আন্তর্জাতিক
ভারত চালাচ্ছে হিন্দু তালেবান
হিন্দু পুরান মতে, দেবতা বিষ্ণুর নানা অবতার। যাঁদের অনেকেই আবার মানুষরূপে এ ধরায় লীলা করে গেছেন। বিষ্ণুর এই অবতারদের সর্বশেষ সংস্করণটি সম্ভবত নরেন্দ্র মোদি। ভারতজুড়ে এখন তাঁর ছবিই সর্বাধিক প্রচারিত। আর সেই ছবিতে ‘ক্যারিশমাটিক’ এই নেতার ডান হাত এক হিতৈষী ভঙ্গিতে তোলা, যেন এই আশ্বাসভঙ্গি বয়ে আনবে ভারতের সৌভাগ্য।
কিন্তু তাঁর এই বরাভয়াকর ভঙ্গির আড়ালে যে এক ভয়ংকর ও উগ্র বাস্তবতাকে লুকিয়ে আছে তা হয়তো অনেকেই খেয়াল করছেন না। গত দেড় বছরে ‘বদলে যাওয়া’ ভারতের রূপরেখা জানাচ্ছে, দেশটিকে ক্রমবর্ধমানভাবে এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার ‘লক্ষ্যে’ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মোদি সরকার।
নির্বাচনী প্রচারণা ও ম্যান্ডেটে বিজেপি সরকারের এই ‘না বলা লক্ষ্যের’ কিছু বিপজ্জনক দিক আলোচনা করা দরকার। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাজারো বছরের বেশি সময় ধরে বংশপরম্পরায় ভারতে বসবাসকারী ৫০ কোটির বেশি ধর্মীয় এবং সামাজিক সংখ্যালঘুদের ভয়ংকর বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
হিন্দুধর্মের লেবাস পরিহিত একদল কর্মী আছে মোদির। যাদের প্রধান কাজ ‘ধর্মের চশমা’ পরে সমাজ ও প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর নজর রাখা। সেই কর্মীদের চোখে ‘পরমত সহিষ্ণুতার’ এই দেশে প্রধান অপরাধগুলো হলো ‘গরুর মাংস খাওয়া, হিন্দুধর্মে প্রচলিত বর্ণ ও জাত প্রথা না মানা এবং ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের’ প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’!
যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষ হয়তো ভারতীয় ক্রিকেট দলের পরাক্রম, দেশটির অর্থনৈতিক শক্তি, কাশ্মীরে নৃশংসতা অথবা সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে সংগঠিত ধর্ষণের ভয়ংকর গল্পগুলোর সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এগুলোর পেছনে যে ভারত চীনকে নকল করে চলছে সে গল্পটি অনেকেরই অজানা। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দুনিয়া ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষমতা, ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে এতটাই মগ্ন যে- দেশটিতে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনকে একেবারেই উপেক্ষো করে চলছে। ঠিক চীনের মতো করেই। ফলে, বাণিজ্যিক সম্ভাবনার নিচে চাপা পড়ছে মানবাধিকার। আর এভাবে পশ্চিমাবিশ্বও সমানভাবে হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচারের দায় বহন করতে চলেছে।
উদ্বেগের বিষয় এই, গত বছর ভারতের সরকার দেশে আসা সব ‘বিদেশি উদ্যোগ’ ও সাহায্যকে নিরুৎসাহিত করেছে। সরকারের দাবি, এসব অর্থায়নের ফলে জাতীয় অর্থনীতি বিভিন্ন পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা এবং বিদেশি তৎপরতার মাধ্যমে হুমকির সম্মুখীন হবে। গত বছরে এই বিদেশি তৎপরতার জুজু দেখিয়ে পুরো ভারতে প্রায় নয় হাজার বেসরকারি সংস্থার রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে। যার অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে মানবাধিকার সংস্থা।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর ‘রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ’ আনা শুরু হয়েছে। উদাহরণ দেখিয়ে বলা যায়, সমাজকর্মী তিস্তা সেতলবাদের কথা। তিনি ২০০২ সালে মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছিলেন। সম্প্রতি তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আটক করে পুলিশ।
এ ছাড়া নির্যাতিতের তালিকায় আছেন ছত্তিশগড়ের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা ও কলামলেখক সন্তোষ যাদব। ছত্তিশগড় সরকারের কিছু অনৈতিক কর্মসূচির ব্যাপারে লেখার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কয়েক সপ্তাহ আগে তামিলনাড়ুতে মদ্যপানবিষয়ক আইন পাসের পর বিষয়টি নিয়ে এক শিল্পী এটি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গান গেয়েছিলেন। আর এই গান গাওয়ার অপরাধে তাঁকেও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আটক করা হয়েছে।
ভারতের প্রকৃত অবস্থাটি এখন এই যে, গণতান্ত্রিকভাবে মানুষের ভোটে জেতা কোনো রাজনৈতিক দল কেন্দ্রে সরকার চালাচ্ছে না। দেশ চালাচ্ছে ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’ (আরএসএস)। এ ছাড়া ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সংস্কৃতকরণের’ নতুন পন্থা আসলে দেশটাকে ভারত থেকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ করার কৌশল।
গণতন্ত্রের ভাঙনের যে পিচ্ছিল ঢাল, এখন সম্ভবত তাতেই অবস্থান করছে ভারত। এই ভাঙনের একটি ভয়ংকর দিক হলো, সবকিছুর দলীয়করণ এবং রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ‘ভেতরের লোক’, ‘বাইরের লোক’ বিভেদ তৈরি করে দেওয়া; ভারতে যা করা হচ্ছে ‘সংখ্যালঘু’ নামে বিভেদ তৈরি করে। আর এই ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদের’ জোয়ারে পাত্তা পাচ্ছেন না মানবাধিকারকর্মীরাও। সরকারিভাবেও নিরুৎসাহী করা হচ্ছে তাঁদের।
এসব দেখে মনে হচ্ছে, আফগানিস্তানের উগ্রপন্থী তালেবান যেন ফিরে এসেছে ঐতিহ্যের দেশ ভারতে। আর সেই বার্তা মোদি সরকার জানান দিচ্ছে ভালোভাবেই। আমার এক লেখক বন্ধু সম্প্রতি আমাকে বলেছেন, ‘ভিন্নমতের লোকদের এখন ভারতে থাকাই মুশকিল।’ গত মাসে একশর বেশি ভারতীয় লেখক, অভিনয়শিল্পী দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে তাঁদের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন। অবশ্য তাতেও সরকারের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
ভারত বর্তমানে ১২৫ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ। বিপুল এই জনসংখ্যার দেশটিতে ৯৬.৫ কোটি হিন্দু আর ১৭ কোটি মুসলমানের বাস। আবহমান কাল ধরে ধর্মীয় রীতিনীতি অক্ষুণ্ণ রেখেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ভারতবাসী। কিন্তু আরএসএসের বর্তমান কর্মকাণ্ড সুস্পষ্টভাবেই ‘সংখ্যালঘু’ তত্ত্বকে উসকে বিভেদ তৈরি করে দিচ্ছে। যেমন বিভেদ তৈরি হয়েছিল নব্বই দশকে আফগানিস্তানে।
অনিশ কাপুর : অনিশ কাপুর ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ভাস্কর। এছাড়া তিনি যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার ‘ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া’ বিষয়ক নিয়মিত কলাম লেখক।