এক্সট্রা কাভার
হকিতে স্বস্তি ফেরানোর পথেই অস্বস্তি
'সংকট কেটে গেল হকির', 'স্বস্তি ফিরল হকিতে', 'প্রাণ ফিরল হকি ক্যাম্পে'—বাক্যগুলো সবই খবরের শিরোনাম। কোনোটা টেলিভিশন সংবাদের, কোনোটা পত্রিকার। এর সবগুলোই চোখের জন্য তৃপ্তিদায়ক। শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের জন্য শ্রুতিমধুর। কিন্তু এর সবকিছুই আপাত ব্যাপার। আগামীতে মুদ্রার উল্টো পিঠও যে দেখতে হতে পারে, সেই শঙ্কাটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শঙ্কার যৌক্তিক কারণও খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। তবে কারণটা সরাসরি বলতে চান না অন্য আশঙ্কায়। এ মুহূর্তে অপ্রিয় সেই কথাগুলো বলে 'হকির গণশত্রু' হতে চাইবেন কে? তার চেয়ে চুপচাপ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকাকেই ভালো মনে করছেন তাঁরা। তবে হকির এই স্বস্তি ফেরা, প্রাণ ফেরা দিনে হকি অঙ্গনে শঙ্কার চোরা স্রোতও বইছে। সেই স্রোতের উৎস-স্বস্তি ফেরানোর প্রক্রিয়া! হকি ফেডারেশনের নির্বাচিত একজন সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে দেওয়া হলো! কারণ, তাঁকে চেয়ারে রেখে ঢাকার লিগ কিংবা টুর্নামেন্ট খেলতে চাননি গোটা পাঁচেক ক্লাব। কয়েক বছর ধরে 'না খেলার সংস্কৃতি'-কে দারুণভাবে লালন করেছেন তাঁরা। এবং বলতেই হবে, তাঁরা সফল। তাঁদের চাপের কাছে মাথা নত করে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অস্ত্রোপচার করা হলো একটা নির্বাচিত কমিটির ওপর! সেই অস্ত্রোপচারের ফলে সাধারণ সম্পাদক হয়ে গেলেন সহসভাপতি! আর সহসভাপতি হয়ে গেলেন সাধারণ সম্পাদক! সেটা হলো হকি ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সভায়! এ প্রক্রিয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল। জন্ম দিল আগামী দিনের জন্য অনেক শঙ্কারও।
হকিতে সংকটের মূল কারণ, জাতীয় দলের একজন সাবেক খেলোয়াড়কে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কয়েকটা ক্লাবের মেনে না নেওয়া। এবং সে কারণেই 'খেলব না' স্লোগান তুললেন তাঁরা। আওয়াজটাকে জোরালো করার জন্য তাতে সুর মেলালেন অনেকে। অবশেষে সেই আওয়াজে কেঁপে ওঠে চেয়ার বদল করলেন সাধারণ সম্পাদক আর সহসভাপতি! নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বছর দুয়েক দায়িত্ব পালনের পর নির্বাহী কিমিটির এক সভাশেষে বললেন, তিনি হকির স্বার্থে সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়লেন! প্রশ্ন, তাহলে এত দিন ও পদে ছিলেন কি হকির স্বার্থ পরিপন্হী কাজের জন্য? পদত্যাগী সাধারণ সম্পাদকের মুখ থেকে উত্তরটা শোনার কৌতূহল থেকেই যাচ্ছে। প্রশ্ন একটা নয়, একাধিক। হকির স্বার্থেই যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে আবার সহসভাপতির পদে থাকছেন কেন? প্রশ্ন নতুন সাধারণ সম্পাদকের কাছেও। সহসভাপতি হিসেবে আপনাকে নির্বাচিত করেছিলেন কাউন্সিলররা। কিন্তু এখন আপনি সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে বসার সময় সেই কাউন্সিলরদের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন নাকি? কাউন্সিলরদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে পদত্যাগ করে সাধারণ সম্পাদক ও সহসভাপতি পদের জন্য পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেন আপনারা। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরও যাঁরা গঠনতন্ত্রের বুকে ছুরি চালালেন, তাঁদের হাতে হকি নিরাপদ থাকবে, সেটা ভাবা যায় কি! তা হকি অঙ্গনে যতই এখন স্বস্তির বাতাস বয়ে যাক না কেন?
আরো অনেক প্রশ্ন উঠছে এখন। গোটা পাঁচেক ক্লাবকর্তাদের ব্যক্তিস্বার্থে যারা লিগ খেলল না এক মৌসুম, তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে? ব্যবস্থা যদি নেওয়া না হয়, তাহলে আগামীতে পাঁচের জায়গায় গোটা ছয়েক ক্লাব জোটবদ্ধ হয়ে যদি স্লোগান তোলে 'তিনি থাকলে আমরা খেলব না', তাহলে কী হবে? খেলা বন্ধ থাকবে। তার পর তিনিও পদত্যাগ করবেন। তার পরও সরকার বলবে, তারা ক্রীড়াঙ্গনেও গণতন্ত্র নিশ্চিত করেছে! আর হতাশ হয়ে অনেক নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঠে-ময়দানে বলে বেড়াবেন, 'হায়! ক্রীড়া গণতন্ত্র!'
গণতন্ত্রের কথা ভুলে যান। ন্যূনতম নিয়মকানুন, নীতি-নৈতিকতা কোনো কিছু মানা হলো না হকিকে স্বস্তির বাতাবরণ ফেরাতে। যা ঘটল এবং ঘটানো হলো, তা দেখে একজন সাবেক হকি খেলোয়াড় চিকিৎসাশাস্ত্রকে টেনে এনে দুর্দান্ত এক উদাহরণ দিয়েছেন। 'ফেইল্ড ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশন'! 'গ্রাফট রিজেকশন!' ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এ রকম, হকি ফেডারেশনের একটা অঙ্গ কেটে অন্য একটা অঙ্গের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হলো! যা কাজ না করার আশঙ্কাই বেশি।
তবে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার বিষয়, হকি ফেডারেশন যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, আগামীতে সেই অস্ত্র সেখানে আবার প্রয়োগ হতে পারে। সেটা কাল না হয় পরশু। একই অস্ত্র প্রয়োগ হতে পারে অন্যান্য ফেডারেশনেও।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র অনুসরণ না করা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টেলিভিশন।