নাগরিক চিন্তা
ভয়ের শহর
০৪ মে বুধবার আমাদের ঘুম ভাঙে দরজায় প্রতিবেশীর তীব্র আঘাতে। কলিংবেলের শব্দও আমরা তখন শুনিনি। দরজা খোলার আগেই আমরা টের পাই বাইরে মানুষের শোরগোল আর আগুন আগুন বলে চিৎকার। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি কালো ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠছে। তার ফাঁকে গনগনে আগুনের লেলিহান শিখা। আগুন যেখানে জ্বলছে তার দক্ষিণ দিকে আমাদের বাসা। ফলে বাতাসের টানে ওই আগুনের তাপ এসে লাগে আমাদের শরীরে। আধো ঘুমে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমরা ঘরের সবাই যার পরনে যা ছিল সেই অবস্থায়ই চার তলা থেকে নেমে যাই।সচেতনভাবে শুধু পকেটে মোবাইল ফোন আর মানিব্যাগটা ঢুকাই। আমার কোলে ১৬ মাস বয়সী মেয়ে। নিচে নেমে দেখি আমাদের ভবনের অন্যরা ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। আমরা গলি পার হয়ে প্রধান সড়কে গিয়ে দাঁড়াই এবং দেখি কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি ক্রমেই উপরে উঠছে।
ফায়ার সার্ভিস আসে। সরু গলি আর ওই সময়ে রাস্তায় অফিসগামী মানুষের চাপ থাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে একটু সময় লাগে। এ রকম বিপদের মুহূ্র্তে দুই ধরনের লোক খুব সক্রিয় থাকে। একশ্রেণির মানুষ ঘটনাস্থলে দৌড়ে যায় এবং বিপদাপন্ন মানুষকে উদ্ধারে নিজের জীবন বাজি রাখে। আরেক শ্রেণির মানুষ ওই বিপদে সুযোগ খোঁজে এবং বিপদাপন্ন মানুষের ঘরে ঢুকে যা পায় তা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ রকম একজন পুড়তে থাকা একটি ঘর থেকে একটি টেলিভিশন বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয়রা তাকে ধরে বেদম পেটায়। আবার ওই এলাকার কিছু দোকানদার, কিছু ভবঘুরে, কিছু শিক্ষিত মানুষ কেউ কেউ রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করেন, কেউ ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে সহায়তা করেন, কেউ আগুনে পোড়া ঘর থেকে মানুষকে বের হতে সহায়তা করেন।
ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা শেষে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে যখন আমরা বাসায় ফিরি অক্ষত; তখন আমার ভীতসন্ত্রস্ত স্ত্রী বলেন, ‘চলো এই শহরে আর থাকার প্রয়োজন নেই।’
কিন্তু আমরা কোথায় যাব? আমাদের হয়তো গ্রামে ঘর আছে অথবা নেই। হয়তো মফস্বল শহরে মাথাগোঁজার ন্যূনতম ঠাঁই আছে, অথবা নেই। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমরা খাব কী? আমাদের রুটিরুজি তো এই স্বপ্নের শহরে বাঁধা। আমাদের ক্যারিয়ার এই শহরের লাল-নীল বাতি আর সড়কের জ্যামের সঙ্গেই সম্পর্কিত। ফলে আমরা কোথায় যাব এই শহর ছেড়ে?
কিন্তু এই শহর যে আমাদের প্রতিদিন ভয়ের মধ্যে রাখে। যেদিন আমাদের বাসার উল্টো দিকে গ্রিন রোড আইবিএ হোস্টেলের ভিতরে আম বাগান এলাকায় ওই আগুন লাগে, তার দুদিন আগেই (পয়লা মে) অদূরে কারওয়ানবাজারের একটি মার্কেট পুড়ে ছাই হয়। সেই আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায় বহুদূর থেকে। তখন ওই এলাকার সব আবাসিক ভবনের মানুষও নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। আগুনে বাজারের হলুদ-মরিচের গুদাম পুড়ে যাওয়ায় তার তীব্র ঝাঁঝে মানুষের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহর, এই মহানগরী, এই রাজধানী ঢাকা বস্তুত একটি পারমাণবিক বোমার উপরে অবস্থান করছে। এর পেটের ভেতর দিয়ে যে গ্যাসের লাইন চলে গেছে, তা কতটা ভয়াবহ সেটি উত্তরায় পুরো একটি পরিবার পুড়ে গিয়ে প্রমাণ করেছে।এর কিছুদিন পর বনানীতে একটি পুরো ভবন বিধ্বস্ত হয়ে সেটি দ্বিতীয়বার প্রমাণ করেছে। যদি এই শহর কোনোদিন বড় ভূমিকম্পের শিকার হয়, তাহলে এই গ্যাসের লাইন বিস্ফোরিত হয়ে পুরো শহর জ্বলে যাবে। কোনো উদ্ধারকারীকেও হয়তো তখন পাওয়া যাবে না।
ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে মূলত কিছু লোভী আর স্বার্থান্বেষী মহলের লালসায়। এখানের ভবনের মালিকদের একটা বড় অংশই এক ইঞ্চি জায়গাকে মনে করেন নিজের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান। যে কারণে তাদের বাড়ির সামনে বা আশপাশে কোনো খোলা জায়গা থাকে না। এই শহরে যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গে কাঁচামালের বাজারের সাথে কোনো তফাৎ থাকে না। এই শহরের ওপর দিয়ে যেসব বিদ্যুৎ লাইন চলে গেছে, সেগুলো কতটা নিরাপদ, তা মানুষকে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হয়।
নদীভাঙা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুরারোগ্যের শিকার হয়ে অথবা একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যে দরিদ্র মানুষগুলো এই শহরে আসে, তারা কোথায় থাকবে? ফলে সরকারি জায়গায় গড়ে ওঠে বস্তি। এসব বস্তি আর কলোনি ঘিরে থাকে একশ্রেণির ক্ষমতাবানের আধিপত্য। থাকে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। ফলে এখানে আগুন লাগবে। প্রাণ দেবে ওই সাধারণ মানুষরা, যাদের দ্বন্দ্ব আর দোটানা নিজের জীবনের সাথে, পেটের সাথে। ফলে যখন আগুনে তার ঘরটি পুড়ে যায় তখন সে রাস্তায় দৌড়ায় আর বলে, আহারে এই শহরে আইলাম ক্যান…?
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।