ক্রিকেট
ক্রিকেট ঈশ্বর অন্যভাবেও কিছু দেয়
কথাটা বহুবার শুনেছি। পড়েছি। বলেছি। লিখেছি। আবারও লিখতে বসে মনে হচ্ছে; বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া বাক্য; ‘মুকুট যাঁর মাথায় যন্ত্রণাটা তাঁরই বেশি।’ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচকের নতুন তাজ মাথায় নিয়েই যন্ত্রণাক্লিষ্ট না হলেও অস্বস্তিবোধ নিশ্চিয়ই করেছেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। কারণ, প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি ছিলেন নির্বাচক কমিটির সদস্য এবং তাঁর সামনেই বোর্ড সভাপতি ঘরভর্তি সাংবাদিককে জানিয়ে দিলেন, তাঁরা যা দল নির্বাচন করতেন তা কাঁটছাট করতে হয়েছে বিসিবি সভাপতিকে! এবং সেটা প্রতিবারই! মোটা দাগে বললে বলতে হবে; দল নিয়ে বোর্ড সভাপতিকে হস্থক্ষেপ করতে হয়েছে। বোর্ড সভাপতির সামনে নয়, পরে নান্নু আত্মরক্ষা করলেন, ‘এতই যদি হস্তক্ষেপ হতো তাহলে কী আমরা পাঁচ বছর কাজ করতে পারতাম!’ নিখুঁত-সলিড ডিফেন্স বলবেন কীভাবে? বড়জোর বলতে পারেন, ডিফেন্সিভ পুশ।
ক্রিকেট কোচরা ব্যাটসম্যানকে খুব ছোট, সহজ অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটা টিপস দিয়ে থাকেন প্রায়ই। ‘ক্রিকেট হচ্ছে মনসংযোগের খেলা। বোলারের হাত থেকে বল হওয়ার আগ মুহূর্ত থেকে ফিল্ডারদের হাত ঘুরে আবার বোলারের হাত না যাওয়া পর্যন্ত বল থেকে চোখ সরানো যাবে না। এমন কী নন স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকার সময়ও বলটা ভালোভাবে ওয়াচ করতে হবে। বল চোখের আড়াল হলে বিপদ।’ নান্নুর মতো পোড় খাওয়া ক্রিকেটারকে সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় মুর্খতা আর কী হতে পারে। কিন্তু এই নান্নু, মানে প্রধান নির্বাচক নান্নু এখন রীতিমতো নতুন বলের মুখে। কারণ, তিনি যাঁর জায়গায় ব্যাট করতে নামলেন, তিনি ‘নো’ বলে রান আউট! নির্বাচক প্যানেল গঠন নিয়ে বিসিবির অনেক কিছুতে ফারুক আহমেদ একমত হতে পারলেন না বলে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। বোর্ড সভাপতি নতুন প্রধান নির্বাচকের নাম ঘোষণা করলেন। যে নামটা মিনহাজুল আবেদিন নান্নু।
নান্নু। নামটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে গত তিন দশকে বহুভাবে শিরোনাম হয়ে এসেছে। খেলোয়াড়ি জীবনে কখনো তাঁর ব্যাট তাঁকে শিরোনামে নিয়ে এসেছে। কখনো নির্বাচকদের খামখেয়ালিপনার কারণে। কখনো নিজের আলগা কথার কারণে। এবার নিশ্চয়ই তিনি একটু বেশি সতর্ক। এবার নিশ্চয়ই নির্বিরোধী থাকতে চাইবেন। বিতর্কিত পদ্ধতির এক নির্বাচক প্যানেলের প্রধান নির্বাচকের মুকুট মাথায় পরে যতই যন্ত্রণাক্লিষ্ট হন কেন, অন্যদের সেটা বুঝতে দেবেন না সেটাই স্বাভাবিক। অন্যরা যতই তাঁর যন্ত্রণামাখা মুখ খোঁজার চেষ্টা করুক, সেই ক্যামেরায় নান্নুর অন্যমুখই ধরা পড়বে। ফাস্ট বোলারদের বলের আঘাত যদি ব্যাটসম্যানের শরীরে লাগে, দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যানরা সেটা বুঝতে দেন না। মুখে বিরক্তি কিংবা উৎকণ্ঠা ফুটিয়ে তুলতে চান না। শুশ্রূষা নিতে চান না। বরফ-টরফ ঘষতে হতে হলে ড্রেসিংরুমে গিয়ে ঘষবেন। কিন্তু লোকচক্ষুর সামনে নয়। তাতে বোলার মাথায় চড়ে বসবেন। বোলারকে সে সায়কোলজিক্যাল অ্যাডভান্টেজ দিতে চাইবেন না তাঁরা। নান্নুও সেটা জানেন। তাই বিসিবি সভাপতির কথায় ডিফেন্স করেই গেলেন। খানিকটা মাথা নিচু করেই। নতুন উইকেটে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় তাঁকে দিতে হবে। তবে পাঁচ বছর নির্বাচক থাকা মানে নেট প্র্যাকটিস তো আর কম করেননি। কিন্তু নেট আর বাইশগজে পার্থক্য অনেক। তারপর আবার ফিল্ড রেসক্টিশন আইনও বদলে গেছে। যা মোটেও ব্যাটসম্যানের অনুকূলে নয়। অতএব তাঁর সতর্কতা গ্রহণযোগ্য।
তবে সবছিু ছাপিয়ে নিখাদ এক সত্য বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম নির্বাচনে প্রতিবার বোর্ড সভাপতিকে হস্থক্ষেপ করতে হয়েছে। অথবা তিনি করেছেন! যা দল নির্বাচনের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদি সভাপতির ‘করতে হয়েছে’ তত্ত্বে বিশ্বাস রাখতে হয়, তাহলে বলতে হবে তিনি কিছু অযোগ্য লোককে নির্বাচক বানিয়েছিলেন! যাঁরা বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের প্লেয়িং ক্যারিয়ারে। যাঁরা বাংলাদেশকে কিছু ম্যাচও জিতিয়েছেন। প্রশ্ন সেই লোকগুলোর ওপর কেন আস্থা রাখতে গেলেন আবার বিসিবি সভাপতি। এই দুই স্তর, তিন স্তর বিশিষ্ট নির্বাচক প্যানেল তৈরি করে অহেতুক বিতর্কিত এক পদ্ধতির সঙ্গে দেশের ক্রিকেটকে পরিচিত না করে এক সদস্যের কমিটিই করে দিতে পারতেন। দায়িত্বটা তিনি নিতে পারতেন। না হয় ম্যানেজার। না হয় কোচ। তারাই দল নির্বাচন করে নিতেন! তাহলে মিডিয়াও আর ‘হস্তক্ষেপ’ শব্দটা নিয়ে এত কথা লেখার সুযোগ পেত না।
ভুল। অবশ্যই ভুল। তারা লিখত। বলত। কারণ, মিডিয়ার কাজ লেখা। বলা। তারা লিখবে। বলবে। অতীতেও এ দেশে দল নির্বাচন নিয়ে বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে। মিডিয়া লিখেছে। বলেছে। দল নির্বাচন নিয়ে হস্তক্ষেপ হয়েছিল বলেই মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই নান্নুই এবার প্রধান নির্বাচক। প্রধান নির্বাচকের স্বপ্নের রাজসিংহাসনে স্বপ্নের রাজঅভিষেক হলো তাঁর বুধবার। এখন অপেক্ষা তাঁর বৃহস্পতি কতটা তুঙ্গে সেটা দেখার।
ক্রিকেট আসলে জীবনের মতোই। চেয়েও অনেক কিছু পাওয়া যায় না। আবার না চাইতে কত কিছু এসে যায়! একজন নান্নু টেস্ট খেলতে চেয়েছিলেন। পারেননি। সেই নান্নুর হাত ধরে হয়তো অনেক মানুষের মাথায় টেস্ট ক্যাপ উঠবে। ক্রিকেট ঈশ্বর অন্যভাবেই তাঁকে দিয়ে দিলেন। আবার সেখানে এমন দু-একজনের হাতও একটু থেকে গেল, যাদের হাতে কাটা হয়েছিল বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে নান্নুর নাম। যাদের হাতে কাটা হয়েছিল টেস্ট স্কোয়াড থেকে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর নাম! এটাই অদৃষ্ট। কপাল। যে যাই করুন, কপাল খণ্ডানো যায় না! যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়েও কপালের মুকুটও তাই মাথায় নিতে হয়!
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।