বিশ্বকাপ ক্রিকেট
কার্ডিফে কি আজ আরেক মহাকাব্য?
ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ। সাত সমুদ্র তের নদীর ওই পাড়ের এই কার্ডিফ নামটি জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথার সাথে। কার্ডিফে টাফ নদীর পাড়ে একটি বাগান, নাম সোফিয়া গার্ডেন। লেডি সোফিয়া নগরবাসীর বিনোদনের জন্য একটি বাগান গড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী লেডি সোফিয়ার নামেই সেই বাগান গড়ে তোলেন। সেই বাগানের অংশ এই স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটির নামও সোফিয়া গার্ডেন। স্পন্সরদের চাপে বিভিন্ন সময়ে নাম বদলেছে বটে, তবে সোফিয়া গার্ডেনই সবার মুখে মুখে।
এই সোফিয়া গার্ডেনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা আবেগের, ভালোবাসার। সোফিয়া গার্ডেনে সবচেয়ে সুন্দর ফুলটির নাম মোহাম্মদ আশরাফুল। ফুটেছিল ২০০৫ সালে। আজ থেকে ১৪ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া ছিল অজেয়। আর তখন বাংলাদেশ ছিল ১১ নম্বর দল। ক্রিকেট-কুলীনরা তখন বাংলাদেশকে নিয়ে নাক সিটকাত। তখন এই আশরাফুল প্রায় একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন সেই অস্ট্রেলিয়াকে। সেটি ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের আগমনী গান। সোফিয়া গার্ডেনের সেই ফুলের সৌরভ ছড়িয়েছিল বিশ্বজুড়ে। মন্দ লোকের মুখে তালা দিয়ে দিয়েছিলেন আশরাফুল। সেই সোফিয়া গর্ডেনে আবার খেলতে নামে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। এবার প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। ২০১৭ সালের বাংলাদেশ অবশ্য অন্য দল। এখন আর বাংলাদেশকে নিয়ে নাক সিটকানোর কেউ নেই। বাংলাদেশ এখন সমানে সমান। কোনোদিন জেতে, কোনোদিন হারে। কিন্তু ২৬৬ রান তাড়া করতে নেমে ৩৩ রানে চার উইকেট পড়ে যাওয়ার পর নিউজিল্যান্ড শিবিরে জয়ের উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই উৎসবে পানি ঢেলে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে। সেই ম্যাচে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর ২২৪ রানের জুটিতে কিউই বধ; শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ক্রিকেট রূপকথারই অংশ। সোফিয়া গার্ডেন তাই বাংলাদেশের দ্বিতীয় হোমগ্রাউন্ড। এখানে বাংলাদেশ অপরাজেয়। আজ কি সোফিয়া গার্ডেনে ফুটবে নতুন কোনো ফুল? রচিত হবে নতুন কোনো মহাকাব্য?
যদিও আজকের ম্যাচের প্রতিপক্ষ এবারের বিশ্বকাপের টপ ফেবারিট ও স্বাগতিক ইংল্যান্ড। তবুও এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যা পারফরম্যান্স, তাতে তেমন কিছু অসম্ভব নয়। বড় দলগুলোকে সুবিধা দিতে ফিকচারে বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা ছিল। প্রথম তিন ম্যাচই ছিল বড় তিন দলের বিপক্ষে। দারুণ পারফরম্যান্স দিয়ে আইসিসির সেই ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছে। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েই দারুণ শুরু করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচে হারলেও যে অদম্য মনোবল দেখিয়েছে, তার প্রাপ্তিও কম নয়। নিউজিল্যান্ডের ম্যাচে পয়েন্ট হয়তো পায়নি, তবে যা পেয়েছে, তাতেই দল অনেক চাঙা।
তবে একটা ভালো দল ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। বাংলাদেশও নিশ্চয়ই নেবে। প্রথম ম্যাচে জয় পাওয়ায় অনেক দিক ঢেকে গেছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে আমাদের ফিল্ডিং বিশ্বকাপ মানের ছিল না। ফিল্ডিং যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটা বাংলাদেশ টের পেয়েছে দ্বিতীয় ম্যাচেই। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের পার্থক্য ছিল ফিল্ডিং। নিউজিল্যান্ড নিশ্ছিদ্র ফিল্ডিং দিয়ে অন্তত ৪০ রান বাঁচিয়েছে। আর ম্যাচ শেষে আমাদের আফসোস ছিল ৩০ রানের। সামনের দিনগুলোতে ভালো করতে হলে আমাদের ফিল্ডিং আরো অনেক ভালো হতে হবে। এটা রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে খেলার প্রতি, দেশের প্রতি ভালোবাসা; সদা সতর্ক থাকা, শারীরিকভাবে ফিট থাকা, মানসিকভাকে চাঙা থাকা ফিল্ডিংয়ে ভালো করার জন্য জরুরি।
প্রথম ম্যাচে জয় যেমন অনেক দুর্বলতা ঢেকে দিয়েছিল, দ্বিতীয় ম্যাচের পরাজয় তেমনি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অনেক সমস্যাকে সামনে এনেছে। নিউজিল্যান্ডের ম্যাচের পরাজয়ের পর অনেকে এমন গেল গেল রব তুলেছে, যেন বাংলাদেশ বিশ্বকাপে গেছে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হতে। বাংলাদেশের পরাজয়ে অনেকেরই মন খারাপ। খারাপ আমারও লেগেছে। তবে বিষণ্ণতা নেই। আমরা জেতার জন্য খেলেছি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফাইট করেছি। এ পরাজয়ে কোনো গ্লানি নেই, লজ্জা নেই। এ পরাজয়ের পরও আমাদের মাথা উঁচু। বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি, লড়াই কাকে বলে। বিষণ্ণতা না থাকলেও কিছু আফসোস আছে। বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান উইকেট দিয়ে এসেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ব্যাটিংটা যেমন পরিকল্পনামাফিক হয়েছে, নিউজিল্যান্ডের সাথে তেমন হয়নি। দলের মূল ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল এখনো ছন্দ পাননি। সৌম্য তাঁর কাজটা করার চেষ্টা করছেন। ১০ ওভারের জুজুটা কাটিয়ে দলকে একটা দারুণ শুরু এনে দিচ্ছেন। কিন্তু সৌম্যকে ৩০/৪০ রানে সন্তুষ্ট থাকলে হবে না; বড় ইনিংস খেলতে হবে।
প্রথম ম্যাচের মতো দ্বিতীয় ম্যাচেও সাকিব-মুশফিকের জুটিটা জমে যাচ্ছিল। মুশফিকের দুর্ভাগ্যজনক রানআউটে সেটা হয়নি। তবে এখানে আমি একটু সাকিবের অসতর্কতাকে দায়ী করব। নন-স্ট্রাইকিংয়ে থাকা ব্যাটসম্যানকে সদাসতর্ক থাকতে হয়। বল ছুড়ার সাথে সাথে অর্ধেক ক্রিজ পেরিয়ে যান। সেখানে মুশফিক কল করার পর নির্বিকার ছিলেন সাকিব। এটা বড্ড বেমানান লেগেছে। তবে দুই ম্যাচেই সাকিব প্রমাণ করেছেন, কেন তিনি বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। এবারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সেরা পারফরমার সাকিব আল হাসান। নিউজিল্যান্ডের ম্যাচে জিততে পারলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ সাকিবই হতেন। তবে আমি নিশ্চিত, বিশ্বকাপ আরো অনেকবার সাকিব ঝলক দেখবে।
দ্বিতীয় ম্যাচের আরেক আফসোস মাহমুদুল্লাহ। প্রথম ম্যাচের ফিনিশার দ্বিতীয় ম্যাচেই কেমন ম্লান। ৪১ বলে ২০ রান, ম্যাচের সময়ের দাবি মেটাতে পারেননি। তবে মাহমুদুল্লাহ পরীক্ষিত পারফরমার। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দুটি সেঞ্চুরি, দুটিই মাহমুদুল্লাহর। এবার মাহমুদুল্লাহ শুধু ব্যাটসম্যান, বোলিং করবেন না। দাবি জানাচ্ছি, তার মতো একজন জেনুইন ব্যাটসম্যানকে যেন আরো বেশি খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। অন্তত যেন পাঁচ নম্বরে নামানো হয়। আরেকটা কথা না বলে পারছি না। মিঠুন দুই ম্যাচেই নিজের অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। তার বদলে ইনফর্ম লিটন দাশকে দলে নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে লিটন দাশ কিপিং করে মুশফিকের চাপ কিছুটা কমাতে পারবেন। মুশফিক প্রসঙ্গ যখন এলোই, তখন আমাদের নিষ্ঠুরতার কথাও একটু বলা উচিত। নিউজিল্যান্ডের ম্যাচে দুটি টার্নিং পয়েন্ট। দুটিতেই মুশফিক। নিজে রানআউট হয়েছেন, উইলিয়ামসনের রানআউট মিস করেছেন। এই মিস করা নিয়ে এত কথা। মনে হচ্ছে যেন মুশফিকই ভিলেন। এটা ঠিক উইকেটকিপারের উইকেটের পেছনে থাকাই নিয়ম। মুশফিক ধরার চেষ্টা না করলেই নিশ্চিত রানআউট। পরে মুশফিক উইকেট উপড়ে দিলেও হতো। অনেক কিছুই হতে পারত। কিন্তু হয়নি। এটাই খেলা। মুশফিক তো রোবট নন যে, সবসসয় সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। মুশফিকের ডেসপারেট চেষ্টাটা তো দলের জন্যই। একটা রানআউট মিস করাতে আমরা মুশফিককে যেভাবে গালাগাল করেছি, তা অন্যায়, ভীষণ অন্যায়। টেকনিক্যালি মুশফিক দলের সেরা ব্যাটসম্যান। বছরের পর বছর দলকে সার্ভিস দিয়ে আসছেন। আজ একটা ভুলের জন্য তাঁর সব অবদান আমরা ভুলে যাব? আমি বরং লিটনের হাতে কিপিং গ্লাভস দিয়ে মুশফিকের কাছ থেকে নির্ভার ব্যাটিং চাইব আরো অনেকদিন। আমরা মুশফিকের প্রতি যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি নিষ্ঠুর মাশরাফির প্রতিও। দুই ম্যাচ মাশরাফির বোলিং ভালো হয়নি। ব্যস, তাতেই একদল মাশরাফির শেষ দেখে ফেলেছেন। এটাই মাশরাফির শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু তাই বলে বিশ্বকাপের মাঝে মাশরাফিকে বাদ দিয়ে রুবেলকে একাদশে নেওয়ার দাবিটা অমানবিক। হাঁটুতে সাতটা অপারেশন নিয়ে যে ছেলেটা দিনের পর দিন দলের জন্য খেলে গেল, এই তার প্রতিদান? একটা ভাঙাচোড়া দলকে মাশরাফি তাঁর নেতৃত্ব দিয়ে কেমন প্রাণবন্ত, একতাবদ্ধ করেছেন; তার কোনো দাম নেই বুঝি? শুধু ক্যাপ্টেনসির জন্যও মাশরাফি দলে থাকতে পারেন। তবে সাইফউদ্দিনের জায়গায় অভিজ্ঞ রুবেলকে আনলে বোলিংটা আরেকটু শক্ত হতে পারে।
আমরা কেমন দল, সেটা সবাইকে দেখানো হয়ে গেছে। এখন কাজ শুধু ম্যাচ বাই ম্যাচ আগানো।
বিশ্বকাপের আগে এমন একটা আওয়াজ উঠেছিল যে, এবার ইংল্যান্ড অজেয়। এবারের বিশ্বকাপ আয়োজন অর্থহীন। ইংল্যান্ড অবধারিত চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেই পাকিস্তান উড়তে থাকা ইংল্যান্ডকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের কাজ হলো শুইয়ে দেওয়া। আমাদের শুধু সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ে নিজেদের খেলাটা খেলতে হবে। ব্যাটিংটা করতে প্রথম ১০ ওভার দেখেশুনে, সাবধানে। আউট হবে, কিন্তু কেউ যেন উইকেট গিফট করে না আসে। সাকিব-মিরাজ-মুস্তাফিজ মিলে বোলিংটা টাইট রাখতে হবে। আর ফিল্ডিং করতে হবে নিশ্ছিদ্রভাবে। তাহলে আজ কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে বাংলাদেশ ফোটাতে পারে নতুন ফুল। কে ফোটাবেন?
ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্স নিয়ে আমার শঙ্কা নেই। আমার ভয় আইসিসিকে নিয়ে। ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড এই তিন মোড়লকে সুবিধা দিতে আইসিসি অনেক কিছু করে। ভারতকে সাত দিন পরে মাঠে নামার সুযোগ দিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়াকে জেতাতে নির্লজ্জ আম্পায়ারিং হয়েছে। তেমন কিছু না হলেই হয়। আমরা ১১ জন, ১১ জনের সাথেই খেলতে চাই।
বাংলাদেশ কেন, কোনো দলই সব ম্যাচ জিতবে না। খেলায় হারজিত থাকবেই। তবে আজ আমি বাংলাদেশের জয়ের সুবাস পাচ্ছি। প্রথম কারণ মাঠটা সোফিয়া গার্ডেন, তা ছাড়া সব মিলিয়ে বাংলাদেশ দারুণ ফর্মে আছে। ইংল্যান্ড যে অজেয় নয়, তাও প্রমাণিত। আজকের ম্যাচটা জিতে গেলে আমাদের সেমিফাইনাল যাত্রাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। সমস্যা হলো, দেড়শ বছরেরও বেশি পুরোনো এই সোফিয়া গার্ডেনে বাংলাদেশ আবার মহাকাব্যিক জয় ছাড়া মাঠ ছাড়ে না। আজ নিশ্চয়ই নতুন কোনো মহাকাব্য হবে, ফুটবে নতুন কোনো ফুল।
লেখক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক