বাংলাদেশ
স্বস্তির জন্য বড্ড বেশি নীরবতা
[রামচন্দ্র গুহ প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও লেখক। দ্য টেলিগ্রাফ ও হিন্দুস্তান টাইমস-এ নিয়মিত কলাম লেখেন। ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ টেলিগ্রাফে বাংলাদেশ নিয়ে একটি কলাম লিখেছেন। ইংরেজিতে লেখা কলামটি পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন আজহারুল ইসলাম]
১৯৭০ ও ’৮০-র দশকে জনসংখ্যাধিক্যের কারণে দারিদ্র্যে নিপতিত হওয়া দেশগুলোর উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো বাংলাদেশকে। ‘তলাবিহীন ঝু্ড়ি’র প্রবাদ ছিল, যেখানে পশ্চিমের দেশগুলো থেকে গম আসত। এমন পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী জীববিজ্ঞানী গ্যারেট হার্ডিন বলেছিলেন, বাংলাদেশে সাহায্য পাঠানো বন্ধ করা উচিত এবং তাদের মরতে দেওয়া উচিত, সম্ভবত তারা সেটারই যোগ্য।
ভালোই হয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমস-এর ওই নিবন্ধ বাংলাদেশের সাধারণ নারী-পুরুষ (আম আদমি ও আম আওরাত) পড়েনি। জীববিজ্ঞানী কিংবা পরিবেশবাদীদের পূর্বাভাসও তারা জানেনি। তারা কেবল স্বাধীন হওয়া জাতি গঠনে নিয়োজিত হয়েছিল।
২৮ নভেম্বর দ্য টেলিগ্রাফে লেখা এক কলামে আমি বলেছিলাম, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশিরা বিস্ময়কর কৃতিত্ব দেখিয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে তারা উল্লেখযোগ্য অর্জন করেছে। স্বাস্থ্য ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভারতের চেয়েও উন্নতি করেছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছে।
বিরূপ পরিস্থিতি (গৃহযুদ্ধ, ঘূর্ণিঝড় ও সাম্প্রদায়িকতা) সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি উল্লেখযোগ্য। এরপরও উদ্বেগের কারণ, রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থবিরতা।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে যথাযথ রাজনৈতিক ক্ষেত্র না দেওয়ায় বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে, সেই আওয়ামী লীগই বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতি বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সব সময়ই সংকটময় ছিল। আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ নেতা (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৯৭১ সালে নতুন জাতির সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৫ সালের শুরুতে, একদলীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মুজিব (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। ওই সময় বিরোধীদলীয় অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন মহলে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে, জুনিয়র অফিসারদের হাতে খুন হন মুজিব। আর (জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন) সিনিয়র অফিসাররা সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেন।
জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। জিয়া হত্যার পর একই বছরে ইসলামপন্থী জেনারেল এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় বসেন। প্রায় এক দশক ক্ষমতায় ছিলেন এরশাদ। এরপর দীর্ঘ অস্থিরতা ও বিক্ষোভের পর অবশেষে ১৯৯১ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বিধবা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জয়ী হয়। পাঁচ বছর পর তিনি (খালেদা জিয়া) ভোটে হারার পর মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে। দলটি ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। এরপর ক্ষমতায় বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আরোহণ করেন শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ।
২০১৩ সালে নির্বাচনের আগে বিএনপি নির্দলীয় ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেটি নাকচ করে দেয়। ফলে বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে। এর পর থেকেই সরকার, সংসদ ও প্রশাসনের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের।
সর্বশেষ ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমর্থনকারী এবং সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকা লোকজনের বিচারে উঠেপড়ে লাগেন। নভেম্বরে আমার ঢাকায় অবস্থানকালে দুজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়। এদের একজন (আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ) জামায়াতে ইসলামীর (যে দলটি বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল) নেতা। অন্যজন ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানপন্থী একজন রাজনীতিকের ছেলে (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী), যিনি খালেদা জিয়া ও বিএনপির উপদেষ্টা ছিলেন।
এ দুজনকে ঝোলানোর সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। এর একদিন পর দীর্ঘ প্রবাসযাপন শেষে খালেদা জিয়া দেশে ফেরেন। এরও একদিন পর, জামায়াত দেশব্যাপী হরতাল ডাকে।
