রাজধানী
নগর ধুঁকছে, নগরপিতারা কোথায়?
রাত যত গভীর হয়, ততটাই জীবন্ত হয়ে ওঠে নগরী। কর্মব্যস্ত মানুষের কোলাহল, যানবাহনের তীব্র শব্দের কোরাস চলতে থাকে ভোরের আলো ফোটার বেশকিছু সময় পরও। বেলা ৮টার পর দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে, যদিও পরিবর্তন হয় না কোলাহল আর ব্যস্ততার।পুরো ঢাকা শহর ঘুমালেও কখনোই যেন ঘুমায় না কারওয়ানবাজার। রাজধানীর সবচেয়ে বৃহত্তর এই পাইকারি কাঁচাবাজারকে ঘিরে পুরো এলাকাটিই এখন বিশাল বাণিজ্যিক কেন্দ্র।তবে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার কারণে পুরো ঢাকা শহরকে নিমেষেই অচল করে দেওয়ার মতো নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এই কারওয়ানবাজার। দখলদার ও লোভী ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকাটিও নগরবাসীর জন্য এক চরম দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
একসময় কারওয়ানবাজার এলাকাটি নিয়ে ছিল অনেক পরিকল্পনা।আশির দশকে কারওয়ানবাজার ও মতিঝিল দিলকুশাকে বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন ডিআইটি।মতিঝিল ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠতে পারলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে কারওয়ানবাজার বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ডিআইটি এই এলাকায় শতাধিক বাণিজ্যিক প্লট বরাদ্দ দিলেও ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে মাস্টার প্ল্যানে পরিবর্তন আনা হয়।বড় আকৃতির প্লটগুলো ছোট করে একাধিক ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যেও কিছু প্লট দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালে রাজউকের গড়ে তোলা মার্কেটসহ অন্যান্য স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিসিসির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই বক্তব্য রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদার।
নগর পরিকল্পনাবিদরাও কারওয়ানবাজারের বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠার প্রধান বাধা হিসেবে দেখেন আশির দশকের সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেই। তাঁরা বলেন, আশির দশকে কারওয়ানবাজারকে বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যত ১৯৮৭-৮৮ মধ্যেই ভেস্তে যায়। এ সময় মাস্টারপ্ল্যানে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের একাংশকে গেন্ডারিয়ায় পুনর্বাসন করা হয়। কারওয়ানবাজারের একাংশ পরিকল্পিত পরিসরে বাণিজ্যিক প্লটে সাজানো হলেও কাঁচাবাজারের কারণে একটা বিশাল অংশ উন্নয়নের বাইরে থেকে যায়। কাঁচাবাজার, ফলের আড়ৎ ও অপরিকল্পিত দোকানপাটের কারণে কারওয়ানবাজারের একটা বিশাল অংশ পরিকল্পনার আওতায় আনা সম্ভব হয় না। এতে কারওয়ানবাজারের বাণিজ্যিক মহাপরিকল্পনার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।
দীর্ঘ ৩০ বছরেও কারওয়ানবাজারের এলাকা বাণিজ্যিকীকরণের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। আমালাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজউক ও ডিসিসির টানাটানিতে বরাবরই এ মহাপরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে অপরিকল্পিতভাবে কারওয়ানবাজার তার পরিধি বৃদ্ধি করেছে।
দীর্ঘদিনের অভিভাবকহীন ঢাকা এ বছরের শুরুতে দুজন নগরপিতা পেয়েছে, তখন থেকেই কারওয়ানবাজারকে কেন্দ্র করে তাদের অনেক আশার বাণী শোনা যাচ্ছে। কারওয়ানবাজারের মূল অবস্থান ঢাকা উত্তরের ভাগে পড়লেও এর কারণে সৃষ্ট সমস্যায় ভুগতে হয় দক্ষিণের নগরপিতাকেও।তাই দুই পিতা কোমড় বেঁধে নেমেছেন কারওয়ানবাজারকে জাতে তুলতে। আমূল পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক পরিসরে উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা। এখান থেকে কাঁচামালের আড়ৎ সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে যাত্রাবাড়ী, মহাখালী ও আমিনবাজারে নির্মিত হচ্ছে বহুতল বিশিষ্ট কাঁচাবাজার ভবন। মহাখালীতে কাঁচাবাজার নির্মাণকাজের ৯০ ভাগ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। কারওয়ানবাজারে ৫তলা বিশিষ্টি কারপার্কিংসহ অত্যাধুনিক একাধিক ভবন নির্মাণ হবে। গাবতলীর আমিনবাজারে ১৩ একর জমির ওপর কাঁচাবাজার গড়ে তোলা হচ্ছে। ১২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫টি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। চারটি ভবনের প্রায় ৬০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মোট ১৮ হাজার ৮৪৪ বর্গমিটার এলাকায় ৫৪৯টি দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে।
মহাখালীতে জিওবির অর্থায়নে চারটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, মোট জমির পরিমাণ ৭ দশমিক ১৭ একর। ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ হাজার ৪৮৪ বর্গমিটারের এলাকায় ৩৬০টি দোকানের নির্মাণকাজ চলছে। যাত্রাবাড়ী এলাকায় ৫ দশমিক ২১ একর জমিতে আরো একটি কাঁচাবাজার নির্মাণ করা হচ্ছে। ২৯ হাজার ১৩১ বর্গমিটার এলাকায় ৮৯৫টি দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। যাত্রাবাড়ীতে ৬টি ভবনের নির্মাণ পরিকল্পনা থাকছে। আপাতত দুতলা বিশিষ্টি চারটি ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। প্রতিটি ভবনেরই বেইজমেন্ট ও গ্রাউন্ড ফ্লোর থাকবে।
পুরনো ঢাকার লালবাগে কাঁচাবাজার নির্মাণের জন্য কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটি ৫ দশমিক ১৭ একর জমি বরাদ্দ করে। ভূমি অধিগ্রহণের শেষে ৩ ধারা নোটিশও জারি করা হয়। স্থানীয় জনসাধারণের চাপের মুখে পরবর্তী সময়ে লালবাগে কাঁচাবাজার প্রকল্পটি স্থগতি হয়ে যায়।
কারওয়ানবাজারে কাঁচাবাজারসহ মাছ মাংস ও মুরগির বাজার রয়েছে। এই এলাকায় রাজউক ও ডিসিসির তালিকাভুক্ত আড়াইহাজার দোকানপাট রয়েছে। তালিকার বাইরে রয়েছে আরো হাজারো দোকানপাট। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে এসব দোকানপাট গড়ে তুলেছে। অবৈধ এসব দোকানপাটকে ঘিরে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে আর তা ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে— যখন যে ক্ষমতাসীন থাকছে তাদের নেতা-কর্মীরাই।
কারওয়ানবাজারেরর যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিপাতেই কারওয়ানবাজারের অবস্থা আরো অসহনীয় হয়ে ওঠে। রাত ১০টার পর থেকে শত শত ট্রাক কাঁচামাল নিয়ে কারওয়ানবাজারে ভিড় করে। রাস্তার ওপরে মালামাল ওঠানামা করা হচ্ছে।এর প্রভাব পড়ছে অন্যান্য এলাকাতেও।
ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তরের সূত্র মতে, কারওয়ানবাজার এলাকায় ৩১টি বহুতল ভবন রয়েছে। আছে আর্ন্তজাতিক মানের পাঁচ তারকা হোটেলও। কিন্তু কারপার্কিং খুবই অপ্রতুল। এই এলাকায় কমপক্ষে এক হাজার ৬০৬টি কার পার্কিংয়ের প্রয়োজন। আছে মাত্র ৫০৭টি। পার্কিং স্থানের অভাবে রাস্তার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
আর তেজগাঁও শিল্প এলাকার সমস্যার কথা বলতে গেলে মহাভারতের সমান দৈর্ঘ্যের হয়ে যাবে। সরকারের অনুমতি ও নিবন্ধন ছাড়াই রেলওয়ে ও পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের অর্থাৎ পিডব্লিউডির জায়গা দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে রাজধানীর শিল্পাঞ্চল তেজগাঁওয়ে।ট্রাকস্ট্যান্ডের বাইরেও ওই এলাকার প্রধান সড়ক ও এর আশপাশের সড়কগুলো দখল করে রাখা হয়েছে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ। এতে একদিকে যেমন রেলওয়ে ও পিডব্লিউডি হারাচ্ছে রাজস্ব, অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে ওঠায় এলাকাজুড়ে নিত্যদিনের অসহনীয় যানজট।যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের যোগসাজসেই এত বিশাল জায়গা দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছে। রেলওয়ের এই বিশাল নৈরাজ্যে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশাল মাদক সাম্রাজ্য এবং চুরি-ছিনতাই ও অসামাজিক কার্যকলাপের অভয়ারণ্য।যদিও নিবন্ধন ছাড়া অবৈধভাবে রেলওয়ের জায়াগা দখল প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান সমিতির সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য হলো, সরকারের অনুমতি নেওয়া হয়েছে ২০০১ সালে, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদার কাছ থেকে, তবে এরপর থেকে যত সরকার এসেছে এই ট্রাকস্ট্যান্ড সরাতে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা বেশি আগ্রহ দেখায়নি। বর্তমান সরকারের রেল, যোগাযোগ এবং শ্রমিক নেতা নৌমন্ত্রী মিলে অনেক কঠোর আলটিমেটাম দিয়েও এক চুল পরিমাণ কিছু নড়াতে পারেননি।এমনকি ঢাকা উত্তরের স্মার্ট মেয়র নিজের বিশাল বাহিনী নিয়ে ট্রাকস্ট্যান্ড গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দিয়ে ঘন্টাখানেক সেখানে বসে থেকে খালি হাতে ফিরে আসেন। তিনি ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়ে এসেছেন। দেখা যাক, কী হয়!
এদিকে দক্ষিণের নগরপিতাও যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন গুলিস্তানের হকার উচ্ছেদে।আসলে পুরো ঢাকা শহরটাই এখন নৈরাজ্যের স্বর্গরাজ্য। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং এই শহরের খুব স্বাভাবিক চিত্র। অথচ এরজন্য পুরো সপ্তাহে দিনভর কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে! অফিসপাড়ায় নেই কোনো নিয়মতান্ত্রিক পার্কিং সিস্টেম, বেশির ভাগ বিল্ডিংয়েই পার্কিংয়ের সুযোগ নেই। নিউমার্কেট কিংবা বসুন্ধরা, যমুনা ফিউচার পার্কের মতো বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সগুলোর সামনে পার্কিংয়ের কোনো বালাই নেই। হাতিরপুল এলাকায় ইস্টার্ন প্লাজার আশপাশে অসংখ্য টাইলসের শোরুম। সরু এই রাস্তার দুই পাশেই যেভাবে পিকআপগুলো দিনের ব্যস্ত সময়েও পার্কিং করে রাখা হয় তাতে জ্যাম ছড়িয়ে পড়ে ফার্মগেট পর্যন্ত।আক্ষরিক অর্থেই আসলে এসব দেখার কেউই নেই। দেখবে কারা?কারওয়ানবাজার ও বাংলামোটর এলাকায় সকাল-বিকেল কিংবা রাতে কিছুটা সময় ধৈর্য নিয়ে দাঁড়ালেই দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ এবং আনসার সদস্যরা কিছু টাকার বিনিময়ে ভ্যান-রিকশাচালকদের নিয়ম ভেঙ্গে গাড়ি চালাতে দিচ্ছে। এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দুর্নীতি কোথায় নেই, রাজপথ থেকে লাল দালান পর্যন্ত, সবজায়গাতেই দুর্নীতি এখন চ্যাম্পিয়ন! সবচেয়ে বড় দুর্নীতির উদাহরণ তো হাতিরঝিলের মাঝখানে বিজিএমইএ ভবন!
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।