ক্রিকেট
আবেগের বিস্ফোরণ ও ক্রিকেটার মুস্তাফিজ
পেশাদার স্পোর্টস সার্কিটে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দায়িত্ব কোনটা? কেউ বলবেন ফুটবল ম্যানেজারের। কারণ, দল ব্যর্থ হলেই আপনার চাকরি নেই। তা আপনার নাম দিয়েগো ম্যারাডোনা, হোসে মরিনহো, লুইস ফন গাল হলেও কিছু আসে-যায় না। চাকরি ধরে রাখার প্রথম এবং শেষ শর্ত একটাই- সাফল্য। দলকে সাফল্য দিতে না পারলে ছাঁটাই। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব আর কী আছে?
আছে। ক্রিকেট ক্যাপ্টেন্সি। যদি আপনি ক্যাপ্টেন্সিটা ঠিকঠাকমতো করতে চান, তাহলে ক্রিকেটের এ-বি-সি থেকে হাইপেন-ফুলস্টপ সব কিছু নিজের জানতে হয়। সে অনুয়ায়ী মাঠে দলটাকে চালাতে হয়। সেখানে একটা সিদ্ধান্ত ভুল হলে হাঁড়িকাঠে মাথাটা ক্যাপ্টেনকেই এগিয়ে দিতে হয়। কে বা কারা দল নির্বাচন করে দিয়েছেন, সেখানে কোনো ভুল ছিল কি না, সেটা কেউ জানতে চাইবেন না। বুঝতে চাইবেন না। আধুনিক জমানায় বড়জোর কোচের কাছ থেকে দু-একটা মেসেজ পেতে পারেন ড্রেসিং রুম থেকে পানির বোতল হাতে নিয়ে একজনের মাধ্যমে। কিন্তু কাজটা ক্যাপ্টেনকেই করতে হয়। সে কারণে ক্রিকেট ক্যাপ্টেনের অনুভূতিটাই বোধহয় একটু আলাদা।
এই আলাদা অনুভূতিটা আরেকবার বোঝা গেল আইপিএল খেলে মুস্তাফিজের দেশে ফেরার দিন মাশরাফির কথায়। মুস্তাফিজ আবেগের বিস্ফোরণ যখন দেশজুড়ে, তখন সেই আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়েও নির্লিপ্ত থাকার কঠিন কাজটা কত সহজভাবে করলেন মাশরাফি! এখানেই বুঝিয়ে দিলেন তিনি অনেক স্ট্রং ক্যাপ্টেন।
ক্রিকেটে স্ট্রং ক্যাপ্টেন মানে আপনার প্রচুর শত্রু। সেটা মিডিয়া থেকে শুরু করে বোর্ড কর্তা। আমজনতা থেকে আমলা-মন্ত্রী পর্যন্ত। আর সেই দেশটা যদি হয় বাংলাদেশের মতো কোনো দেশ, যেখানে ক্রিকেট আর ক্রিকেটার নিয়ে সবাই বোদ্ধা। সবার আবেগতাড়িত হয়ে পড়া। এবং সেই আবেগটা কোন পর্যায়ে সেটা আইপিএলে মুস্তাফিজের খেলা থেকে তাঁর দেশে ফেরা পর্যন্ত ভালোভাবেই টের পাওয়া গেছে। আইপিএলে ভালো খেলছেন মুস্তাফিজ। অতএব আইপিএলে সাইরাজার্স হায়দরাবাদের জার্সি গায়ে মুস্তাফিজের বিশাল ছবি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনে টাঙিয়ে দেওয়া! মুস্তাফিজ দেশে ফিরছেন শুনে ক্রীড়া উপমন্ত্রীর বিমানবন্দরে ছুটে যাওয়া। মুস্তাফিজের মাথায় ‘গোলাপের মুকুট’ পরিয়ে দেওয়া। মিডিয়ার সামনে বলে ফেলা; ‘মুস্তাফিজ জাতীয় বীর। প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দিতে আসা।’ মুস্তাফিজকে নিয়ে এ রকম ভয়ঙ্কর আবেগের মাঝে শঙ্কা উঁকি দেয়, ছেলেটার ক্যারিয়ারটা আমরা নষ্ট করে দেওয়ার পথে এগুচ্ছি না তো!
মুস্তাফিজকে লোকে ভালোবাসছেন। পছন্দ করছেন। কারণ, তাঁর মধ্যে গুণ আছে। তাঁর পরিশ্রম, আন্তরিকতা, সততা, সারল্য, সাফল্য সব কিছু মিলিয়ে মানুষের আবেগের স্রোত বইছে মুস্তাফিজকে ঘিরে। অন্তর্মুখী এই তরুণকে দেখে এবং তাঁর কথা শুনে মনে হয়, তিনি এখনো চান জীবনটাকে সিম্পল রাখতে। চেষ্টাও করছেন। সে কারণে ক্রিকেটীয় সাফল্যের আরো অনেক উঁচু শৃঙ্গে পৌঁছানো সম্ভব তাঁর পক্ষে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আমাদের বহির্মুখী যে কর্মকাণ্ড তাতে সংশয় তৈরি হচ্ছে; মুস্তাফিজ ঠিক থাকতে পারবেন তো!
আইপিএল ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি-ভিত্তিক ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ। সেখানে মুস্তাফিজ ভালো খেলেছেন। তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেখানেও মুস্তাফিজের বড় একটা ভূমিকা আছে। তা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। মুস্তাফিজ প্রতিভাবান সেই স্বীকৃতি আইপিএলেও মিলেছে। সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের পুরস্কারটা হাতে নিয়েই তিনি দেশে ফিরেছেন। আগামী দিনের কথা বিবেচনায় আনলে বলতে হবে, মুস্তাফিজ জাতীয় সম্পদ। কিন্তু আইপিএল থেকে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে তাঁকে নিয়ে যা হলো, সেটা কী একটু বাড়াবাড়ি নয়! এবং এর মধ্যে কুড়ি-একুশ বছরের ছেলেটার মাথাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার শঙ্কা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কি! বিমানবন্দরে যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী গোলাপের মুকুট পরিয়ে দিলেন মুস্তাফিজের মাথায়। এটা কি মিডিয়া কাভারেজের জন্য? নাকি তাঁকে অনুপ্রাণিত করার জন্য?
গোলাপে কিছু কাঁটাও থাকে। ভয় সেই কাঁটা মুস্তাফিজের মাথায় না লাগে। তাঁর যন্ত্রণা বাড়িয়ে না দেয়। আসলে মুকুট যার মাথায়, যন্ত্রণা তাঁরই বেশি। অন্যরা সেটা টের পান না। জানি মুস্তাফিজ সাবধানী। তিনি প্রতিভাবান। তবে সেটা এখনো পুরোপুরি বিকশিত নয়। তাই প্রতিভাকে কঠিন নিয়মে বাঁধা খুব জরুরি। সেটা মুস্তাফিজ বুঝলেও আমরা কি বুঝতে পারছি?
মুস্তাফিজ ক্রিকেট বিশ্বের সেরা উদীয়মান ক্রিকেটার। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু গ্রেট বা মহানদের তালিকায় নাম লেখাতে হলে তাঁকে আরো অনেক কাঁটা ছড়ানো পথ পাড়ি দিতে হবে। সেই পথ পাড়ি দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়েই হয়তো মুস্তাফিজ এগুচ্ছেন। তাঁর একান্ত নিজস্ব কিছু অ্যাম্বিশানও হয়তো আছে। থাকা স্বাভাবিক। যদিও কথাবার্তায়, চাল-চলনে মুস্তাফিজ এখনো সাতক্ষীরার সেই পাড়ার ছেলেটাই। বাইরের জগতে তাঁকে নিয়ে কী রকম তোলপাড় হচ্ছে সেটা হয়তো তিনি অন্তর্জগৎ দিয়ে বোঝার চেষ্টাও করছেন না। আর না করাটাই শুভ লক্ষণ। কিন্তু কতক্ষণ?
বাংলা অভিধানে ‘উদীয়মান’ শব্দটার যা অর্থ লেখা আছে এবং সেটা যদি ঠিকঠাক বুঝতে পারি, তাহলে বুঝি মুস্তাফিজ এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সার্কিটে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত নন। তবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন। এ রকম একটা সময়ে তাঁকে ‘জাতীয় বীর’-এর খেতাব-টেতাব দিয়ে আমরা কি পরোক্ষভাবে ওর ভেতরের খিদেটা শেষ করে দিতে চাইচ্ছি! সেটা সাধারণ মানুষ থেকে মন্ত্রী সবাই। জাতীয় বীরদের সরণিতে মুস্তাফিজকে রাখলে কেউ আপত্তি করবেন না। কিন্তু তার আগে ক্রিকেট গ্রহে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত হতে দিন। ক্রিকেট বিশ্বই ওর মূল্যায়ন করবে। যেটা তারা করতে শুরু করেছেন। ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে মুস্তাফিজ নিজেকে, নিজের জীবনকে, নিজের দেশকে মেলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন। ওকে মাথা উঁচু করে দেশের হয়ে লড়াইটা করতে দেওয়াই হোক আমাদের কাজ।
এবং এই কথাটা বোধহয় সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছেন মুস্তাফিজের ক্যাপ্টেন মাশরাফি। তাই তিনি বলতে পারেন, ‘ও তো দেশের হয়ে আবির্ভাবেই সফল। দারুণ পারফরম্যান্স করেছে। আইপিএল দিয়ে মুস্তাফিজকে মাপতে যাওয়ার কী আছে!’ সত্যিই তাই। আইপিএলে আমাদের মুস্তাফিজ ‘দ্য ফিজ’ হয়ে যেতে পারেন। সেটা আমাদের আবেগতাড়িত করতে পারে। কিন্তু আমাদের ক্রিকেটীয় চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, বোধ-বুদ্ধিতে ‘দেশ কনসেপ্ট’-টা আরো একটু গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আইপিএল থেকে মুস্তাফিজের দেশে ফেরার দিনে সেটার প্রতিধ্বনি শোনা গেল শুধু মাশরাফির কথায়। বাকিদের কথা শুনে মনে হলো, হায়! আমরা অতিরঞ্জিত করতে কত ভালোবাসি!
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি