ভারত সংকট
হিন্দু-আত্মপরিচয় ও গরুর গল্প
কয়েকশ বছর আগে, ভারতে রাজস্থানের মফস্বল শহরে ভার্মাল নামে এক স্থানীয় লোক বাস করতেন। তিনি প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন বলে মনে করা হয়। একদিন স্থানীয় মুসলিম কসাইরা শহরের কয়েকটি গরু জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল জবাই করার জন্য। ভার্মাল কসম খেয়েছিলেন যে, যদি কসাইরা গরু জবাই করার জন্য নিয়ে যায়, তবে তিনি তাঁর জীবন বাজি রেখে বাধা সৃষ্টি করবেন। প্রয়োজনে নিজের জীবন বলি দিয়ে হলেও গোমাতাদের বাঁচানোর চেষ্টা করবেন। কসাইরা তাঁর বাধা শোনেনি। সাহসী যোদ্ধা ভার্মাল তাঁর কথামতো নিজের জীবন দিয়ে দেন। ভার্মাল যেখানে আত্মোৎসর্গ করেন, সেখানে একটি পাথর দুর্গের মতো ঘটনার সাক্ষী হয়ে ছিল।
প্রায় ৫৫ বছর আগে, বাড়ি নির্মাণের সময় নির্মাণশ্রমিকরা খোঁড়াখুঁড়ি করতে করতে ভুলবশত পাথরটি তুলে ফেলেন। তারপর সেখানে ভার্মালের নামানুসারে একটি মঠ তৈরি করা হয়। মনে করা হয় যে, মানুষের রোগ-শোক থেকে মুক্ত করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে এই মঠের। সুখকর দাম্পত্য জীবনের জন্য নতুন বিবাহিত দম্পতিদের মঠ পরিদর্শন করা স্থানীয়দের কাছে প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভার্মাল আমার পিতৃকুলের পূর্বপুরুষ ছিলেন। তিনি স্থানীয় রাজার বিচারালয়ের একজন কর্মকর্তা ছিলেন বলে মনে করা হয়। আমি বছর দশেক আগে আমার দাদার সঙ্গে ওই মঠটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। যদি আমি দাদার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, তাঁর কাছে এই মঠের পেছনের যে গল্প তার অর্থ কী। এখন আফসোস হয়, কারণ তিনি আর জীবিত নেই। তবে ইতিহাসবিদ হিসেবে আমার জিজ্ঞাসাটা রয়ে গেছে। আমি নিজে কীভাবে গল্পটিকে গ্রহণ করি? এটা কি কেবলই গোখাদক মুসলমানদের নিষ্ঠুরতা এবং হিন্দুদের গোমাতাকে বাঁচানোর নায়কখচিত আরো একটি কাহিনী মাত্র? নাকি এর অন্য কোনো অর্থ আছে?
ভার্মালের এই গল্পটা হলো মধ্যযুগীয় রাজস্থানের ইতিহাস, যেখানে গরুকে সব ধরনের উপদ্রপ থেকে রক্ষা করা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের একটি অনুসঙ্গ ছিল। এই অঞ্চলে হিন্দু প্রতিপক্ষের হাত থেকে গরুকে রক্ষা করার বহু বীরত্বগাথার প্রচলন ছিল। ভার্মাল ছিলেন তেমনই এক ঘটনার নায়ক। তবে ভার্মালের কাহিনীতে যারা গরু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তারা ছিল মুসলমান। এখন প্রশ্ন হলো, আখ্যানে এই পরিবর্তনটা কখন থেকে শুরু হলো? কখন এবং কেন মুসলিম কসাইকে এই গল্পের চরিত্র বানানো হলো? এই স্মারক গল্পগুলোতে মুসলমান কসাইয়ের অন্তর্ভুক্তকরণের কারণ আমরা খুঁজে পাব ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ঔপনিবেশিক এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ইতিহাসের ভেতর। ইতিহাসবেত্তা চারু গুপ্ত জানাচ্ছেন, এই সময়ে গরু হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। গরুকে হিন্দু সম্প্রদায়ের গোমাতা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং জনপ্রিয় করে তোলার ভেতর দিয়ে গরুর শরীর হিন্দুত্ববাদের অখণ্ড পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়।
তখন উত্তর ভারতের অগ্রসরমান প্রকাশনা সংস্কৃতির কারণে পোস্টার, হ্যান্ডবিল, সংবাদপত্রের মাধ্যমে সর্বভারতে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মনে দ্রুতই এই বিশ্বাস পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নিল, কেননা এই গল্পগুলো কবিতা, ভজন, বিভিন্ন প্রকাশনা, ধর্মসভা, লোকমুখে এবং চিত্রের আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। গরু এবং গরুর দেহ মাতৃত্বের আরেক রূপ হয়ে দাঁড়াল এবং তার দুধ হয়ে উঠল জাতিসত্তার প্রধান পরিচায়ক। এই সকল কাহিনী ও চিত্রে ভিলেন ছিল মুসলমান কসাইরা, যারা গরুর মাংসের প্রতি লোভ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের এই পবিত্র প্রতীককে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। গোমাতাকে, যিনি তার দুগ্ধ দিয়ে হিন্দু-শরীরকে উজ্জীবিত ও স্বাস্থ্যবান করে তোলেন, তাকে আতঙ্কগ্রস্ত মাতা হিসেবে দাঁড় করানো হলো, যিনি তাঁর হিন্দু সন্তানদের জেগে ওঠার জন্য আহ্বান করছেন। বলছেন আত্মপরিচয় জাগিয়ে তুলে গোমাতার জীবন ও সম্মান রক্ষা করার কথা।
ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে যে কাহিনীগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল, ভার্মালের গল্প অনেকটা সে রকমই। পার্থক্য হলো, ভার্মাল মুসলমান কসাইদের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তা ছাড়া, প্রতিটা কাহিনীতে হিন্দুর আত্মচেতনা মুসলমানদের হাত থেকে গরুকে রক্ষা করার মধ্য দিয়ে জেগে উঠেছে। এই আত্মচেতনা হয়ে উঠেছে সনাতন পরিচয়ের প্রধান দিক। সেটিই আজ পর্যন্ত চলমান আছে- ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস থেকে গোমাংস ভক্ষণের সব উপলক্ষ ও উদাহরণ উঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা এখনো চলমান। এটাকে হিন্দু উঁচু জাতের পরিচয় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেহেতু নিচু জাতের এক অংশ এখনো গরুর মাংস খায়।
হিন্দু আত্মপরিচয়ের এই সংজ্ঞা দৈনন্দিন জীবন, সাহিত্য, সিনেমা, চিত্রকর্ম সবখানেই খুঁজে পাওয়া গেছে। এবং কিছু কূটবুদ্ধির মুসলমান ছিল, যাদের মাধ্যমে এই পরিচয়ের অপমান ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, যে কারণে হিন্দুদের সব সময় সজাগ থাকতে হতো। ভিশাম শাহনির গল্পে এই দ্বন্দের পরিচয় পাওয়া যায়। গল্পে এক মসজিদের দোরগোড়ায় একটি শূকরের শরীর দেখতে পেয়ে উত্তেজিত মুসলমানরা গরু হত্যা করে এর প্রতিশোধ নেয়। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত একটি রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেয়। শাহনি দেখিয়েছেন কীভাবে সেই দাঙ্গাকে ব্যবহার করে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার টিকেট হাসিল করছেন।
এই সার্বিক বিশ্লেষণ আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে দাদরির মোহাম্মদ আখলাকের ঘটনাটি। তাঁকে ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এখানেও দেখছি, হিন্দু গরুর রক্ষাকর্তা এবং মুসলমান গরুর মাংসখাদক পরিচয়ে আমাদের সামনে এসেছে। যে কারণে গুজব ছড়িয়ে জনগণকে উত্তেজিত করে ঠিক নির্বাচনের আগমুহূর্তে একটি চক্র রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আখলাকের মৃতদেহের মাধ্যমে জনগণকে উসকে দিয়ে কয়টি আসন লাভ করা সম্ভব?
কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে, ভার্মালের গল্পের মোরাল কি? আমার কাছে এই কাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় কীভাবে আমাদের জাতিগত পরিচয় এবং পারিবারিক ইতিহাস গড়ে ওঠে। এই কাহিনীগুলো আমাদের পরিচয় তৈরি করে এবং তার গাঠনিক রূপ দেয়। এই কাহিনীগুলোকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফেলে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমরা আজ যে পরিচয়ের সঙ্গে বেঁচে আছি সেটি ঐতিহাসিকভাবে তৈরি করা হয়েছে; এটি সনাতন কিছু না। এই গল্প থেকে এটাও পরিষ্কার হয় যে, এই আত্মগত পরিচয় ঐতিহাসিক জাতিগত দ্বন্দ্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখন সিদ্ধান্ত একান্তভাবে আমার হাতে : হয় আমি ওই দ্বান্দ্বিক পরিচয়কে আত্মগত করব এবং ভার্মালের যোগ্য উত্তরসূচি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরব, নয়তো তার উত্তরাধিকার সূত্র অস্বীকার করে তার ভূতের আঁচড় থেকে আমার আত্মগত পরিচয় আলাদা করে আখলাকের মৃত্যুতে শোক পালন করব। আমার বিশ্বাস, আমার দাদা বেঁচে থাকলে চাইতেন, আমি যেন দ্বিতীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়, কুন্দলি
দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন