ফুটবল
নিয়তির দুষ্টচক্রে বাংলাদেশ ফুটবল!
ফুটবল মানচিত্রে একেবারেই পুঁচকে একটা দেশ। ফুটবল ঐতিহ্য-ঐশ্বর্য বলেও তার কিছু আছে তেমন দাবি করা যাচ্ছে না। ছিল, ফুটবল ইতিহাসবিদরা সেই সাক্ষীও দেন না। ফিফা র্যাংকিংয়ে চোখ রাখলে ইতিহাসের পাতা উল্টানোর আগ্রহ হারিয়ে যায়। ২০৬ দেশের মধ্যে ১৮২-তে! ফুটবল-দীনতার সাম্প্রতিক চেহারা। সংখ্যার বিচারে অতীত একটু ভালো। ১৯৯২ সালে ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ১১৫-তে। কিন্তু ওই সংখ্যাটা তো ‘মমি’ হয়ে পড়ে আছে। ওটা নিয়ে আর শব্দ খরচ করারই বা কী আছে!
ফুটবলীয় আভিজাত্য, ঐতিহ্য, ঐশ্বর্য না থাকলেও বাঙালির আছে ফুটবলকে ঘিরে বাঁধভাঙা আবেগ। উথাল-পাথাল সেই আবেগ বিশ্বকাপ নামক মহাসাগরেও আছড়ে পড়ে! যদিও নিজেদের দেশটা সেই সাগরতটেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে! কারণ, বাছাই পর্বের নদী-নালা-খাল-বিলটাই পাড়ি দিতে শেখেনি তারা। ‘বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব’ নামক ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে হলে অন্তত বুড়িগঙ্গায় সাঁতার কাটা তো শিখতে হবে। বাংলাদেশ সেটা শিখতে পারেনি। তাই সাউথ এশিয়ান ফুটবলেও বারবার হাবুডুবু খাচ্ছে!
কিন্তু তাতে কি? সেই বাংলাদেশের ফুটবলের কর্তৃত্ব অধিগ্রহণের জন্য যে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে ইশতেহারে দফার বন্যা! ভাবটা এমন দেশীয় ফুটবলে উন্নয়নের বন্যা আসা শুধু সময়ের ব্যাপার! আট বছর যারা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা দিয়েছেন ২৫ দফা। যাতে উপজেলা পর্যন্ত নাকি ফুটবলে পেশাদারিত্ব চলে আসবে। আবার যাঁরা ফুটবল বাঁচাতে চাইছেন, তাঁরা দিয়েছেন ১৪ দফা। সেখানে অবশ্য জাতীয় দল নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার কথা নেই।
থাকবে কীভাবে! আমাদের ফুটবলের চিন্তার দীনতা তো সব জায়গায়। সেই চেহারাটা ফুটে উঠবে ওই সব কর্মসূচিতে এটা খুব স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক হচ্ছে এই নির্বাচনকে ঘিরে যা হচ্ছে। সেটা দেখে মনে হবে, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ নয়। মধ্যম আয়ের দেশও নয়। রীতিমতো উচ্চ আয়ের দেশ। যাদের ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পাঁচ তারকা হোটেল না হলে চলে না! আভিজাত্যের দুর্দান্ত নমুনা! অথচ সেই দেশের ফুটবল প্রতীকী অর্থে নাকি বলছে- ‘আমাকে বাঁচাও’! বাঁচানোর স্লোগান নিয়ে যাঁরা এগিয়ে আসতে চাইছেন, তাঁদের চিন্তা কতটা আধুনিক, তাও পরিষ্কার নয়। আবার যাঁরা আট বছর ধরে ফুটবলকে চালালেন, তাঁরা শুধু বারবার বলছেন; ‘আমরা ফুটবলকে মাঠে রেখেছি।’ কথাটা অসত্য নয়। তবে মাঠে থাকা সেই ফুটবলের চেহারাটা ছন্নছাড়া সেটা গ্যালারি বা প্রেসবক্সে বসলেই বোঝা যায়। পাঁচতারকা হোটেলে বসে বোঝা যাবে না। সেই সত্যিটাই শুধু কর্তারা বুঝতে চান না।
মাঠে যে ফুটবল আছে সেটা রংচটা। যাঁদের সময় ফুটবলের রং বেশি চটে গিয়েছে, প্রাক স্যাটেলাইট জমানায় তাঁরা এ দেশের ফুটবলপাগল মানুষকে অফুরন্ত আনন্দ দিয়েছেন। কিন্তু মাঠ ছেড়ে চেয়ারে বসে তাঁরা দিচ্ছেন অনেক বেদনা। দুঃখ। হতাশা। একসময় আনন্দ দেওয়ার জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মানুষ এখন বলছেন, ‘অনেক তো হলো। আট বছর দেখলাম। এবার আপনারা সরে যান।’ কিন্তু সেই মানুষগুলোর মনেই আবার সংশয়! আগামী চার বছরের জন্য নতুন যদি কেউ আসেন তিনি বা তাঁরা নতুন কী দেবেন? মাঠের ফুটবলকে এরা পাঁচতারকা হোটেলে সমাধিস্থ করবেন না তো!
