প্রতিক্রিয়া
আমির ও শাহরুখ, তোমাদের ধন্যবাদ
ভারতে চলছে অসহিষ্ণুতা নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকারাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নিয়েছেন। বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান আগেই কথা বলেছিলেন, সম্প্রতি আমির খানের মন্তব্যে বিতর্ক আরো চরমে উঠেছে। এই বিষয়ে ভারতীয় রাজনৈতিক দল সিপিআইয়ের (এম) পলিটব্যুরোর সদস্য এবং রাজ্যসভার সাবেক সদস্য ব্রিন্দা কারাত দিয়েছেন সুদীর্ঘ মতামত। আজ ২৫ নভেম্বর এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।
আমি জানি না বিজেপি কেন ভারতকে একটি ‘সহিষ্ণু রাষ্ট্র’ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য লম্বাচওড়া বক্তৃতা দেওয়া এতটা জরুরি মনে করছে। এর কারণ কি এটা যে তারা যা বলছে তা নিজেরাই বুঝতে পারছে না, নাকি তাদের ঔদ্ধত্য, নাকি হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেডের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনাকে তারা পুরো ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনা হিসেবে গণ্য করে? সে জন্যেই কি ক্রমশ বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সচেতনতাকে তারা দেশবিরোধিতার শামিল বলে আখ্যা দিচ্ছে?
জনগণ পারিপার্শ্বিকভাবে অসহিষ্ণুতা বেড়ে চলার বিষয়ে নিজেদের সচেতনতা প্রকাশ করছে। এটি কখনোই ভারতকে তিরস্কার করা নয়, বরং ভারতকে সেই সব স্বেচ্ছাচারী শক্তি থেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা যা দেশটিকে অসহিষ্ণু করে তুলছে।
ভারত আসলে কেমন দেশ আর কিছু মানুষ একে কী রকম দেখতে চায়, এই দুয়ের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। ভারতের এমন এক সহিষ্ণু দেশ হওয়ার কথা ছিল, যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা, ভিন্ন ভিন্ন জীবনধারা, বিভিন্ন খাবার ও খাদ্যাভ্যাস, নানা পোশাকআশাক আর রীতিনীতির চল আছে। ধর্মনিরপেক্ষ, স্থিতিশীল এবং সমানাধিকার বজায় রাখা একটি রাষ্ট্রের জন্য এমনই দরকার। এই চিন্তা অবশ্য পুরোপুরি বাস্তবে কবে রূপ নেবে তা বড় প্রশ্নের ব্যাপার, তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু নিজের দেশকে এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সহিষ্ণু রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করেছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে, যা আগে তিনি ব্রিটিশ গণমাধ্যমের কাছেও করেছেন!
আপনি ঠিকই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী, অবশ্যই ভারত একটি সহিষ্ণু রাষ্ট্র, কিন্তু হিন্দুত্ববাদের নামে যে মানুষগুলো রাজনৈতিকভাবে সুযোগসুবিধা ভোগ করছে-তারা মোটেও সহিষ্ণু নয়। আর এই লোকগুলোর তো দিনের পর দিন ঘৃণা আর উসকানি ছড়িয়ে দেওয়ার অনুমোদনও রয়েছে, যা তারা আপনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিয়মিত করে চলছে।
এই হিন্দুত্ববাদী নেতাদের সাম্প্রতিক লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন আমির খান। তিনি নিজের মনের কথা বলেছেন, স্ত্রী কিরণ রাওয়ের কথা বলেছেন, যিনি মেধাবৃত্তিক উচ্চতায় আমিরেরই মতো। তাঁরা আসলে ধার্মিক মানুষ, কী ধার্মিক নন, এটা একান্তই তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও তাঁরা একে অন্যকে ভালবেসেছেন, বিয়ে করেছেন, তাঁদের একটি সন্তানও রয়েছে। আমিরের মতো একজন ব্যক্তিত্ব যখন চলমান পরিস্থিতি নিয়ে নিজের সচেতন মতামত জানান, নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠেন, সরকারের উচিত ছিল বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। অথচ তা না করে সরকারের মুখপাত্ররা বিষয়টিকে ‘নেতিবাচক’ বলছেন, ‘ভক্তদের প্রতি অকৃতজ্ঞ আচরণ’ হিসেবে একে চিহ্নিত করছেন।
এটি সরকারের তীব্র ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং সরকারদলীয় মুখপাত্রদের তাচ্ছিল্যের বহিঃপ্রকাশ। সামাজিক মাধ্যমে বিষয়গুলো নিয়ে নিন্দা হচ্ছে, বিভিন্ন ট্রল হচ্ছে। এখান থেকেই বোঝা যায় যে দেশের অসহিষ্ণু পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ জনগণও চিন্তিত, অথচ সরকার নয়!
নয়নতারা সেহগল যখন প্রতিবাদ করলেন, তখন তাঁকে ‘রাজবংশের সদস্য’ হিসেবে খোঁটা দেওয়া হলো, সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় কয়েকজন লেখক যখন নিজেদের পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন, তাঁদের ওপরও মার্কা মেরে দেওয়া হলো! এমনকি সরকারকে যখন ১০৭ জন বিজ্ঞানী একটি উন্মুক্ত চিঠি পাঠালেন, তাঁদেরও এতটুকু পাত্তা দেওয়া হয়নি। ইতিহাসবিদরা গলা তোলার পর তাঁদেরকে আখ্যা দেওয়া হলো ‘কম্যুনিস্ট’ হিসেবে। মূল কথা হলো, যখনই কোনো বুদ্ধিজীবী মহল বা ব্যক্তিত্ব এই বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, তখনই সরকার তাদেরকে আঘাত করছে এবং সেই সঙ্গে মূল বিষয়টিকে চাপা দিচ্ছে।
এটি এই মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যে- এক জোড়া পুরুষ ও নারী একে অন্যকে ভালোবাসছে এবং তাদের একজন হিন্দু ও আরেকজন মুসলমান-এই বিষয়টিকে ঘৃণার চোখে দেখছে উগ্রবাদীরা। এই ঘৃণা তারা আক্রমণের রূপে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনুপম খের এবং সরকারদলীয় অন্য সমর্থকরা এই বিষয়গুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। মনে রাখা দরকার যে- ক্যাবিনেট আর পার্লামেন্টের সদস্যরা, যাঁরা এই বিষয়গুলো নিয়ে মন্তব্য করছেন; তাঁরা কিন্তু মোটেও বিচ্ছিন্ন নন, বরং ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারি শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন।
এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যে গোহত্যা, গোমাংস ভক্ষণ এবং সংরক্ষণের একটি বানানো গল্পের ভিত্তিতে একজন বৃদ্ধ মুসলিম ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এটিকেও বলা হয়েছে ‘দুর্ঘটনা’। তাহলে গরুর ছবি দিয়ে বিহার নির্বাচনের সময় বিজেপি যে বিজ্ঞাপনে সমস্ত পত্রিকা ছেয়ে দিয়েছিল, সেটা কি উদ্দেশ্যমূলক ছিল না? তারা তো প্রচার এভাবেই করেছে যে গোহত্যা ঘটলেই ‘হিন্দুত্ব’র ভয়াবহ অবমাননা হবে! গোহত্যাবিরোধী প্রচারণার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুসলমানদের হীন পথে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা। কাজেই এই ঘটনাটিকে কোনো অবস্থাতেই ‘বিচ্ছিন্ন’ বা ‘দুর্ঘটনা’ বলার সুযোগ থাকছে না।
এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যে যখন বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবাদীরা যখন হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেডের ছড়িয়ে দেওয়া উদ্ভট কিছু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখছেন, তাঁরা টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। যখন কমরেড পানসারেকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে কুলবার্গিকে, টার্গেট করা হয়েছে পুরুমল মুরুগানকে, গিরিশ কারনাডকে হুমকি দেওয়া হয়েছে কারণ তিনি টিপু সুলতানের ইতিহাসে একটি ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন এই বিষয়গুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এটাই কাম্য যে তিনি সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার করবেন এবং নিজের দলকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বলবেন যাতে করে এসব হুমকি, নির্যাতন, কটূক্তি, সহিংসতা বন্ধ হয়-বিশেষ করে ‘সংঘ পরিবার’-এর সম্পৃক্ততা কাজে লাগিয়ে যারা এসব করে চলছে তাদের তরফ থেকে।
সেই সঙ্গে, আমির খান ও শাহরুখ খানকে স্যালুট। চড়া মাশুল গুনতে হবে জেনেও তাঁরা সত্য কথাটা বলেছেন। এ জন্য সম্মান তাঁদের প্রাপ্য।