মতান্তর
শুধু ডাস্টবিনের সংখ্যা বাড়ালেই কি সংকট কাটবে?
সেদিন খবরে পড়লাম, ঢাকায় দুই মাসের মধ্যে ১০ হাজার ডাস্টবিন বসাবেন নগরপিতারা। ভাবছিলাম, শুধু এসব মিনি ডাম্পগ্রাউন্ড বসিয়ে এই বিশাল সমস্যার কি পরিপূর্ণ সমাধান করা যাবে?
রাজধানীর বিপুল পরিমাণ বর্জ্য যদি আরেকটু পরিকল্পিত উপায়ে সংগ্রহের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে হয়তো বর্জ্যের জৈব অংশ কমপোস্ট বা জৈব সার হিসেবে শুরুতেই আলাদা করে নেওয়া যাবে, আর যেটুকু পুনর্ব্যবহারযোগ্য, সেটুকুও আলাদা করা যাবে সহজেই।
যেমন ধরা যাক, এই ডাস্টবিনগুলোতে যদি দুটি করে ভাগ রাখা যায় তাহলে মন্দ হয় না। এতে রিসাইক্লিং বা কম্পোস্টিংয়ের জন্য যতটা লোকবল ঢাকায় দরকার হবে, সেই খরচটা অনেকাংশে কমানো যাবে।
আমরা দুটো ভিন্ন ভিন্ন রং চিন্তা করতে পারি ঢাকাবাসীকে পুরো বিষয়টার সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য। যেমন ভেজা বা জৈব বর্জ্যের জন্য সবুজ বিন আর শুষ্ক বা অজৈব বর্জ্যের জন্য হলুদ বিন।
ঢাকার বর্জ্যের ৭০-৮০% জৈব হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবে একটা যথাযথ জরিপের মাধ্যমে বর্জ্যের কম্পোজিশন জানাটা জরুরি। ঢাকাকে বেশ কতগুলো জোনে ভাগ করে বিভিন্ন এলাকায় এই জরিপ করা যেতে পারে। কম্পোস্টিং করা যেতে পারে সবুজ বিন থেকে পাওয়া বর্জ্যগুলো। আর হলুদ বিন থেকে পেতে পারি পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, ধাতব বা কাঁচের তৈরি বিভিন্ন বর্জ্য। দেশে অবশ্য এ ধরনের জিনিসপত্র জমিয়ে বিক্রির একটা ব্যবস্থা চালু আছে। সেটাও করা যেতে পারে। অনেকটা ভর্তুকির মতো। ছোট ছোট থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষ ঢাকাবাসীর কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে এসব অজৈব বর্জ্য সংগ্রহ করবে। বাসিন্দারা শুধু জিনিসগুলো আলাদা করে বুঝিয়ে দেবে। বাকি কাজ ওই তৃতীয় পক্ষের।
প্রথম প্রথম মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে এ রকম পদ্ধতি হাতে নেওয়া যেতেই পারে। বিদেশে এরকম নজির আছে। যেমন ইউরোপের কয়েকটি দেশে ‘পে এজ ইউ থ্রো পলিসি’ চালু আছে। তার মানে যত ময়লা ঢালবেন তত টাকা গুনবেন।
ঢাকার মানুষের আয়ের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, উত্তরা এলাকায় এই ব্যবস্থা চালু করা যায় কি না সেটা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রীগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো যায় কি না, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এতে কর্মসংস্থানও হবে আবার পদ্ধতিগত পুনর্ব্যবহার সেন্টার বা সিস্টেম্যাটিক রিসাইক্লিং সেন্টারও গড়ে উঠবে।
শুধু ডাম্প গ্রাউন্ড না বানিয়ে ঢাকার জন্য দুই থেকে তিনটি প্রপার ল্যান্ডফিল বা যথাযথভাবে বর্জ্য দিয়ে ভরাটের স্থান চালু করতে হবে। এর জন্য নকশা ও কর্মকৌশল ঠিক করতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন দেশের ল্যান্ডফিল বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তবে এসব তখনই সম্ভব, যখন সরকার পরিবেশ দূষণরোধে সত্যিকার অর্থে আন্তরিক হবে। সেই সঙ্গে মানুষের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, ডাম্প গ্রাউন্ডগুলো শুধু দুর্গন্ধই ছড়ায় না, ভূগর্ভস্থ পানিকেও মারাত্মকভাবে দূষিত করে। এর ফলে নিরাপদ পানি পাওয়া যেমন কঠিন হয়ে যেতে পারে, তেমনি পানি শোধনের খরচও বাড়তে থাকবে।
আরো একটা বিষয় ভবিষ্যতের জন্য ভেবেচিন্তে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। সেটা হলো বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। একথা ঠিক যে উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদিত বর্জ্যের গুণগত মান তুলনামূলক কম। ফলে বর্জ্যের লোয়ার ক্যালোরিফিক ভ্যালু বা হিটিং ভ্যালুও তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া যায়। তা ছাড়া আমাদের দেশের বর্জ্যে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশিই হবে বলে ধারণা করছি। এতে তুলনামূলক বেশি জ্বালানির প্রয়োজন হবে। উন্নত বিশ্বে নন রিসাইক্লেবল প্লাস্টিকই জ্বালানির একটা নির্দিষ্ট অংশের চাহিদা পূরণ করে। আমাদের বর্জ্যে এর পরিমাণ কেমন হতে পারে সেটা এখনই নির্ধারণ করা জরুরি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিশ্বব্যাংকের ডিশিসন মেকার্স গাইড টু ইন্সিনারেশন অনুযায়ী বর্জ্যের হিটিং ভ্যালু ন্যূনতম ৬ মেগাজুল/কেজি বা ৫ মিলিয়ন বিটিইউ/মেট্রিক টন না হলে তা পাওয়ার জেনারেশন ফিজিবল হয় না বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত তাপ হিসেবে গণ্য হয় না। তাই ভবিষ্যতে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এখনই এ বিষয়ে গবেষণা শুরু হওয়া দরকার। যেন প্রয়োজনে বর্জ্য থেকেই দেশের মানুষের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যায়।
শুধু ডাস্টবিন না বসিয়ে বর্জ্যের এসব ইতিবাচক দিকগুলো চিন্তা করে সরকার বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলে বর্জ্য সমস্যার সত্যিকারের সমাধান সম্ভব।
লেখক : পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেমস, ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা, শার্লট, যুক্তরাষ্ট্র।