ক্রিকেট
ফিজের জন্য ম্যাশের সমানুভূতি
মুস্তাফিজ। নামটার ভাঙা একটা টুকরো হচ্ছে ‘ফিজ’। সেই ফিজে ক্রিকেট বিশ্ব হয়ে পড়ল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। কারণ, তাঁর সাফল্য। আবার সেই ‘ফিজ’-র মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে বিষণ্ণতার ভাঙা টুকরো! কারণ, ওর কাঁধে চোট। যে চোটের অভিঘাত ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে। তার প্রতিক্রিয়া ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের ওয়ালে ওয়ালে। করো কারো মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ছে এক ধরনের আর্তি; ‘আহ, ছেলেটা এই বয়সে ইনজুরিতে পড়ল!’
মুস্তাফিজ খুব অল্প সময়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের তলদেশ দেখে ফেললেন! এখন দেখার অপেক্ষায় অপারেশন টেবিলে ডাক্তারের ছুরি-কাঁচি। ক্রিকেটার কেন, কোনো মানুষই যেটা স্বেচ্ছায় দেখতে চান না। তবে আধুনিক ক্রিকেট যেভাবে ক্রিকেটারদের কাছ থেকে সবকিছু চুষে-নিংড়ে নিতে চায়, সেখানে চোট-আঘাত এড়ানো কঠিন এক কাজ। মুস্তাফিজও এড়াতে পারেননি। কাঁধের চোট জিম্বাবুয়ে সিরিজের সময়। তারপর পাজরে চোট। আইপিএল তাঁকে অর্থ-কড়ি, যশ-খ্যাতির পাশাপাশি হ্যামেস্ট্রিং আর অ্যাঙ্কেল ইনজুরিও দিয়েছে। আর কাউন্টি দল সাসেক্স দিল আবার কাঁধের ইনজুরি। তবে সফলদের জীবনে হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যা আপেক্ষিকভাবে মনে হয়, অ্যাক্সিডেন্টাল সার্কমস্ট্যান্স। ঘটনাচক্রে ঘটে গেছে। মুস্তাফিজের ইনজুরিও ঘটে গেছে। তবে শঙ্কা, এটাই তাঁর জীবনকে অন্য খাতে বইয়ে না দেয়।
কিন্তু সেই শঙ্কা উড়ে যায় সামনে যখন দেখি মাশরাফিকে। রুবেলকে। মাশরাফি, তিনি তো ক্রিকেটারদের ইনজুরি আর ফিরে আসা নিয়ে বিজ্ঞাপন চিত্র বানালে, যেকোনো নির্মাতার প্রথম পছন্দ। বার বার অপারেশন টেবিলে যাওয়া আর মাঠে ফেরার সেরা মডেল মাশরাফি। মুস্তাফিজের সামনে আছেন মাশরাফি। আছেন পাশেও।
লন্ডন থেকে মাশরাফিকে মুস্তাফিজের ফোন। কিংবা ঢাকা থেকে মাশরাফির ফোন মুস্তাফিজকে । একটা বহু চর্চিত এক সত্যকে মনে করিয়ে দিল। নিজে যন্ত্রণা না পেলে অন্যের যন্ত্রণা যথার্থতা বোঝা কঠিন। মাশরাফি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মুস্তাফিজের যন্ত্রণা বুঝতে পারছেন। উপলব্ধি করছেন। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের দীর্ঘপথ সফরে কত বার ইনজুরিতে পড়েছেন মাশারফি। ডাক্তারের ছুরি-কাঁচির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে তাঁর হাঁটু। আর ভেতরে যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়েছে মন। তাই মুস্তাফিজের মনের অবস্থাটা অন্যদের চেয়ে ভালো বুঝতে পারছেন তিনি।
এটাই ‘সমানুভূতি’। মুস্তাফিজের ইনজুরি নিয়ে অন্যদের কথাবার্তা যদি হয় সহানুভূতি, তাহলে মাশরাফিরটা সমানুভূতি। যা অন্যদের সহানুভূতি থেকে ভিন্ন। সতন্ত্র। সহানুভূতিতে আমরা মুস্তাফিজের যন্ত্রণা-কষ্ট থেকে নিজেকে বিছিন্ন রেখে; ‘ইস, ইনজুরি!’ বলে দুঃখ প্রকাশ বা আক্ষেপের মধ্যে আটকে থাকতে পারি। কিন্তু সমানুভূতিতে এই দূরত্ব থাকে না। একজন আরেকজনের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, ভয়, বেদনা, হতাশার জায়গাটায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে ফেলেন। বিশেষ অনুভূতিটা বুঝতে পারেন। অনুভব করতে পারেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এই বিশেষ অনুভূতির উৎসভূমি। মুস্তাফিজের ইনজুরি নিয়ে মাশরাফির কথাগুলো তাই অন্যরকম এক আশাও জাগায়।
সহানুভূতির স্রোতে বইয়ে দেওয়া লোকের অভাব নেই এই সমাজে। কিন্তু সমানুভূতির সূক্ষ্মবোধটা প্রায় অস্তিত্বহীন। কারণ, সবাই নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ব্যস্ত। তাই পেশাগত, পারিবারিক, সামাজিক সব জয়গায় আমরা নিজের পৃথিবীর মধ্যেই আটকে থাকতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ছি। অন্য পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। মাশরাফি কিন্তু সেই পৃথিবীর কথাও মনে করিয়ে দিলেন।
মুস্তাফিজ যখন ইনজুরিতে পড়ে তাঁর ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত , তখন তাঁর পাশে মাশরাফি। অন্যদের ফোন, এসএমএস, ফেসবুক স্ট্যাটাস সব কিছুই সহানুভূতির স্তরে। সমবেদনা আর শুভ কামনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যা মুস্তাফিজের দুঃখ, যন্ত্রণা, হতাশার ওই স্তরে পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু মাশরাফির ফোনটা অন্যরকম সাহস জোগায়। অন্যরকম অনুপ্রেরণাদায়ক হয়ে পৌঁছায় ইনজুরি আক্রান্ত মুস্তাফিজের আজকের পৃথিবীতে।
ক্যারিয়ারের শুরুতে মাশরাফিও ক্রিকেট সার্কিটে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ ইনজুরি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল অন্ধকার এক অনিশ্চয়তার দিকে। দেখেছিলেন তারকাদের নিয়ে বাঙালির আবেগের উল্টো পিঠও। সেদিন বোর্ড কর্তা থেকে ক্লাব কর্তা কেউ কি খোঁজ রেখেছিলেন সেই মাশরাফির, যিনি ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে সাত-আটদিন পড়েছিলেন মালিবাগের ঢাকা কমিউনিটি ক্লিনিকে! সেদিক থেকে ভাগ্যবান মুস্তাফিজ। ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে থাকলেও তাঁর কাছে পৌঁছাচ্ছে অনেক ফোন। অনেক এসএমএস। খোঁজ-খবর রাখছেন প্রতি মুহূর্তে বোর্ড কর্তারাও। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রীরাও বলছেন, ‘ও দেশের সম্পদ। ওকে আগলে রাখতে হবে।’ এসব কিছু মুস্তাফিজকে আন্দোলিত করছে। আশান্বিত করছে। নিজের খারাপ সময়ে এত মানুষের শুভ কামনা। অনেক বড় প্রাপ্তি।
তবে মুস্তাফিজের ইনজুরিতে এই সমাজ অন্য একটা দিকও দেখল। যেখানে দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধগুলো, সেই সমাজে এখনো দু-একজন অন্যরকম মানুষ আছেন। যাঁরা অন্যের দুঃখ-দুর্দশা-হাতাশায় সহানুভূতি নয়, সমানুভূতিও জানাতে পারেন।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি