রোষানলে একজন সম্পাদক, একজন বাবা
আমি সেদিন একগুচ্ছ ছবি ও ভিডিও স্ক্রল করে দেখছিলাম। প্রথমটির শিরোনাম ছিল ‘স্বীকারোক্তি’।আরো নিচে দেখলাম একটি ছবি যেখানে ওই সম্পাদকের পুত্তলিকা দাহ করছে কিছু উত্তেজিত জনতা। আরো একটি ছবিতে দেখলাম, ফটোশপে এডিট করা এক ছবিতে ওই সম্পাদকের মাথায় শয়তানের সিং লাগান হয়েছে। এরপর খবরের অংশটি আছে। তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলার সংখ্যা ৩০, ৪০, ৭০ এভাবে বেড়েই চলেছে। সবশেষে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিবৃতি প্রদান করেছেন, তিনি বলেছেন, ওই সম্পাদকের পদত্যাগ করে আদালতে হাজির হওয়া উচিত।
যে সম্পাদকের কথা বলছি, উনি আমার বাবা মাহফুজ আনাম, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ইংরেজি খবরের কাগজ ডেইলি স্টারের সম্পাদক, যেটি তিনি ২৫ বছর আগে যৌথভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
বাবা প্রায়ই মজা করে বলতেন, তাঁর বিশেষভাবে ইচ্ছে ছিল আইসক্রিম পার্লার খোলার। সেটি তিনি না করে ৪১ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যারিয়ার ছেড়ে দেশে ফিরে গেলেন সংবাদপত্র চালু করবেন বলে।
আমার বয়স তখন ১৫, আমরা ওই সময়ে থাইল্যান্ডে ছিলাম। আমরা তড়িঘড়ি করে সব গোছগাছ করে ঢাকায় ফিরে গেলাম। ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে, সামরিক স্বৈরশাসক হুসেন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনক্ষমতার ৮ বছর সবে শেষ হয়েছে, সংবাদপত্রটির জন্ম হলো। গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কারণে বাবা দেশে ফিরে যেতে পেরেছিলেন এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশের প্রতি তাঁর যে দায়িত্ব সেটি পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সম্পাদকীয় পদে আসীন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আমার বাবা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সমালোচনা করলেন, কারণ সেই সরকার বিরোধীদলকে আলাপের সুযোগই দিচ্ছিল না। দ্বিপক্ষীয় কোনো নীতি সেখানে ছিল না। এরপর তিনি বিরোধীদলের কট্টর সমালোচনা করলেন তারা লাগাতার সংসদ অধিবেশন বয়কট করছে এবং আন্দোলনের পথ হিসেবে হরতাল-অবরোধকে বেছে নিয়েছে বলে।
ভীষণভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক আবহে তিনি ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার সমালোচনা করে স্বাধীন-বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার একটি জায়গা তৈরি করলেন। ডেইলি স্টার হয়ে উঠল দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি সংবাদমাধ্যম। এবং যূথবদ্ধ হলো দেশের জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে। যৌথভাবে এ দুটো সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বাধীন-বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার এক আদর্শিক জায়গা তৈরি করল এবং সেটি এমন একটা মুহূর্তে যখন সাংবাদিকদের জেল-গুম নিত্য ঘটনা ছিল।
তারপরও আমার বাবা রাষ্ট্রের শক্তিশালী থাবার ভরে নিজের স্থান থেকে সরে যাননি। তিনি সরকার, গোয়েন্দা বিভাগ, সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন—সবার কাছ থেকে হুমকি পেয়েছেন।
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত মধ্যবর্তী সরকার দুবছরের জন্য ক্ষমতায় এলো জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য।এই সময় দেশটির সেনা-গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই অডিও-ভিডিও বার্তাসহ একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি মিডিয়া হাউসগুলোতে পাঠায়। যেখানে সরকারি দলের কর্মকর্তাদের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে। অভিযুক্তদের তালিকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামও ছিল। এই প্রতিবেদন স্বাধীনভাবে কারো একার পক্ষে নিরপেক্ষ কি না সেটি যাচাই-বাচাই করা সম্ভব ছিল না। বন্দি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের স্বীকারোক্তিতে এসেছে বলে কোনো সূত্রের উদ্ধৃতি ছাড়াই প্রকাশ করা হয়েছিল ডেইলি স্টারে। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে মাননীয় শেখ হাসিনাকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে জাতীয় সংসদ ভবনে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১১ মাস বন্দি রাখা হয়।
যেই মাত্র সেনাশাসনের অবসান ঘটে, শেখ হাসিনার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের জবানবন্দি থেকে সরে আসেন। তাঁরা দাবি তোলেন যে, এই স্বীকারোক্তি তাঁদের কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করা হয়েছে। এই অভিযোগ উথড্র করার বিষয়টিও ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়। এরপর আমার বাবা খবরটির সত্যতা যাচাই না করে প্রকাশ করার জন্য তাঁর অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন গত তিন ফেব্রুয়ারি ডেইলি স্টারের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন শেষে এক বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে।
পরের দিন সকালে তার সেই অনুশোচনা `স্বীকারোক্তি’ শিরোনামে সর্বোত্র ছড়িয়ে পড়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আমার বাবাকে আটক ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করার জন্য আহ্বান করেন। শেখ হাসিনার কারাভোগের জন্য তিনি বাবাকেই দায়ী করেছেন। এরপর থেকে বাবার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানহানির মামলা করা হচ্ছে।
এটি হলো ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকারের একেবারে সাম্প্রতিক বিদ্বেষমূলক অবস্থান। ২০১৫ সালের মার্চে ডেইলি স্টার নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী হিজবুত তাহরিরের নিয়োগপত্রের একটি ছবি প্রকাশ করে, সেখানে ক্যাপশন ছিল : ‘terrorism rears its ugly head’. মিসেস হাসিনা সংসদে বললেন যে সংবাদপত্রটি ছবিটা ছেপে মৌলবাদীদের প্রচারে কাজ করছে এবং এটি কেউ প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগস্ট মাসে হঠাৎ করে টেলিকম সেক্টর থেকে বিজ্ঞাপন আসা বন্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হয় এটি রাষ্ট্রীয় চাপে হয়েছে।
নিঃসন্দেহে কাস্টডিতে কয়েকজনের স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে পাঠানো কোনো রিপোর্ট অনুসন্ধান না করে ছাপানো উচিত না, যেটি হয়তো আমাদের দেশে হরহামেশা করা হয়। এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ভেতর দিয়ে সাংবাদিকসুলভ চর্চাকে পুনঃপাঠের মোক্ষম সুযোগ পাওয়া যেত। কিন্তু পরিবর্তে সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করছে।
আপনি যাকে ভীষণভাবে ভালোবাসেন তাঁর সঙ্গে এমনকিছু ঘটলে তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। তবে এটাও ঠিক যে, আমার বাবাকে সরকার যে অপদস্থ করছে এটা কেবল তার একার প্রতি বিদ্বেষ থেকে নয়, বরং এটি করা হচ্ছে স্বাধীন গণমাধ্যমগুলোকে দমিয়ে রাখার জন্য।
শেখ হাসিনা নিজেও এখন তাঁর কারাজীবনের জন্য আমার বাবা দায়ী এমন গুজবে কান দিচ্ছেন। গোয়েন্দা সংস্থার ভেতর তদন্ত না করে, সেই কেসের আইনি প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ না করে কিংবা তার গ্রেফতারের পেছনে জড়িত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে না এনে সরকার তার সমস্ত মনোনিবেশ দিয়েছে একটি সংবাদপত্রের ওপর।
সেদিন আমার বাবা লন্ডনে আমাকে এক টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ১৭ বিলিয়ন ডলারের মানহানির মামলা হয়েছে, যেটা বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের চেয়েও বেশি।’ আমি তার এই কথার পেছনে বাঁকা হাসিটা শুনতে পেলাম, সেই সঙ্গে এই হাসির পেছনে লুকানো বেদনাটাও অনুভব করতে পারলাম।
আমার মনে হলো, ১৯৫৮ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হওয়ার কারণে তার বাবাকে (আমার দাদা) যখন পাকিস্তান আর্মি গ্রেপ্তার করে তখন তার আমার মতো অনুভূতি হয়েছিল। আমার দাদা চার বছর জেলে ছিলেন। তাঁর স্বাস্থ্যের চূড়ান্ত অবনতি ঘটলে জেলেই মারা যাবেন এই শঙ্কায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এক বছর আগে ব্লগার এবং মুক্তমনা মানুষ অভিজিৎ রায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাইরে নিহত হন। তারপর আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি এই ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের বর্বরতা দেখে যাঁরা আমাদের লেখকদের রাজপথেই খুন করে চলে যাচ্ছে। এখন রাষ্ট্র নিজেই ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করার জন্য অনৈতিকভাবে দমননীতি অবলম্বন করছে। একদিকে আতঙ্কগ্রস্ত সরকার অন্যদিকে উগ্রপন্থী, মাঝখানে আটকা পড়েছে মুক্ত মিডিয়া।
এক ধরনের মানসিক পীড়ন থেকেই আমি এখন স্বপ্ন দেখছি ওই আইসক্রিম শপের- এটার সুমিষ্ট ঘ্রাণ এবং অন্য যে একটা জীবন আমরা পেতাম, তার। নিশ্চয় সেটি কখনোই সম্ভব ছিল না। বিকল্প পথে হাঁটার বিষয়টি রক্তেই ছিল যে!
তাহমিমা আনাম, যুক্তরাজ্য প্রবাসী একজন বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক ও নৃ-বিজ্ঞানী। তাঁর আলোচিত দুটি উপন্যাস হলো, আ গোল্ডেন এজ (২০০৭) এবং দ্য গুড মুসলিম (২০১১)।
নিউইয়র্ক টাইম থেকে ভাবানুবাদ মোজাফফর হোসেন