবং অধরা পবিত্রতা
আধুনিক ভারতে গরু হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রাণী। বর্তমান বিজেপি সরকারের শাসনামলে এটি আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে—ভারতের কেন্দ্র ও কিছু কিছু প্রদেশ এখন গো-মাংস নিষিদ্ধ এবং গো-হত্যা বন্ধ করতে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। অথচ বৈদিক যুগে বেদ অনুসারীরা নিয়ম করে গরু বলি দিতেন। ঋগবেদে ভগবানের উদ্দেশে, বিশেষ করে ভগবান ইন্দ্রকে উদ্দেশ করে গরুসহ অন্যান্য পশু বলি দেওয়ার কথা বহুবার উল্লেখ আছে। প্রাচীন ভারতে গরু জবাই করে খাওয়ার রীতি ছিল, এটা যাজ্ঞবল্ক্যের প্রিয় খাবার ছিল। তিনি কচি ষাঁড়ের মাংস পছন্দ করতেন বলে উল্লেখ আছে। বেদ-উত্তর বহু গ্রন্থে ভগবানের উদ্দেশে গরু বলি দেওয়ার রীতির কথা উল্লেখ আছে। খুব সম্ভবত কয়েক শতাব্দী ধরে এই রীতির প্রচলন ছিল।
মনুসংহিতায় মাংস ভক্ষণের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। বলা আছে, যেকোনো ধরনের গৃহপালিত পশুর দাঁত ওঠার পর তার মাংস রান্না করে খাওয়া যাবে। তবে মনুশাস্ত্রে উটের মাংস নিষিদ্ধ করা হয়েছে, গরুর নয়। পরিষ্কার করে বলা আছে, অতিথি আপ্যায়ন বা ভগবানের উদ্দেশ করে মাংস খাওয়া স্বর্গীয়বিধি। বৈদিক যুগের ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য প্রণীত ধর্মশাস্ত্র যাজ্ঞবল্ক্যেও বলা হচ্ছে যে, জ্ঞানী ব্রাহ্মণ অবশ্যই ছাগল কিংবা গরুর মাংস এবং সুস্বাদু খাবারের কদর্য বুঝবেন। এভাবেই সব শাস্ত্রে বেদ গ্রন্থে যে পশু বলির কথা বলা হচ্ছে, তার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। কেননা, গ্রন্থপ্রণেতারা মনে করছেন, পবিত্র বেদ গ্রন্থে যে পশু হত্যার কথা বলা হচ্ছে, তার একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে।
তবে কলিযুগে ব্রাহ্মণশাস্ত্রে এসে আবার মাংস ভক্ষণের মতো বেশ কিছু প্রাচীন প্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যে কারণে কলিযুগে এসে গরু বিক্রয় বন্ধ হয়ে এলো এবং ব্রাহ্মণের খাদ্যতালিকা থেকে গো-মাংস উঠে গেল। পরে ধর্মশাস্ত্রে গো-হত্যা পাপ বলে গণ্য হতে লাগল। ব্যাসদেবের কাহিনীতে বলা হলো, গো-হত্যাকারী অস্পৃশ্য, তার সঙ্গে যে কথা বলবে সেও পাপী বলে গণ্য হবে।
আগে গো-মাংস যেখানে ব্রাহ্মণদের বিশেষ রন্ধনপ্রণালিতে অন্তর্ভুক্ত থাকত, এখন সেখানে গো-মাংস কেবল অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের মাঝে বিশেষ খাদ্যরীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যযুগে গো-হত্যা হিন্দু ও মুসলমানের মাঝে মৌলিক পার্থক্য নিরূপণকারী ঘটনা বলে চিহ্নিত হতো। মুসলমানদের ‘গো-মাংস খাদক’ বলে নাম পড়ানোর প্রবণতা ছিল। ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা উত্তেজনা বিরাজ করত। সতেরোশ ও আঠারোশ শতকে যে কারণে দুটি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। হয়তো এ কারণেই সম্রাট আকবর বিশেষ কিছু দিবসে পশু হত্যা, বিশেষ করে গরু, নিরুৎসাহিত করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরও একই নীতি অনুসরণ করেন। নিশ্চিত করে দুই মুসলিম সম্রাটই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার উত্তেজনা মেটাতে চেয়েছিলেন। এমনকি সম্রাট বাবর পুত্র হুমায়ুনের উদ্দেশ করে লিখে যান, তিনি যেন গো-হত্যাকে নিরুৎসাহিত করেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, মধ্যযুগে ‘গরু’ ব্রাহ্মসমাজের আবেগপ্রবণ সাংস্কৃতিক অনুসর্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সতেরোশ শতকে মারাঠা শক্তি শিবাজির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সেটি আরো প্রকট হয়ে ওঠে। শিবাকে তো ব্রাহ্মসমাজ ও গরুর ত্রাণকর্তা হিসেবে ভাবা হতো। গো-হত্যায় অনুমোদন দেওয়ার জন্য হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায় মিলে যৌথভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নামে। একই সময়ে দায়ানন্দ সরস্বতী গরুতে মুসলমান বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ১৮৮০ ও ১৮৯০-এর দশকে বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মদদ দেন। গো-সংরক্ষণ আন্দোলনের মুখে দাঁড়িয়ে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোর উচ্চ আদালত গরুকে পবিত্র নয় বলে ঘোষণা দিলে সেটি আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে গরু একক হিন্দু জাতিসত্তার পরিচয় নিরূপণকারী প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবেই ভারতে গরুর ইতিহাস রহস্যের প্যাকেটে মোড়ানো। বৈদিক যুগে এবং বৈদিক-উত্তর যুগে যেখানে গরুর মাংস খাওয়া ধর্মীয় বিধান ছিল, সেখানে কলিযুগে এসে গো-হত্যা ও গো-মাংস ভক্ষণ শাস্ত্রমতে পাপ বলে গণ্য হচ্ছে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইতিহাস বিভাগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ : মোজাফফর হোসেন