অপেশাদার অবকাঠামোতে পেশাদার লিগ। জবাবদিহি-হীন প্রশাসনে পেশাদার লোকজন। দুর্নীতির শাপগ্রস্ত ফিফার অডিট রিপোর্ট পকেটে নিয়ে ঘোরা জবাবদিহি আর স্বচ্ছতার নমুনা হতে পারে না। যাঁরা ভোট দিয়ে কর্মকর্তাদের নির্বাচিত করেন, তাঁদের কাছে জবাবদিহির কিছু আছে কি! অবশ্য তাঁরাই বা আশা করবেন কীভাবে? এসব ভোটার বা ডেলিগেটদের জনাকয়েকের ভিজিটিং কার্ডে পদ-পদবির যে বহর, তা পেতে হলে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ জরুরি। ফুটবল জ্ঞান, সাংগঠনিক দক্ষতা ছাড়া অন্য সব জায়গায় অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান তাঁরা। তাঁদের ভোটে দেশের ফুটবলকর্তারা নির্বাচিত হবেন, এতেই তো ধন্য ধন্য পড়ে যাওয়ার কথা ফুটবলাঙ্গনে। তার ওপর ভোট দিতে এসে তাঁরা থাকবেন রেডিসন গার্ডেন ওয়াটার ব্লুতে। তাঁদের উপস্থিতিতে সেখানকার ঝরনা কুলকুল ধ্বনিতে বইবে।
নিজেদের ভেতরে একটা প্রশান্তি আসবে। শুধু অশান্তি হতে পারে যদি কেউ প্রশ্ন-ট্রশ্ন করেন, কেন প্রতিবছর গঠনতন্ত্র মেনে তাঁদের সাধারণ সভায় ডাকা হয়নি?
তবে আগাম গ্যারান্টি দেওয়া যায়, সেই অশান্তির শঙ্কা থাকবে না। বাংলাদেশ ফুটবলের যতই জীর্ণ দশা হোক না কেন, ডেলিগেটদের তো নেমন্তন্নর চিঠি পাঠানো হয়েছে পাঁচতারকা হোটেলে থাকা-খাওয়ার। চক্ষু-লজ্জা বলে একটা কথা তো আছে। আর বাংলাদেশ ফুটবল দরিদ্র হলেও কিছু ধনকুবের কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। রংচটা ফুটবলকে রঙিন করতে তাঁরা অন্য কিছু করুন বা না করুন, ক্ষমতার চৌবাচ্চায় ডুব দিয়ে এসে তাঁদের দু-একজন নির্বাচনের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন!
নির্বাচনের মাঠে টাকার অভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, বিমানে করে কর্তারা ছুটছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কিন্তু টাকার বড্ড অভাব- যখন ফুটবল প্রতিভা খুঁজে তাঁদের উন্নত প্রশিক্ষণের কথা উঠবে। যখন দেশের কোচদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানোর প্রসঙ্গ উঠবে। আসলে বাংলাদেশ ফুটবলের এটাই নিয়তি- প্রতিভা তুলে আনার জন্য এখানে কেউ টাকা খরচ করতে চান না। পদ-পদবির জন্য নিজের অর্থ-সম্পদের রঙিন চৌবাচ্চায় অন্যদের ডুবাতে কার্পণ্য করেন না! আবার কেউ কেউ নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে অর্জিত যশ-খ্যাতি-জনিপ্রয়তার ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ ভাঙিয়ে চলতেও দ্বিধা করেন না চেয়ার পাওয়ার জন্য! বাংলাদেশ ফুটবল- শুধু তুমি তোমার প্রাপ্যটুকু পাবে না। বঞ্চিত থাকবে। তুমিই হতভাগ্য!
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।