ক্রিকেট
অনন্য, অপ্রতিরোধ্য ও অবিসংবাদিত
ভালোবাসলে পাগলের মতো ভালোবাসতে হয়, পাগলের মতো ভালোবাসলে রূপকথার মতো সত্য করে তোলা যায় কতক অসম্ভবকে কিংবা যদি বলি কঠিনতর কোনো প্রত্যাশাকে এনে দাঁড় করানো যায় প্রাপ্তির দরোজায়। এই জিনিসকে সত্য করে তুলেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। দেশকে ভালোবেসে, ক্রিকেটকে ভালোবেসে আট আটটি অস্ত্রোপাচারের পরও দিব্যি দৌঁড়ে বল করছেন, মাঠ মাতিয়ে ফিল্ডিং করছেন, সতীর্থদের কাঁধে হাত রেখে একের পর এক জয় করে চলছেন ক্রিকেটকে।
এশিয়া কাপ ২০১৬, মিরপুরে পাকিস্থানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে অর্জন করল কোনো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠার যোগ্যতা। স্টেডিয়ামজুড়ে নয় শুধু, দেশজুড়ে মানুষের উচ্ছ্বাস, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কথা বলতে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন অধিনায়ক, একজন নেতা মাশরাফি। রমিজ রাজার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন- কোনো চাপ ছিল না আমাদের, খেলেছি, উপভোগ করেছি। ফাইনাল ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হওয়া প্রসঙ্গেও দৃঢ় উত্তর- কোনো ভাবনা নেই আমাদের। ভাবনা কেবল খেলা আর জেতা। অথচ কিছুদিন আগেও কথাগুলো বলতে পারতাম না আমরা, বড় দলগুলোর কাছ থেকে কেবল শুনতে হয়েছে। বলার মতো অবস্থায় ছিলামও না আমরা, এখন হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা কীভাবে তৈরি হলো? এ প্রশ্নে আমাদের ঘুরে যেতে হয় আরেকটু আগে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ২৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে হারে ২২টিতেই! শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি মাত্র টেস্টে ড্র আর নেপাল-আফগানিস্তানের মতো ছোট দলের বিপক্ষে দুটো ওয়ানডে জয়- এই ছিল অর্জন। এই বেহাল অবস্থায় ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থাও দুর্বল যেমন হয়ে পড়ে, তেমনি দর্শক এবং বাংলাদেশি সাপোর্টাররাও ভুগতে থাকে হতাশায়।
এমন মুহূর্তে সেই বছরই অক্টোবরে দলের দায়িত্ব কাঁধে দীর্ঘদিন পর দলে ফিরে আসেন ইনজুরিতে বিধ্বস্ত মাশরাফি বিন মুর্তজা। কে জানত তাঁর এই প্রত্যাবর্তনই হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের গৌরবের সোনার কাঠি। তিনি অধিনায়কত্বে আসার পর থেকেই সবাইকে বিস্মিত করে একের পর এক সিরিজ জিততে থাকে বড় দলগুলোর বিপক্ষে। ত্রাণকর্তার মতো তাঁর আবির্ভাব বাংলাদেশের ক্রিকেটের শক্তিমত্তার কথা জানান দিতে থাকে শক্তিশালী দলগুলোর কাছে। অথচ দল কিন্তু সেই আগেরটাই, আগের মানুষগুলোই খেলছে এক অপ্রতিরোধ্য নেতার নেতৃত্বে। সেই দল নিয়েই মাশরাফি সিরিজ জিতল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, পাকিস্তানকে করল ধবল ধোলাই, ভারতের অহংকারকে করল চূর্ণ-বিচূর্ণ, দক্ষিণ আফ্রিকাকে করল ধরাশায়ী। শুধু কি তাই, ইংল্যান্ডে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া ছিল অন্যতম অর্জন। তারপর একটা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল, যাকে কেউ ফাইনালে কল্পনাই করতে পারেনি, সেই দলকে নিয়ে অধিনায়ক হিসেবে তৃতীয়বারের মতো অর্জন করলেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব।
