ক্রিকেট
ক্যারিবিয়ান আবেগ বনাম আমাদের উগ্রবাদ
এক বছরে তিন বিশ্বকাপ। ক্রিকেট যে দেশে এক আনন্দ আর নিখাদ উপভোগের নাম, সেখানে এমন জয়ে, উৎসবের উপলক্ষ আর কী হতে পারে! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বজয় অবশ্য শুধু এই দ্বীপপুঞ্জকেই নয়, কেমন যেন এক ফুর্তি এনে দিয়েছে দুনিয়াজোড়া ক্রিকেটভক্তের মনে। এ দেশের ক্রিকেটপাগল জনতার মনেও আনন্দ এনে দিয়েছে ব্রেথওয়েটের চার বলে চার ছয়।
আজকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটি বড় কষ্টে গড়ে উঠেছে। টুর্নামেন্টের আগে তারা এক হয়েছে বহু সমস্যার মুখোমুখি হয়ে। এমনিতেই ভাড়াটে খেলোয়াড়ি জীবনের জন্য তাদের দুর্নাম, তার ওপর বোর্ডের সঙ্গে বনিবনার অভাব। খেলতে নামার আগে খেলার পোশাক পর্যন্ত ছিল না। মার্ক নিকোলাসের মতো ক্রীড়ালেখক তাঁদের অভিহিত করেছেন ‘মস্তিষ্কহীন’ হিসেবে। সবকিছুর জবাব মাঠেই দিয়েছে তারা, সেই জবাবে ছিল বঞ্চনা-অবহেলা-অবজ্ঞার প্রতি তীব্র প্রতিবাদ, ফুঁসে ওঠা আবেগ।
এই ‘আবেগ’ বিষয়টা নিয়ে কথা বলতেই এ লেখা।
একটা সময় ছিল, যখন আমাদের খেলোয়াড়রা ৫০ ওভারের ম্যাচে একশ-দেড়শ রান পেরোতে বা প্রতিপক্ষের দু-তিনটে উইকেট ফেলতেও গলদঘর্ম হয়ে যেতেন। এ দেশের মানুষও বিষয়টির সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন। ক্রিকেটের উন্নয়ন আর দিনের পরিক্রমায় সে সময় এখন কেবলই অতীত। এখন বাংলাদেশ সামান্যর জন্য হেরে যায়, আর জিতে যায় অনায়াসে। বাংলাদেশের ছেলেরা যখন ক্রিকেট খেলে, তখন দেশে একটাই খবর আর একটাই আলাপ—ক্রিকেট। তার সঙ্গে মিশে যায় আবেগ। আবেগের সঙ্গে বেধে যায় তর্ক-বিতর্ক। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে এখন যে কেউ কথা বলতে পারেন, যে কেউ মতামত দিতে পারেন, যে কেউ ঘরে বসেও মাঠে কী করা উচিত—তা অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দেন অনায়াসে! সামাজিক মাধ্যমের এই লড়াই এখন কেবল দেশে নয়, বরং ভিনদেশের ময়দানে গিয়েও ঠেকেছে। আমাদের ক্রিকেটপ্রেমীরা দেশ ছাপিয়ে ভিনদেশেও লড়ছেন বিশাল দায়িত্ব নিয়ে। মাঠে না হোক, ফেসবুক আছে না!
ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি মেশানো, সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পৃক্ত করা, চলমান ইস্যু, বিভিন্ন ইতিহাস, গৌরব আর নিপীড়নের বিষয়গুলো মেশানো যাবে কি যাবে না; গেলেও কতটা উচিত, কতটা উচিত নয়—এগুলো তর্কসাপেক্ষ বিষয়। তবে একটি বিষয় নিঃসন্দেহে থাকবেই, আর তা হলো আবেগ। এই আবেগ থাকবেই, কারণ জন্ম থেকে জন্মান্তরে আমরা অনেক আবেগী। আমরা আবেগে বাঁচি, আবেগে মরি। এ আবেগ আমাদের অনেক গর্বের। তবে এই আবেগ যখন হয়ে ওঠে চোখে ঠুলি পড়া, দায়িত্বহীন এবং বোধবুদ্ধিহীনতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন; তখন তাকে নিয়ে গর্ব করা যায় না, বরং ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হতে হয়।
ফ্যান ও ফ্যানাটিক—এ দুয়ের মাঝে কিন্তু যোজন যোজনের ফারাক। ভালোবাসা দুটি শব্দের মধ্যেই রয়েছে, তবে একটি সবার তারিফ পায়, আরেকটি মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। ফ্যান থেকে ফ্যানাটিক হয়ে ওঠার পথে আমাদের দর্শক জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ রীতিমতো পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। কে কার চেয়ে কতটা ‘ভালোবাসা’ দেখাতে পারেন, যেন সেটার প্রতিযোগিতা চলছে! যে যেভাবে পারছেন কেবল আক্রমণ করে চলেছেন, ভয়াবহ ভালোবাসার কথা বলছেন, টেনে আনছেন অতীত থেকে বর্তমানের বিবিধ রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
অথচ একমাত্র ক্রিকেট খেলা ছাড়া এই মানুষগুলো কখনো এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো কথা বলেন না, এগুলো নিয়ে কোনো দৃকপাতও নেই তাঁদের। দেশে কী হলো-না হলো, কী হবে বা না হবে, তা নিয়ে সামান্যতম মাথাব্যথাও নেই তাঁদের। ভাবখানা ঐক্যবদ্ধভাবে সবারই এমন, ‘আমার তো কিছু হয়নি রে ভাই!’ শুধু ক্রিকেট খেলা এলে সব মনে পড়ে যায়। তাহলে কি বিষয়টা এমন যে, বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের ন্যূনতম অনুভূতি তৈরির জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে বছরের প্রতিটি দিন ক্রিকেট খেলতে হবে? ক্রিকেটাররা ৩৬৫ দিন মাঠে থাকবেন, আমাদেরও অনেক বিষয় মনে পড়বে!
এখানেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। আবেগ বিষয়টাকে সম্মান আর গৌরবে কীভাবে রূপান্তর করতে হয়, তারাই দেখিয়েছে গতকাল ইডেনের মাঠে। কিংবদন্তি উইন্ডিজ অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেলকে বলা হতো ক্রিকেটের কবি, ড্যারেন স্যামিকে কী বলবেন—ক্রিকেটের গেরিলা বিপ্লবী? সব প্রতিকূল পরিস্থিতি পাশ কাটিয়ে অনেকের প্রতি অভিমান আর অভিযোগ ছাপিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রত্যেকে চ্যাম্পিয়ন’! প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ছাপিয়ে, ভবিষ্যতের কোনো পরোয়া না করে দুনিয়াকে দেখালেন, আবেগের প্রতিদান কীভাবে দিতে হয়! কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মানুষ সহজ-সরল, তেমনই টলটলে তাঁদের আবেগ। তাঁরা জিতলেও নাচবে-গাইবে, হারলেও তা নিয়ে রাজ্যের কারণ দেখাবে না, কাউকে আক্রমণ করে ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট করবে না। আফগানিস্তানের সঙ্গে হেরেও তাঁরা নেচেছিলেন, ইংল্যান্ডকে হারিয়েও নেচেছেন।
এমনকি শেষ ওভারে যখন জয়ের জন্য ১৯ রান দরকার, যা করাটা অসম্ভবই মনে হচ্ছিল হয়তো অনেকের (ব্রেথওয়েট চার বলে চারটি ছয় মেরে দেবেন টানা, এটা তো অনুমান করা কঠিন, নাকি!) কাছে, তখনো ডাগআউটে বসে স্যামি, গেইল, রাসেল কিংবা অনেক খেলোয়াড়ই দিব্যি হাসছিলেন। কারণ, ক্রিকেট তাদের কাছে আবেগের বিষয়, উপভোগেরও বিষয়। তারা জিতলেও নাচতে জানে, হারলেও হাসতে জানে। আর এটাই হলো তাদের প্রকৃত চ্যাম্পিয়ন সত্তা। তাদের দেশের মানুষও এমনই। স্যামির উদাত্ত আবেগ, গেইল-ব্রাভোর নাচ তামাম ক্যারিবিয়ানেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
এ প্রসঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে ‘ভারতের হারে খুশি’ হয়ে ওঠা মুশফিকুর রহিমের বক্তব্যের কথা টানা যায়। এ দেশের অনেক মানুষের আবেগ যে ঘরানার হয়ে উঠছে দিন দিন, মুশফিক সেটারই প্রতিনিধিত্ব করেছেন মাত্র! তার এহেন ‘আবেগ’ দুনিয়াজোড়া প্রতিক্রিয়াশীল গণমাধ্যমের সামনে আমাদের দেশ ও এর মানুষকে কতটা নিচুভাবে উপস্থাপন করবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবার মতো পেশাদারিত্ব বা দায়িত্বশীলতা তিনি দেখাননি। অপেশাদারিত্ব খেলার মাঠ ছাপিয়ে ব্যক্তিগত পরিসরেও এভাবে চলে এলে বিষয়টি নিয়ে হতাশা জানানো ছাড়া কী-ই বা করার থাকে!
‘দ্য প্রিন্স’-এ নানা কথা আর যুক্তির মধ্যে ম্যাকিয়াভেলির একটি যুক্তি ছিল এমন যে, রাজাকে কখনো দোষারোপ করা যায় না। কারণ, রাজা জনগণের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হন। সে হিসেবে মুশফিককেও দোষ দেওয়া যায় না, কারণ এ দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনিও তো নির্বাচিত হয়েছেন এ দেশের মানুষের মধ্য থেকেই!
আমাদের আবেগ হোক সুন্দর, সত্য, শাশ্বত। তাতে অপরূপ বাংলাদেশের রূপ-রস-গন্ধ-রং মিশে থাকুক, উগ্রবাদের আস্ফালন নয়।
লেখক : সাংবাদিক