অন্য সময় হলে বিএনপির হাজার হাজার সমর্থক তাদের নেতাদের পাশে দাঁড়াত। জামায়াতের হরতালেও জনমানবশূন্য রাস্তা কিংবা দোকানপাট বন্ধ পাওয়া যেত। কিন্তু এবার দুটি ঘটনাতেই ঢাকার জীবনযাপনে বড় ধরনের কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। দুই দিনেই, আমি শহরে ঘুরেছি, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেছি, ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেছি আর রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী (বিজিবি) ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় আওয়ামী লীগ সরকার দৃশ্যত সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেয়। ভিন্নমতের কোনো সুযোগ ছিল না বা দেওয়া হয়নি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভয়াবহ অপরাধের বিষয় প্রশ্নাতীত। তাদের স্থানীয় সহযোগী ছিল। এরপরও সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া বিচার (মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার) এবং ফাঁসি দেওয়া নিয়ে মারাত্মক প্রশ্ন রয়ে গেছে। এর চেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ও সমাজে তাদের আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ গভীর করতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করছে। তারা অবশ্যই সংসদে বিরোধী দল না থাকার সুবিধা পেয়েছে। এখন পর্যন্ত যেসব সাংবাদিক বিচার প্রক্রিয়ার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। শিক্ষাবিদদের মধ্যে যাঁরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তাঁরাও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে জাতির প্রতিষ্ঠাতা নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে। অনেক ভারতীয় যেখানে গান্ধীকে গান্ধী বলতে পারে (এবং বলেন), সেখানে মুজিবকে মুজিব হিসেবে বলা হয়েছে, এমন প্রকাশ্য নজির খুবই কম। তিনি বঙ্গবন্ধু হিসেবেই রয়েছেন।
মুজিবকে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখে পাকিস্তানিরা। তারপর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ঘনিষ্ঠ লোকজনের বলয়ের মধ্যেই তাঁকে হত্যা করা হয়। অংশত এবং সম্ভবত বাবার প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা থেকেই শেখ হাসিনার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ। এখনো পর্যন্ত এটা বলা যায় যে, যে উপায়ে তাঁর (শেখ হাসিনা) প্রশাসন বর্তমানে চলেছে, তা তাঁর বাবার সবচেয়ে বাজে সময়ের কথা (১৯৭৫ সালের শুরুর মাসগুলোতে সংবিধান সংশোধন করে বিরোধীদের দূরে সরিয়ে রেখে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে) মনে করিয়ে দেয়।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধী গোষ্ঠী বিএনপি ও জামায়াত পরাজিত এবং মানসিকভাবে পর্যুদস্ত। এরই মধ্যে, পারস্পরিক সুবিধা নিতে প্রশাসন সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক রকম জোট করেছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে সব সময়কার ক্রীড়নক সেনাবাহিনীকে সম্প্রতি বিভিন্ন স্থাপনা এবং সড়ক তৈরিতে লোভনীয় ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর বর্ধিষ্ণু ক্ষমতা আনুপাতিক হারে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করা সম্প্রতি একটি পত্রিকাকে বিজ্ঞাপন না দিতে টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলোকে নিষেধ করেছে সেনাবাহিনী।
শেখ হাসিনা ও তাঁর উপদেষ্টারা নিজেদের একদলীয় সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সব করেছে যদিও তারা ব্যালটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। নাৎসিরা ১২ বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল, নিজেদের প্রতিজ্ঞা এবং সমর্থকদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, হাজার বছর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। দক্ষিণ এশিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এবং শ্রীলঙ্কার ফ্রিডম পার্টি একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ দলগুলোর কোনোটিই কয়েক বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
একদলীয় রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু ওই একদল ক্ষমতায় থাকার সময় রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠতে পারে। ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেস আমলাতন্ত্র এবং বিচারব্যবস্থা এমনভাবে নষ্ট করে গিয়েছিল, এর পর থেকে এগুলো আর কখনো পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ফিরে পায়নি কিংবা কার্যকর হতে পারেনি। ভুট্টো ও পিপিপির অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। একই সঙ্গে দেশটিতে ইসলামী মৌলবাদ বেড়েছে। মাহিন্দা রাজপক্ষে ও শ্রীলঙ্কার ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফ) সিংহলি উগ্রবাদকে উসকেছে। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক চর্চাকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যমসহ অন্য মাধ্যমগুলোকে দমিয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যে একটা জিনিস লেখা আছে। সেটা হলো শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের পতন। সেটা প্রত্যাশার চেয়েও আগে ঘটবে। বিরোধী মত প্রকাশের পথগুলো বন্ধ হওয়ায়, আশ্রয় হিসেবে সমাজের একটা অংশ ইসলামপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীতে যোগ দিতে পারে। এ ছাড়া নতুন করে ক্ষমতায় বসার উদ্যোগ নিতে পারে সেনাবাহিনী। যেকোনোটাই বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের অপেক্ষা আরো বাড়াবে।
আজকের বাংলাদেশকে নিয়ে প্রশংসা করার মতো অনেক বিষয়ই (নারীদের অগ্রগতি, উদ্যোক্তা শ্রেশি তৈরি, সুশীলসমাজকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন সৃষ্টি, শিল্পী ও লেখকের উন্মেষ) রয়েছে। তবে সরকারের খামখেয়ালি এবং কখনো কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ কর্মকাণ্ডের কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরো উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হচ্ছে।