সোজা কথা
বাড়ছে নগর, দায়িত্বও বাড়ছে
ঐতিহ্যবাহী ঢাকার ইতিহাস অনেক পুরোনো। ঢাকাকে রাজধানী করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুক্তি ছিল। ঢাকাকে ঘিরে আছে চারটি নদী। শুধু কি তাই? কত অসংখ্য খাল এই শহরকে পরম মমতায় জড়িয়ে ছিল, যার বেশির ভাগেরই চিহ্ন খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। কত সুন্দর করে এই মহানগরীকে তিলোত্তমা বানানো যেত, যদি শুরু থেকেই হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর মতো পরিপাটি করে গোছানো হতো শহরটি।
প্রকৃতির সব আশীর্বাদ থাকা সত্ত্বেও ঢাকা চরম অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছে শুরু থেকেই। খালগুলো এখন হারিয়ে গেছে বিশাল বিশাল অট্টালিকার ভিড়ে আর যেগুলো কোনোরকমে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে সেগুলো বরং না থাকলেই বোধ হয় ভালো হতো। ঢাকার দুঃখের সাতকহন লিখে শেষ করা যাবে না। তাই ঢাকা নিয়ে কথা বলতেও কষ্ট হয়, তারপরেও পারা যায় না কিছু না বলে।
সম্প্রতি ঢাকা জেলার ১৬টি ইউনিয়ন পরিষদকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (নিকার)। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বেরাইদ, বাড্ডা, দুন্নি, ভাটারা, সাঁতারফুল, হরিরামপুর, উত্তরখান ও দক্ষিণখান যুক্ত হবে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত হবে শ্যামপুর, মাতুয়াইল, ডেমরা, সারুলিয়া, দনিয়া, মান্ডা, নাসিরাবাদ ও দক্ষিণগাঁও ইউনিয়ন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাইরে ঢাকা জেলায় আরো ৮১টি ইউনিয়ন পরিষদ ছিল। এর মধ্য থেকে উল্লিখিত ১৬টি ইউনিয়ন ঢাকার দুই সিটিতে যুক্ত হবে। মূলত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিধি বাড়ানোর জন্য ইউনিয়নগুলোকে যুক্ত করা হলো। ১৬টি ইউনিয়ন যোগ করার ফলে আয়তন বাড়ছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। একই সঙ্গে মহানগরের আয়তনও বাড়ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এখনকার আয়তন ৮২ দশমিক ৬৩৮ বর্গকিলোমিটার আর এর সঙ্গে আটটি ইউনিয়ন যুক্ত হলে উত্তর সিটির মোট আয়তন হবে ১৬০ দশমিক ৭৬৮ বর্গকিলোমিটার।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিদ্যমান আয়তন ৪৫ বর্গকিলোমিটার আর এর সঙ্গে আটটি ইউনিয়ন যুক্ত হলে মোট আয়তন হবে ১০৯ দশমিক ১৯ বর্গকিলোমিটার। নতুনভাবে যুক্ত হওয়া আটটি ইউনিয়নের আয়তন ৬৪ দশমিক ১৭ বর্গকিলোমিটার।
ঢাকা শহরের আশপাশে উপশহর হিসেবে গড়ে ওঠা ১৭৮.৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা যুক্ত হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি)। এর মাধ্যমে দ্বিগুণেরও বেশি হচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আয়তন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ডিএসসিসির বর্তমান আয়তন ৪৫ বর্গকিলোমিটার এবং ডিএনসিসির আয়তন ৮২.৬৩ বর্গকিলোমিটার। দুই সিটি করপোরেশনের মোট আয়তন ১২৭.৬৩ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ডিএসসিসি ডিএনসিসির চেয়ে ৩৭.৬৩ বর্গকিলোমিটার ছোট। আর সম্প্রসারিত হওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশনের মোট আয়তন হবে ৩০৬.৩৮ বর্গকিলোমিটার, যা আগের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। সম্প্রসারণের পর ডিএসসিসি ৮৮.০৪ বর্গকিলোমিটার ছোট থাকবে ডিএনসিসি থেকে।
শহরের পরিধি তো বাড়ল, সেই সঙ্গে বাড়ল ঢাকার দুই নগরপিতার দায়িত্বও। কারণ এখন হানিমুন পিরিয়ড শেষ দুই মেয়রের জন্যই। ঢাকাবাসী এবার আর কথার ফুলঝুরি ও প্রতিশ্রুতির ঝড়ে ভেসে যাবে না। নানা সমস্যায় জর্জরিত ঢাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে অভিভাবকহীন ছিল। এরপর ক্রমবর্ধমান এই মহানগরী এক সঙ্গে দু-দুজন নগরপিতা পেল, সেই সঙ্গে পেল অনেক অনেক সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি। তবে গত একবছরে নগরপিতারা চেষ্টা করেছেন। এখন স্বীকার করতেও শুরু করেছেন যতটা সহজ তারা ভেবেছিলেন, ততটা সহজ নয় এই নগরবাসীকে বশে আনা। কিন্তু জনগণ তাদের ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি শুনতে নারাজ। কারণ এই সমস্যাগুলোর কথা তারা আগে থেকেই জানেন। যাই হোক, এবার আসি নগরপিতারা আরো কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন বর্ধিত নগরী নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সম্প্রসারিত ডিএসসিসিতে যুক্ত হচ্ছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধ এলাকার ৪০ ভাগ এলাকা। এর মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইলসহ আশপাশের এলাকায় অভিজাত শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা ডিএসসিসি মেয়রের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হবে। যে কেউ ডেমরা-সারুলিয়ার ডিএনডি বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখলেই দেখবেন জলাধার-খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলার চিত্র। পানিনিষ্কাশন নালাগুলো বন্ধ করে ফেলায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে ওই এলাকার কয়েক লাখ মানুষের বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়।
এদিকে ডিএনসিসি এলাকার বাড্ডা, ভাটারা, সাঁতারকুল, বেরাইদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর এলাকার চিত্রও কোনো অংশেই সুখকর নয়। এসব এলাকার বেশির ভাগ সড়ক অত্যন্ত সরু। নেই পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা। কোনো সড়কেই নেই ফুটপাত। সাঁতারকুলের পানিনিষ্কাশন খালগুলো ভরাট করে ফেলছে কিছু আবাসন কোম্পানি। ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) যে খাল দেখানো হয়েছে ১৩০ ফুট, সেখানে আছে মাত্র ১৫ ফুট। খাল পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ। এ ছাড়া এসব এলাকায় পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের তীব্র সংকট।
দুটি সিটি করপোরেশনেই আটটি করে ইউনিয়ন যুক্ত হওয়ার ফলে আয়তনের দিক থেকে দুটিই দ্বিগুণ আকার ধারণ করবে। স্বাভাবিকভাবে বাড়বে জনসংখ্যাও। ঢাকা উত্তরের জনসংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ছয় লাখ ২৬ হাজার ১৭। আর দক্ষিণের জনসংখ্যা হবে ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ২৫ জন। দুই সিটি করপোরেশন মিলে ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৮১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১। তবে জনসংখ্যার এই হিসাব ২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে করা। এরপর পাঁচ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। ধারণা করা যায়, এই সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যখন বর্তমান আয়তন ও জনসংখ্যা নিয়েই যেখানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নাগরিকসেবা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন নগরপিতারা, সেখানে আয়তন দ্বিগুণ করে দুই কোটি নাগরিককে সেবা দিতে তারা কতটুকু প্রস্তুত? নগর পরিকল্পনাবিদরা বারবার বলে আসছেন, সিটি করপোরেশনের বর্তমান কাঠামো ও ক্ষমতা বজায় রেখে আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনার কাজটি কার্যত অসম্ভব। এই দিকটিতে কোনো নজর না দিয়ে দুই সিটির আয়তন বাড়ানো কি বিষয়টিকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা নয়? শুধু কি তাই, সমন্বয়হীনতা আর অনিয়মের বেড়াজালে এই নগরী কি কখনো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে পাবে? বাড়তি এলাকা ও জনসংখ্যার চাপ দুই সিটি করপোরেশন নিতে পারবে তো? তারা তো আপ্রাণ চেষ্টা করে বর্তমানে যে সেবা দিতে পারছেন নগরবাসীকে, বাড়তি চাপে তা থেকেও বঞ্চিত হব আমরা!
১৯৫৯ সালে ঢাকা শহরের মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল। সেই প্লানে ২৯১ একর খোলা জায়গা রাখা হয়েছিল। সে প্ল্যান বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০০ সালে আইন করে বলা হয়েছিল, খেলার মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা ও প্রাকৃতিক জলাধারের কাঠামো ও আকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু ওই আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে দখল প্রতিযোগিতা। এদিকে রাজউকের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে ঢাকার এক কোটি তিরিশ লাখ মানুষের জন্য খোলা জায়গা রয়েছে ৫০৩ একর। ঢাকায় জনসংখ্যা থেমে নেই, ক্রমশ বাড়ছে।
বহুতল ভবন তৈরির দরকার হলে নিশ্চয়ই তা করতে হবে। কিন্তু এভাবে দখল করে অপরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরি করা আইনসম্মত কাজ নয়। ঢাকায় একটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেলে শুরু হয় বহুতল আবাসিক প্রকল্পের কাজ। যেন সব মানুষের থাকার ব্যবস্থা ঢাকাতেই করতে হবে। ঢাকার সৌন্দর্য, নিরাপত্তা, স্বল্প আয়ের আবাসন নির্মাণ, যোগাযোগ ও যান চলাচল, নগরায়ণ কমানো, পরিবেশগত উপাদান, আলো ও শব্দ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে। ঢাকাকে জনবহুল শহরে পরিণত না করে ঢাকার আশপাশের ছোট শহর বা উপশহরে বসবাস বাড়াতে হবে। ঢাকায় যান চলাচলের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনেকেই নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সাভার থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করে অফিস করতে পারবে। সরকারকে পুরান ঢাকার দিকেও নজর দিতে হবে।
ঢাকার আশপাশের অঞ্চলগুলো সিটি করপোরেশনের আওতায় না আসায় অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খলভাবে গড়ে উঠছে। সিটি করপোরেশনের আওতায় এনে বিধিবিধান কার্যকর করতে না পারলে পরে নগর সম্প্রসারণ কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে এই অঞ্চলগুলো নগরের সুবিধা ভোগ করে থাকলেও যথাযথ কর দেয় না। এসব বিবেচনায় দুই সিটির আয়তন বৃদ্ধির বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত তবে আগে সিটি করপোরেশন দুটিকে কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিষ্ঠান দুটিকে কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী করতে হবে।
এটা বরাবরই টক অব দ্য টাউন যে, ঢাকা শহর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে সেবামূলক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা। ঢাকা শহরের নাগরিক সেবা ও সুবিধা নিশ্চিত করার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সংখ্যা ৫০টির বেশি। একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সমন্বয় নেই। ঢাকার দুই মেয়র এ জন্য বিভিন্ন সময়ে সমন্বয়হীনতাকেই সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নগরপিতারা তাঁদের মেয়াদের এক বছর পূরণ করেছেন। প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁরা কাজ করতে পারেননি।
বারবার সমন্বয়হীনতার কথা বলে আসলেও দুই সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মধ্যেও এ ধরনের সমন্বয়ের কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। নগর বিশেষজ্ঞদের মধ্য থেকে প্রস্তাবও এসেছে যে ঢাকা নগরের এই সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