ক্রিকেট
দ্বি-স্তরে দল নির্বাচন গবেষণার বিষয় হতে পারে
সব যোগ্যতা থাকার পরও মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর মাথায় কেন টেস্ট ক্যাপ উঠল না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে গোটা একটা বই লিখে ফেলা যাবে। আবার সেই নান্নু কীভাবে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়েছিলেন, সেটাও আগামীতে বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেসের জন্য গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে একটু-আধটু ক্রিকেট রিপোর্টিং করার সুবাদে কাছ থেকে বহু মানুষের মুখোশ পরা মুখ দেখার সুযোগ হয়েছে। মিনহাজুল আবেদিন সেই মানুষগুলোর মুখোশের আড়ালের চেহারাটা তাঁর ক্রিকেট-উত্তর জীবনেও চিনতে পেরেছেন কি না সন্দেহ আছে। অবশ্য চেনা কঠিন। কারণ, মুখোশ পরা মানুষগুলোর পারফরম্যান্স দুর্দান্ত!
আবার নান্নুর সমস্যা ছিল তাঁর ক্রিকেটীয় দর্শন। তিনি মনে করতেন দলে জায়গা পাওয়ার জন্য তাঁর ব্যাট যথেষ্ট। রান আর পরিসংখ্যান তাঁর হয়ে কথা বলবে। তাই তিনি অন্যদের খুশি করার পথে হাঁটতে চাননি। বরং সোজা সাপটা এমন কথা বলেছেন, যা শুনে মনে হতো, এত স্রোতের উল্টো পথে সাঁতার কাটায় বিশ্বাসী!
না। শুধু নান্নু নন, অনেকেই স্রোতের উল্টো পথে সাঁতার কাটাতে অভ্যস্থ। তবে সফল হয়েছেন খুব কম লোক। যারা হয়েছেন, তারা অবশ্য নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিজে গেছেন। সেটা শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সাফল্যে। তাই তাঁরা অতি বিরাট হয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ স্রোতে গা ভাসাতে পারেননি আত্মসম্মান বোধের কারণে। তাই মাঝপথে সরে দাঁড়িয়েছেন। তবু নিজের খেলোয়াড়ি কিংবা সংগঠক জীবনে অর্জিত সম্মানটুকু বিসর্জন দেননি।
সতের বছর আগে নান্নু কীভাবে বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়েছিলেন, সেটা অনেকের জানা। তবু ইতিহাসের নির্যাসটুকু বলতে হচ্ছে। প্রথমে তাঁকে দলে রাখা হয়নি। নির্বাচকদের সেই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ছিল ক্রিকেট মহল। অবশেষে নির্বাচক কমিটিকে বিলুপ্ত করে বিকেএসপিতে বোর্ডের নির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় নির্বাচক কমিটি বিলুপ্ত করে নান্নুকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আর বিসর্জন দিতে হয়েছিল, উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান জাহাঙ্গীরের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নকে। সান্ত্বনা হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড যাওয়ার সুযোগ! বোর্ডের সেই সিদ্ধান্তটা যে সঠিক ছিল নান্নুর ব্যাট তা প্রমাণ করেছিল। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচের নাম মিনহাজুল আবেদীন নান্নু! অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ম্যাকগ্রা-ওয়ার্নদের বিপক্ষে দারুণ একটা হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ‘দারুণ’ শব্দটা অবশ্য সেই সময়ের বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের প্রেক্ষাপটে। ইয়ান চ্যাপেল, বিল লরি, ইয়ান বোথাম, জিওফ বয়কট সবাই বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটাই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে আসল লোক।
শক্ত প্রতিপক্ষ মাথায় চেপে বসলে ভালো ব্যাটসম্যানদের প্রথম কাজ হয় স্ট্রাইক রোটেট করা। সেটাই করে গেলো ও।’ বিল লরির কথাটা এত বছর পরও কানে বাজে। প্রথা ভেঙে নির্বাচক কমিটি বিলুপ্ত করে বোর্ড একজন ক্রিকেটারকে দলে ঢুকিয়েছিল! সেটা সঠিক প্রমাণের কঠিন চ্যালেঞ্জে যিনি উতরে গিয়েছিলেন তাঁর নামও মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। সেই লোকটা ঘরোয়া ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করার পরও জাতীয় দলে ডাক পেলেন না। আবার যাঁরা রান-টান করা দূরে থাক, প্রথম একাদশে জায়গা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেননি তাঁরা বাংলাদেশে দলের অধিনায়কও বনে গেছেন! আর তা নিয়ে বিশ্বক্রিকেটে হাসাহাসি হয়েছে!
তবে এখনো অনেকের কাছে বড় বিস্ময় নান্নু কেন টেস্ট খেলতে পারলেন না! এর পেছনে কোনো বিশেষ মহলের বিশেষ কোনো নির্দেশনা ছিল কি না! যা নির্বাচকরা অমান্য করতে পারেননি! ছিল কি না বলতে পারছি না। কারণ, নান্নুর ক্যারিয়ার অস্ত যাওয়ার আগে বোর্ডেও বহুরকম পালাবদল হয়েছে। সেই পালাবদলের হাওয়ায় অনেকে অনেক কিছু হয়ে গেছেন। কিন্তু নান্নু কেন টেস্ট ক্যাপ মাথায় নিতে পারলেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে একটা আভাস পেয়েছি বারবার, সাবেক এক প্রধান নির্বাচকের মুখ থেকে। প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে পদত্যাগ করে বেরিয়ে আসা প্রয়াত সেই ভদ্রলোক বহুবার বলেছেন, ‘যেখানে একজন ক্রিকেটারের পারফরমেন্সের প্রতি সম্মান দেখানো যাবে না। যেখানে ক্ষমতাসীনদের অতিলৌকিক নির্দেশ নিয়ে বোর্ডেরই কিছু লোক হাজির হতেন, যেখানে ঘরোয়া ক্রিকেটে সেরা পারফর্ম করা ব্যাটসম্যানের নাম জাতীয় দলের চৌদ্দজনের তালিকা থেকে কেটে দিতে পারেন বোর্ড কর্তারা, সেখানে নির্বাচকের তকমা গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না।’ আর যে নামটা কাটা হয়েছিল সেই ব্যাটসম্যান ঘরোয়া ক্রিকেটে এক মৌসুমে হাজার খানেক রান করেছিলেন। তাঁর নামও মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।
সেই মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, যিনি লম্বা একটা সময় ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে আছেন জাতীয় দলের নির্বাচক হিসেবে। ক্রিকেটার নান্নু নয়, নির্বাচক নান্নু বোধহয় জীবন থেকে একটা অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। স্রোতের উল্টো পথে সাঁতার কেটে লাভ নেই! অতএব জাতীয় দল নির্বাচনের ব্যাপারে দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত নির্বাচক হয়ে থাকলেই বা ক্ষতি কি! নির্বাচক প্যানেলের কাজ তো হতে যাচ্ছে স্কাউটের মতো। কিছু ম্যাচ দেখা। কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম দেওয়া। বিনিময়ে একটা বেতন পাওয়া। কারণ, দল নির্বাচন করবে তো নির্বাচক কমিটি। যেখানে ক্রিকেট অপারেশনসের চেয়ারম্যান, কোচ, ম্যানেজার থাকবেন। তারপর সেটা অুনমোদন দেবেন বোর্ড সভাপতি। ক্রিকেট বিশ্বে যা বেনজির।
অবশ্য এ রকম চিন্তা শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেই সম্ভব। কারণ, এখানে ‘স্বার্থ-সংঘাত’ বলে কিছু নেই। একই ব্যক্তি বোর্ড পরিচালক হচ্ছেন। বেতনভোগী ম্যানেজার হচ্ছেন। গেম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান হচ্ছেন। ফ্রাঞ্চাইজি-ভিত্তিক বিপিএলে কোন একটা দলের কোচ হচ্ছেন। ক্লাব কোচিং করাচ্ছেন। বেসরকারি একটা কোচিং একাডেমি চালাচ্ছেন। ক্লাবের জার্সি গায়ে জাতীয় দলের কোচের সংগে মিটিং করতে যাচ্ছেন! অতিমানবীয় একটা ব্যাপার না থাকলে এত কিছু সম্ভব। তবে এই অতি বিরাটত্বের মাঝে ক্ষুদ্র একটা ইতিবাচক দিকও খুঁজে পাওয়া যায় ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড চালাতে ২৬-২৭ জন পরিচালকের দরকার পড়ে না। দু-একজন লোক থাকলেই চলে!
অতএব লোক দেখানো নির্বাচক প্যানেল রেখে লাভ কি! কোচ- ম্যানেজার-ক্রিকেট অপারেশনের চেয়ারম্যান বসেই দলটা ঠিক করে ফেলতে পারেন। তাতে বোর্ডের খরচও বাঁচবে! তবে হ্যাঁ, এ মাসের শেষ সপ্তাহে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় যখন আইসিসির সভায় দ্বি-স্তরবিশিষ্ট টেস্ট প্রথা অনুমোদন হবে, তখন বাংলাদেশ খুব বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, দেখলেন তো! আমরা আগেভাগেই দ্বি-স্তরবিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি করেছি! আমরাই ক্রিকেট বিশ্বে অনেক ধারণার পথপ্রদর্শক! টেস্ট প্লেয়িং দেশের সংখ্যা বাড়াতে আইসিসি যখন দ্বি-স্তরবিশিষ্ট টেস্ট প্রথা চালু করতে যাচ্ছে তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা দুই স্তরবিশিষ্ট নির্বাচক প্যানেল তৈরি করতে যাচ্ছেন!
মিনহাজুল আবেদীন নান্নু টেস্ট খেলতে পারেননি। তা নিয়ে আক্ষেপ আপনার থাকতে পারে। তবে আপনার আক্ষেপ ঘুচতে পারে অন্য একটা কারণে। বাংলাদেশে দ্বি-স্তরবিশিষ্ট প্রথম নির্বাচক প্যানেলে যদি আপনি থাকেন! এ রকম বৈপ্লবিক একটা সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতি হিসেবে ‘প্রথম বিশ্বকাপ’ এরপর আরেকটা প্রথমের সঙ্গে আপনার নামটা জড়াবে। খারাপ কি! চৌদ্দজনের বিশ্বকাপ দল থেকে যারা আপনার নামটা কেটে দিয়েছিলেন, তাঁরা যেমন আছেন, তেমনি পরবর্তীকালে হাজার রান করার পরেও টেস্ট স্কোয়াড থেকে যারা আপনার নামটা ছেঁটে ফেলেছিলেন, বোর্ডে কিন্তু তাঁরাও আছেন।
আপনি শুধু এখন শান্তির দূত হয়ে থাকুন। প্রতিবাদ-হুঙ্কার- প্রতিস্পর্ধা এসব এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের রূপকথায় থাকতে পারে। বাস্তবে নয়।
সর্বতোগামী অবিশ্বাস্য মানুষ আপনি হতে পারবেন না। প্রতিবাদও করতে পারবেন না। অতএব ভালোবাসায়, শান্তিতে বাংলাদেশ ক্রিকেটে থাকতে হলে কিছু ভাড়া গুনতে হবে। কিছু সেবা দিয়ে যান। মুখে প্রতিবাদ আর প্রতিস্পর্ধা দেখিয়ে টেস্ট ক্যাপটা কিন্তু পরতে পারেননি। আপনার মাথায় যিনি টেস্ট ক্যাপ দিতে চেয়েছিলেন তিনিও পারেননি। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সে সময়ের কিছু মানুষের ব্যক্তিগত অভিসন্ধিতে। তাই প্রতিবাদ করে ভদ্রলোক সরে গিয়েছিলেন। এখন ‘প্রতিবাদ’ শব্দটাই বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি সব জায়গা থেকে উধাও হয়ে গেছে। ক্রিকেট সার্কিটে তার থাকতে হবে কেন?
আর হ্যাঁ, ক্রিকেটে দিন শেষে নির্বাচকদের কেউ মনে রাখেন না। হাঁড়ি-কাঠে মাথা এগিয়ে দিতে হয় অধিনায়ককে। সেটা আপনি নিজেও জানেন। আবার এটাও জানেন, এ দেশে দল নির্বাচনে অধিনায়কের ভূমিকা প্রায় নেই বললে চলে, সেখানে ম্যানেজারকে নির্বাচক কমিটিতে রাখা হচ্ছে! ভালো। কারণ, বাংলাদেশ দল তো এখন সাফল্য পাচ্ছে। বোর্ডকর্তাদের চোখে সেই সাফল্যের পেছনে নির্বাচক, খেলোয়াড়দের চেয়ে কোচ-ম্যানেজারদের ভূমিকা হয়তো অনেক বেশি। তাই তাঁদের আরো একটু ক্ষমতাশালী করতে চাইছেন। তবে শঙ্কার একটা শিরশিরানি বইছে সেখানে। সর্বময় ক্ষমতার আগ্রাসনে ভেসে না যায় বাংলাদেশ ক্রিকেট। দ্বি-স্তরবিশিষ্ট টেস্ট প্রস্তাবের বিরোধিতা করার জন্য বাংলাদেশ আইসিসি সভায় পাশে পায়নি কাউকে! তাহলে কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ? এ মাসে এডিনবরায় ওই প্রস্তাব পাশ হলে বাংলাদেশের লড়াই হবে প্রথম স্তরে পৌঁছানোর। সে রকম একটা চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট কেন এমন একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, নান্নুর টেস্ট ক্যাপ না পাওয়ার চেয়েও আগামীতে এটা বড় গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেটে।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।