বাফুফে নির্বাচন
দেশজ ফুটবলের স্বাস্থ্যকর চেহারা ফিরবে তো?
বাফুফের নির্বাচন ঘিরে দিন কয়েক যা হলো তা কী শুধুই হৈচৈ? বাকযুদ্ধ? নাকি এই নির্বাচন আমাদের নতুনভাবে বুঝিয়ে দিল, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, অর্থ আর পেশীনির্ভর মাস্তানিতন্ত্রও! গণতন্ত্র- বাঙালির কাছে সব সময় কাঙ্ক্ষিত এক জিনিস। সেটা এ দেশের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত সব মানুষ চিন্তা আর মননে ধারণ করে। তাই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সময় তারা ভুলও করেছেন কম। বাফুফের নির্বাচনেও তাই। কে বা কারা জিতলেন তারচেয়ে বড় কথা বাঙালির গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার জয় হয়েছে। হ্যাঁ, তাই। কারণ, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ডেলিগেট বা কাউন্সিলর ছিলেন ১৩৪ জন। তাঁরা সবাই উপস্থিত হয়েছেন। ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন!
অস্ট্রেলিয়ায় বিজনেস সামিট ফেলে রেখে দুপুর ২টায় ঢাকায় পা রেখেই পুরান ঢাকার এক কাউন্সিলর ভোট দিতে ছুঁটে গেছেন! গণতন্ত্রে ভোট বড় এক অনুষঙ্গ। সেটা আরো একবার প্রমাণিত হলো বাফুফের নির্বাচনে। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা রেখে বিজয়ী-বিজিত সবাই মেনে নিয়েছেন ফলাফলও। বাংলাদেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক চেহারার পাশাপাশি বাফুফের নিবার্চনে গণতন্ত্রকে একটু স্বাস্থ্যকর মনে হলো না কি!
এবার আপাদমস্তক ফুটবলপ্রেমী সংগঠকরা উপেক্ষিত থেকে গেছেন নির্বাচনী দৌঁড় থেকে শুরু করে কাউন্সিলর হওয়া পর্যন্ত সব জায়গায়। এমনও দুইএকজন কাউন্সিলর হয়ে এসেছেন যাঁরা বাংলাদেশ ফুটবল ভবনের কোন রুমে কে বসেন, কে কী করেন সেটাও জানেন না। পাঁচ তারকা হোটেলে নেমন্তন খাওয়ার মতো ভোট দিতে এসেছেন। খেয়ে দেয়ে ভোট দিয়ে চলে গেছেন এবং টাকার জোরে আর টাকা পাওয়ার আশায় তাঁরা নিজেদের সংস্থা থেকে ডেলিগেট হয়ে এসেছেন! এঁরা আসলে ধনতান্ত্রিক ঘরানার। মোটেও ফুটবল দরদি নন। এঁদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ফুটবল প্রশাসনে যাঁরা বসলেন, তাঁরা যে খুব স্বস্তিতে থাকবেন তা ভাবার কোনো কারণ নেই। নিজের জেলায় ফুটবল চালাতেও এঁরা বাফুফের কাছে টাকা চান। চাইবেন। নিজের সাংগঠনিক দক্ষতায় একটা স্পন্সর এনে খেলা চালানোর ক্ষমতা এদের নেই। যাঁদের সাংগঠনিক দক্ষতা নেই, তাঁদের খেলাটার প্রতি দরদও নেই। তাঁদের ফুটবলারদের প্রতি মমত্বও নেই। তাঁদের হাত ধরে কোনোদিন ভালো ফুটবলার উঠে আসবে সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই।
এঁরা খেলাটাকে বিকিয়ে সামাজিক আভিজাত্য আর ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা সম্পদশালী হয়ে ওঠার দিকেই ঝুঁকবেন। তা বাফুফের ক্ষমতায় ফেরা কর্মকর্তারা যতই বলুন, তাঁরা উপজেলা পর্যন্ত একাডেমি করে দেবেন। সেখান থেকে ফুটবলার উঠে আসবে। জাতীয় দল সমৃদ্ধ হবে। এটা হয়তো অর্থনীতির ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের থিওরি হতে পারে। কিন্তু সেই থিওরি মেনে ফুটবলার সরবরাহ করার লোকগুলো জেলা পর্যায়েও ফুটবলের দায়িত্বে নেই। ধনতান্ত্রিক শ্রেণী ব্যবস্থার বিকাশটা খুব দ্রুত হচ্ছে সেখানে। এঁরা শুধু পেতে চাইবেন। খেলাটাকে রুগ্ন করে দিয়ে হলেও তাঁদের কিছু পেতে হবে। তাই তৃণমূল পর্যায়ে ফুটবলার খোঁজার পাশাপাশি আগামীতে ফুটবল চালানোর মতো সংগঠক খোঁজার জন্যও বোধহয় পরিকল্পনা করতে হবে। সংগঠকদের প্রশিক্ষণের জন্যও একাডেমি করতে হবে।
