ক্রিকেট
পরাজয়ের সৌধের ওপরই নির্মিত হবে বিজয়গাথা
ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। যে কোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। ভারতের সাথে ম্যাচটিতে হলো যেমনটা। সব হিসাব-নিকাশ ঠিক ছিল। সবই আগাচ্ছিল ঠিকঠাক। জয়ের বন্দর থেকে আর মাত্র দুই কদম দূরে। সাড়া দেশজুড়ে কোটি কোটি উৎকণ্ঠিত জনতা শেষ মুহূর্তের চিৎকার দেওয়ার অপেক্ষায়। সেই চিৎকার দেওয়া আর হলো না। সমস্বরে চিৎকারের বদলে বের হয়ে এলো কান্না! মাত্র ১ রানে হেরে গেল বাংলাদেশ ভারতের কাছে।
এখনো দুঃস্বপ্ন মনে হয় ব্যাপারটা। গতকাল পর্যন্তও মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে খেলা শেষ হয়নি। চলছে। ৩ বলে মাত্র দুই রান লাগে। একটু টোকা দিয়ে ২টা সিঙ্গেল নিলেই ম্যাচ জিতে যাবে টাইগাররা! ঠিক সেই সময়েই দলের নিরভরযোগ্য দুই কান্ডারী করে ফেললেন ভুল। খেললেন নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় শট। বাউন্ডারি হাঁকাতে গেলেন। সেটাই কাল হলো দলের জন্য। জয়ের বন্দরে এসে ডুবে গেল তরী। কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্তের মনে নেমে আসল এক ঘোর অমানিশার রাত। যে রাত শেষ হতে চায় না। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়। কান্নায় দম বন্ধ হয়ে হয়ে আসে। ২৩ মার্চের রাতে কত শত, কত লাখ চোখ অশ্রু সজল হয়েছে বারবার, তার ইয়ত্তা নাই। তবুও কী আর করা। মেনে তো নিতেই হবে।
তবে গত ম্যাচে মাহমুদুল্লাহ- মুশফিকরা ওই সময়ে এমন রিস্কি শট না খেললেও পারতেন। তাদের ওপরে নির্ভর করেছিল গোটা জাতি। নিতান্তই অভিজ্ঞতার অভাবে হাত ফসকে বের হয়ে গেলই ভারত। টি-টোয়েন্টি তে তাদের হারানোর চরম সুযোগ হাতের একেবারে নাগালে এসেও হাত ছাড়া হয়ে গেল!
ম্যাচ হারার জন্য মাহমুদুল্লাহ-মুশফিককে দায়ী করছেন অনেকে। অনেকে আবার অশ্রুসজল চোখে মেনে নিয়েছেন হার। টাইগারদের প্রতি দিয়েছেন সমবেদনা। পিঠ চাপড়ানো গলায় বলেছেন- ব্যাপার না! আবার হবে! সবে তো শুরু।
শেষ তিন বলে খেলা দুটি অপ্রয়োজনীয় শট ও বোকামির কারণেই ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ এ কথা ঠিক অনেকাংশেই। জয়ের নাগালে এসে সে জয় হাতছাড়া হওয়ায় টাইগার ভক্তদের হৃদয় ভেঙে গেছে তাও ঠিক। সেই ক্ষোভ থেকেই ক্রিকেটারদের দোষারোপ করছেন অনেকে। বলেছেন জীবনে আর বাংলাদেশের খেলা দেখব না!
বিষয়টিকে দুইভাবে দেখার সুযোগ আছে। প্রথমত, যারা রাগ ক্ষোভ থেকে ক্রিকেটারদের দুষছেন তাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, টানটান উত্তেজনার এই ম্যাচ জয়ের দোরগোড়ায় এনেছিলেন কিন্তু এই ক্রিকেটাররাই। তারাই এমন আনন্দের উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছেন এর আগে বহুবার। কাঁদিয়েছেনও। এবার প্রায় সবই আগাচ্ছিল ঠিক পথে। কিছুটা বোকামি, কিছুটা ভাগ্যের পরিহাসে আমরা পারিনি। তার দায় কারো ওপরে দিয়েই বা লাভ কী! ভুল সবাই করে। গত ম্যাচে ক্রিকেটাররাও করেছেন হয়তো। কিছু ভুলের খেসারত দিতে হয় খুব বড়সড় রকমের। শেষ তিন বলে ঘটে যাওয়া ভুল সেই রকমই বড় রকমের দুঃখের কারণ হয়ে এসেছে। অথচ এই মাহমুদুল্লাই কিন্তু আমাদের বেস্ট ফিনিসার বলে খ্যাত। অনেক জয়ের উপলক্ষ তৈরি করেছেন আগে নিজ হাতে। এই মুশফিক এনে দিয়েছেন অনেক বিজয় মুহূর্ত।
দ্বিতীয়ত, যারা রাগ-ক্ষোভ, অভিমান দেখাচ্ছেন, সেটাকেও আমি খুব বেশি নেগেটিভলি দেখি না। এই রাগের, ক্ষোভের অন্তরালে লুকিয়ে আছে সীমাহীন ভালোবাসা। ভালোবাসা থেকে হৃদয় ভাঙা। হৃদয় ভাঙা থেকে রাগ-মান-অভিমান ক্ষোভ। এ ভালোবাসারই আরেক রূপ। যতই বলুন যে আর কোনোদিনই বাংলাদেশের খেলা দেখবেন না, খেলা শুরু হলে দেখা যাবে সব ছেড়ে ছুড়ে কাচুমাচু একটা হাসি দিয়ে আবার এসে বসেছেন টিভির সামনে। রিকশাওয়ালারা রিকশা রেখে দাঁড়িয়েছেন টিভির দোকানের সামনে।
ভারত বাংলাদেশের এই হাই ভোল্টেজ ম্যাচে একটি বিষয় কিন্তু খুব চোখে পড়েছে। এ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে একবারও তাদের মাটিতে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। তাদের দর্শকরা নাকি সেই ম্যাচ দেখবে না এমন গুজবও শোনা গেছে। কিন্তু সেদিন দেখা গেল, মাঠ ভরতি কানায় কানায়। ব্যাঙ্গালুরুর মাঠ উপচে পড়ছে ভারতীয় দর্শকে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠয় দম বন্ধ করে ভারতীয় দর্শকরা খেলা দেখেছে বাংলাদেশের। প্রতি মুহূর্তে ভয় পেয়েছে এই বুঝি তাদের খেয়ে ফেলল বাঘে। শেষ মুহূতে নিতান্তই ভাগ্যের ফেরে বা বাংলাদেশের প্লেয়ারদেরই বোকামিতে জিতেছে তারা। তবে যা বোঝার বুঝে গেছে তারা। এবার ছাড়া পেলেও ভবিষ্যতে যে এই বাঘেরাই ওয়ানডে ক্রিকেটের মতো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও তাদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে, সেই আতঙ্কই দেখেছি ভারতীয় ক্রিকেটার/দর্শকদের চোখে মুখে।
আরো একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, ইতিপূর্বে এশিয়া অঞ্চলের ক্রিকেটে ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ মানে ছিল হাই ভোল্টেজ ম্যাচ। তারা মুখোমুখি মানেই টানটান উত্তেজনা। সেই জায়গায় বেশ খানিকটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে আজকাল। পাকিস্তানের সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশ ভারত-ম্যাচ মানে হাইভোল্টেজ ম্যাচ। অনেকাংশেই ভারত পাকিস্তানের সমর্থকদের চেয়ে বাংলাদেশ-ভারত সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বেশি দেখা যাচ্ছে। এটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম অর্জন।
আজ নিউজিল্যান্ডের সাথে খেলা। আজকের ম্যাচ হোক নিজেদের ঝালাই করে নেওয়ার। আরো একটি টি-টোয়ন্টি ম্যাচ খেলে নিজেদের অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে নেওয়ার ম্যাচ হোক আজ। যত বেশি ম্যাচ খেলবে, নিজেদের ঝুলিতে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় তত বাড়বে। জয়-পরাজয়ে কিচ্ছু যায় আসে না। পরাজয়ে বীর নাহি ডরে।
টাইগার সমর্থকদের বলি, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কষ্ট পেয়েছেন যেমন, আনন্দের উপলক্ষও আসবে সামনে। শুধু একদিন নয়। অহরহ আসবে। সেইদিনের অপেক্ষায় থাকুন। টাইগারদের সাথে থাকুন। দলকে পুরো সাপোর্ট দিন। আপনাদের ভালোবাসা ও সমর্থনই পারে দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে। এত এত লোকের এত পরিমাণ ভালোবাসা বৃথা যেতে পারে না। এত শুভ কামনা যেতে পারে না জলে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুদিন আসবেই। এখনকার এসব পরাজয়ের সৌধের ওপরই নির্মিত হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিজয়গাথা।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