এই অনন্য কীর্তির মাধ্যমে তিনি দর্শকদের আবার ক্রিকেটের দিকে টানতে লাগলেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ার মতো। শুধু কি এতেই থামানো যায় অপ্রতিরোধ্য নেতা মাশরাফিকে! এশিয়া কাপে প্রথম ম্যাচ হারলেও দুর্দান্তভাবে শেষ তিন ম্যাচ জিতে উঠে গেল ফাইনালে। এর মধ্যে সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর এর গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষের ম্যাচটি, সেখানেও দেখা গেল তার নিঁখুত নেতৃত্ব, সাহসী ভূমিকা। ম্যাচটি জেতার পর দ্য হিন্দু পত্রিকা লিখেছে- 'ইনিই মাশরাফি বিন মুর্তজা- পাকিস্তানের হন্তারক আর বাংলাদেশের গৌরব।' হ্যা, তিনি দেশের গৌরব তো বটেই, ক্রিকেটেরও গৌরব। অধিনাকত্ব কীভাবে করতে হয়, তা তিনি ক্রিকেট বিশ্বকে ভালোকরেই দেখিয়ে দিয়েছেন। দেশে তাঁর জনপ্রিয়তা পুরনো, তবে নতুন করে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তা হু হু করে বাড়তে থাকে, যাকে এখন আকাশ সম বললেও ভুল হবে। আমার মনে হয় এমন জনপ্রিয় ক্রিকেটার পৃথিবীতে এই মুহূর্তে আর দ্বিতীয়টি নেই। দেশের মিডিয়ায় মাশরাফি যেকোনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে প্রশংসিত সবসময়, এই সময়ে প্রশংসার সারিতে যুক্ত হয়েছে বিদেশি মিডিয়াগুলো। কারণ তারাও বুঝে গেছে মাশরাফি সাধারণ কোনো ক্রিকেটার, অধিনায়ক নন। মাশরাফি এমন একজন মানুষ যার কাছে নিজের চেয়ে দেশ বড় এবং সেই দেশপ্রেমের জোড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নিয়ে যাচ্ছেন এমন গৌরবের ভিতর দিয়ে যা কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। এই কারণে মাশরাফি যে জনগণের কাছে হয়ে উঠেছেন ক্রিকেটের ত্রাণকর্তা, সেরা অধিনায়ক, সেরা মানুষ তাও তারা জানে। এ নিয়ে ভারতের পত্রিকা আনন্দবাজার লিখল- 'মাশরাফি মুর্তজাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট মহল আর দেশজ মিডিয়া যেমন প্রশ্নাতীত আনুগত্যের সঙ্গে দেখে, সেভাবে রানাতুঙ্গাকেও শ্রীলংকা দেখে কি না সন্দেহ! বা সৌরভকে ভারত!'
মাশরাফি যেমন ভালোবাসেন ক্রিকেটকে, তেমনি ভালোবাসেন সতীর্থদেরও। শুধু ভালোবাসেনই না, শাসনও করেন পিতার মতো, আবার দুষ্টুমি রসিকতা করেও উৎফুল্ল রাখেন সবাইকে। তাই তিনি মাঠের ভেতরে বাইরে সবখানেই তাঁদের নেতা। এমন নেতার জন্য কি না করা যায়? তাই তো জয়ের চ্যালেঞ্জে যুক্ত হয়েছেন তাঁরাও, পুরোনো সৈনিকরা গড়ছেন নতুন ইতিহাস। রাজনৈতিক মতানৈক্য এবং অস্থিরতার মধ্যেও ক্রিকেট আমাদের একমাত্র জায়গা যেখানে সবাই এক আর সবার মুখেই এখন শুধু মাশরাফি মাশরাফি ধ্বনি। সব পরিসংখ্যানের ঊর্ধ্বে তিনিই সেরা। তিনি মাঠে নামলেই গর্জে উঠে বাংলাদেশ, যেন দশজন যোদ্ধাকে নিয়ে মাঠে একজন জেনারেল, সাথে আছে সমগ্র বাংলাদেশ। এখানেই মাশরাফি অনন্য, অপ্রতিরোধ্য ও অবিসংবাদিত।
লেখক : সাংবাদিক, পরিবর্তন ডটকম।