একাডেমি তৈরি করার কথা শুনলে সরকার এবং সরকারের আমলারা একটু বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। কারণ স্থাপনা তো একটা নির্মাণ হবে। সেই স্থাপনা থেকে ক্রীড়াবিদ বের হয়ে আসুক বা না আসুক অর্থ নয়-ছয়ের কঙ্কাল খুঁজে পাবেন, সেটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপজেলা পর্যায়ে ফুটবল একাডেমি তৈরি, তাও আবার আাগামী চার বছরে! এটা স্বপ্ন বিলাসী পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। অবাস্তব এই স্বপ্নকে তাড়া করার কোনো মানে হয় না। আগামী চার বছরে যদি গোটা দুয়েক ফুটবল একাডেমিও দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেতে পারেন কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটি তাতে অন্তত মানুষ মনে করতে পারবেন, কাজী সালাউদ্দিন খেলোয়াড় জীবনে যেমন প্রচুর বিনোদন দিয়েছেন দর্শকদের, তেমনি ফুটবল উন্নয়নেও সংগঠক হিসেবে কিছু একটা রেখে গেলেন। কারণ, গত আট বছরে দেশের ফুটবল প্রশাসনের সর্বোচ্চ জায়গায় বসার পর ব্যর্থতার আবর্জনা তো কম জমা হয়নি তাঁর চারপাশে। সেগুলো সাফ করার জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী তাঁকেই হতে হবে। আর সেটা করতে হলে, ভুলে যেতে হবে ফুটবলার হিসেবে তিনি মহাতারকা ছিলেন। কুলীন ছিলেন। ওই বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। খানিকটা ‘সাম্যবাদে’ বিশ্বাস রাখতে হবে। প্রয়োজনে তৃণমূলে থাকা ফুটবল কর্তাদের গা ঘষাঘষি করেও চলতে হবে। যদি সারা দেশের ফুটবলকে সত্যিই এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।
ফুটবলার জীবনে সাফল্যের অনেক শৃঙ্গজয় করেছেন কাজী সালাউদ্দিন। সংগঠক হিসেবে তাঁর স্বপ্নের শৃঙ্গটা কী, তা এখনো কুয়াশাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের কাছে। সেই কুয়াশা সরানোর দায়িত্ব সালাউদ্দিন এবং তাঁর সঙ্গীদের। না পারলে খেলোয়াড়ি জীবনে পৌঁছানো সাফল্যের চূড়া থেকে বেজক্যাম্পে গড়িয়ে পড়তেও খুব বেশি সময় লাগবে না।
এবারের বাফুফের নির্বাচন হয়তো সংগঠক কাজী সালাউদ্দিনের জীবনে শুভ সময় আবাহনকারী হিসেবে এসেছিল। এর আগে নিজের স্টারডম বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হয়তো তিনি এনেছেন ফুটবলের জন্য। কিন্তু তাঁর ব্যয় সঠিক পরিকল্পনায় হয়েছে সেটা জোর দিয়ে লেখা যাচ্ছে না। তার অন্যতম কারণ, সে সময় তাঁর আশপাশের লোকজনের যে নমুনা ছিল, তাতে তাঁরা কেউ সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন তেমন নিশ্চয়তা খুঁজে পাই না। কারণ, পরবর্তীকালে তাঁরাই যে কাজী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি স্বোচ্চার হয়েছিলেন, ছড়াচ্ছিলেন অর্থ-কড়ি নয়-ছয়ের গুঞ্জন।
আবার অর্থ-পেশিশক্তি দিয়ে যে কিছু হয় না, সেটা এবারের নির্বাচন আরো একবার প্রমাণ করে দিয়ে গেল। হোটেল রেডিসনে বাফুফের নির্বাচনের আগে অনেক অচেনা লোকের আনাগোনা ছিল। যাদের আগমনের পেছনে ফুটবল প্রেম বলে কিছু ছিল না। যা ছিল তার নাম- অর্থ। যা শুধু পেশিশক্তির সঙ্গে বিনিময়যোগ্য! তবে দেশের ফুটবল বাঁচাতে বিনিময়যোগ্য অনুঘটক হতে পারে শুধু ফুটবলপ্রেম। ফুটবলীয় মেধা। সাংগঠনিক দক্ষতা। যোগ্যতা। এবং অবশ্যই সততা। বাংলাদেশ ফুটবলে এসবের বড্ড দীনতা। তা আরো বেশি ফুটে ওঠে একটা সংখ্যায়। র্যাঙ্কিংয়ে। ১৯৯৬ সালে এ দেশের ফুটবল পরিচালনার দায়িত্বে যখন ছিলেন পোড় খাওয়া সংগঠকরা। তখন ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ১১০-এ। ওটাই ছিল সংখ্যা তত্ত্বে বাংলাদেশ ফুটবলের সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর চেহারা। আগামী চার বছরে দেশের ফুটবলের ওই চেহারা ফেরানোর কাজটা কাজী সালাউদ্দিনের ভোটে জয়ী হওয়ার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ উৎরে সালাউদ্দিন এবং বাফুফেতে তাঁর টিমমেটরা বাংলাদেশ ফুটবলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবেন, এটাকে মাত্রাছাড়া আশা মনে হলেও, আশা করতে দোষ কোথায়?
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি