ক্রিকেট
দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংস্কার না উদ্ভট চিন্তা!
‘ক্রিকেট নামক খেলাটার বিরাট একটা ট্র্যাডিশন আছে। গুড উইল আছে। আমি সেই ট্র্যাডিশনে বিশ্বাসী।’ বক্তা এক সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। দু-দুবার টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলে বিশ্বরেকর্ড করেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের মালিক।
‘দল যখন বিপর্যস্ত। বিধস্ত। তখন দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব ক্যাপ্টেনকেই নিতে হয়। আবার দলকে ঘিরে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটে যখন, সেটা সামাল দেওয়ার দায়িত্বও সেই ক্যাপ্টেনের।’ কথাগুলো এক সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের। ক্রিকেটার হিসেবে যিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন। অধিনায়ক হিসেবেও অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন। আবার টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়াকে এক নম্বরে রেখে ক্রিকেট থেকে সরে গেছেন।
‘টিম যখন হারে লোকে নির্বাচকদের মনে রাখে না। তারা টার্গেট করেন অধিনায়ককে।’ ভদ্রলোক পাকিস্তানি। অধিনায়ক হিসেবে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন।
প্রথম বক্তার নাম- ব্রায়ান চার্লস লারা। দ্বিতীয়জন স্টিফেন রজার্স ওয়াহ। এবং তৃতীয়জন ইমরান খান নিয়াজী। তিনজনই ক্রিকেট সার্কিটে এখন সাবেক। কিন্তু কেউই উপেক্ষিত নন। বরং ক্রিকেট বিশ্বে অনেক সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয় তাঁদের। যদিও এই তিনজনের ক্রিকেট, জীবন দর্শন, যাপিত জীবন-কোনো কিছুকে একসঙ্গে মেলানো যাবে না। তবে তিনজনই সব সময় চেয়েছেন নিজের দেশের ক্রিকেটীয় পতাকাকে উঁচুতে তুলে ধরতে।
কিন্তু হঠাৎ করে ওপরের তিনজনের বক্তব্য কেন? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর। তাদের তিনজনের কথাতেই মৌলিক একটা সুর বাজে। ক্রিকেটের মাঠে অধিনায়কই যখন শেষ কথা, তখন দল নির্বাচনে অধিনায়কেরও কিছু কথা থাকা উচিত।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে নির্বাচক কমিটি নিয়ে মিডিয়ায় যা উঠে এসেছে, তা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে ওই তিন ব্যক্তি ক্রিকেট খেলার সময় এবং ক্রিকেট থেকে সরে গিয়েও খুব পুরোনো মনমানসিকতার মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন! অত্যাধুনিক বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসকদের মস্তিষ্কজাত চিন্তা-ভাবনা থেকে কত দূরত্বে তাঁরা সেটা বোঝানোর জন্যই লারা-স্টিভ-ইমরান এই ত্রয়ীকে টেনে আনা!
লারা- ক্রিকেট ট্র্যাডিশনে বিশ্বাসী। তিনি এখনো নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন দল নির্বাচন করা উচিত নির্বাচকদের। সেখানে অধিনায়কের মতামতটা থাকতে পারে বা থাকা উচিত। কিন্তু সেখানে বোর্ড পরিচালক! দলের ম্যানেজার! কথাটা শুনলে ত্রিনিদাদে বসেও নড়েচড়ে বসতে পারেন ব্রায়ান লারা।
স্টিভ ওয়াহ। সব সময় বিশ্বাস করেছেন অধিনায়কই মাঠে শেষ কথা। এবং অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কর্তারাও একধরনের ঐতিহ্যে এবং সৌজন্যে বিশ্বাসী। অধিনায়কের পদ থেকেও কাউকে সারিয়ে দিতে চাইলে, তারা আগেভাগেই জানিয়ে দেন, ‘তোমাকে নিয়ে আমরা আর ভাবতে চাইছি না। অতএব...।’ রুঢ়, অপ্রিয় সিদ্ধান্তের কথাও তাঁরা বলার সময় একটু সৌজন্যতা দেখান। অর্থাৎ সেখানে নির্বাচকরাই দল নির্বাচনের ব্যাপারে শেষ কথা, বোর্ড কর্তারা নন।
আর ইমরান খান? অধিনায়ক হিসেবে পছন্দের দল পাওয়ার ব্যাপারে সব সময় ছিলেন আপসহীন। যে কারণে তাঁকে অনেকে ডিক্টেটর বলতেন। ইমরান সব সময় সেটার প্রতিবাদ করে বলেছেন, ওটা ভুল। ডিক্টেটর হচ্ছেন তিনি, যিনি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী অর্ডার দেন। বলেন, এই রইল আমার দল। না পাস হলে আমি চললাম। কিন্তু তাঁর দাবি তিনি কখনোই সেটা করেননি। প্রতিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। দলে অপরিহার্য ক্রিকেটারকে বোর্ডকর্তাদের পছন্দ-অপছন্দের বলি হতে দেননি। তাঁর খুব সহজ তত্ত্ব ছিল। ‘লোকে অধিনায়ককে টার্গেট করে। হাঁড়িকাঠে মাথাটা তাকেই দিতে হয়। সুতরাং তাঁর মতামতটাকেই প্রাধানা দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে নির্বাচক প্যানেলে সংস্কার প্রক্রিয়ার যে কথা শোনা যাচ্ছে, সেটা শুনলে ইমরান নিশ্চয়ই হাসবেন। প্রধান নির্বাচক বলে কিছু থাকছে না! ম্যানেজার, কোচ নির্বাচক প্যানেলে যোগ হচ্ছে। ক্রিকেট অপারেশনস কমিটির চেয়ারম্যান ঢুকছেন। সঙ্গে আরেকজন বোর্ড পরিচালক নিয়ে। তারপর তিনিই যাবেন বোর্ড সভাপতির কাছে দলের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য! পত্রিকায় শিরোনাম- হাস্যকর! উদ্ভট!
শুধু কি তাই? না। তার চেয়েও হাস্যকর মনে হয়েছে ক্রিকেট অপারেশনস কমিটির চেয়ারম্যানের কথা শুনে। এই চিন্তাভাবনা নাকি দল নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার জন্য! তাহলে এতদিন কি দল নির্বাচনে অস্বচ্ছতা বলে একটা জিনিস ছিল? কোচের মতামত না হয় দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু তিনি নির্বাচক হলে কি তিনি মাঠে গিয়ে স্থানীয় সব খেলা দেখবেন? নাকি ছুটি কাটাতে চলে যাবেন? সেই বিষয়টাও নিশ্চিত হওয়া দরকার। স্বচ্ছ হওয়া দরকার।
তবে নির্বাচক প্যানেলে ম্যানেজার কেন থাকবেন? তাঁর কাজ কী? দলের খেলোয়াড়দের টিকেট নিশ্চিত করা, হোটেলের বিল পেমেন্ট করা ছাড়া অন্য কী কাজ আছে তিনি করবেন? আবার তিনি যদি বোর্ড পরিচালক হন তাহলে তো ক্ষমতার দৌরাত্ম্য দেখাবেন নির্বাচকদের। ছড়ি ঘোরাতে চাইবেন। বর্তমান যিনি ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন, তিনি তো একই সঙ্গে অনেকগুলো পদ আঁকড়ে বসে আছেন। ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান। জাতীয় দলের ম্যানেজার। বেসরকারি একটা ক্রিকেট একাডেমির কোচিংয়ের দায়িত্বে। ক্লাব কোচিং। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট- বিপিএলে কোনো না কোনো দলের কোচিংয়ে জাড়িয়ে আছেন। তাঁর জন্য তো বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট শব্দটাকে জাদুঘরে পাঠানো হয়েছে! এত দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন লোক যদি আবার নির্বাচক প্যানেলেও ঢুকে পড়েন, তাহলে বলতে হবে তিনি সব কিছুতেই নিখুঁত, নির্ভুল এবং অতিমানব! তাই বিসিবি দায়িত্ব দেওয়ার জন্য অন্য কাউকে খোঁজার কথা ভাবে না।
ভারতের মতো দেশে ‘লোডা কমিশন’ সে দেশের ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত করতে কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। আদালত যেটা বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বিসিসিআই ধাপে ধাপে হলেও সেদিকে এগুচ্ছে। সেখানে ভারতের মতো বিশাল এক দেশে পাঁচজনের জায়গায় তিনজনের নির্বাচক প্যানেল করতে বলা হয়েছে। কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট দূর করতে দক্ষিণ অঞ্চলের নির্বাচক হিসেবে রজার বিনিকে সরিয়ে দিয়েছে সে দেশের বোর্ড। কারণ, তাঁর ছেলে স্টুয়ার্ট বিনি ভারতীয় দলে জায়গা পাওয়ার দাবিদার থাকছেন। ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মতো বিশাল দেশে যদি নির্বাচক প্যানেল ছোট হলে চলে, সেখানে বাংলাদেশে কেন নির্বাচক প্যানেলের কলেবর বৃদ্ধির জন্য এত কিছু করার কথা বলা হচ্ছে!
আসলে কি আমরা ক্রিকেটের ট্র্যাডিশন ভাঙতে যাচ্ছি? দল বিপন্ন, বিধস্ত হলে কোচ-ম্যানেজার কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর সাফল্যে? কে কতটা ভাগ বসাবেন সেই প্রতিযোগিতায় নামেন সবাই। কোচ –ম্যানেজার থেকে বোর্ড কর্তা সবাই। লারা-স্টিভ-ইমরান। আপনারা ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখিত, ক্রিকেটকে বদলাতে পারেননি! বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা এবার ট্র্যাডিশনকে বদলাতে নেমে পড়েছেন। জনা চৌদ্দ ক্রিকেটার বাছতে প্রায় জনা আটেক লোক ঘাম ঝরাবেন। মস্তিষ্ক খরচ করবেন। এই চিন্তাধারাকে কি স্বাগত জানানো যায়?
নাকি দু-একদিন পর কোনো বোর্ডকর্তার মুখ থেকে শুনতে হবে, মিডিয়ায় সব কিছু ঠিকঠাক মতো আসেনি!
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি