অলিম্পিক
তারকার আলোয় জ্বলে উঠুক শান্তি-সাম্যের বাতি
অন্য যে কোনো অলিম্পিক থেকে ব্রাজিলের রিও অলিম্পিক বাংলাদেশিদের কাছে একটু আলাদা। প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে এবারের অলিম্পিকের মশাল বহন করছেন ক্ষুদ্রঋণের জনক শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সঙ্গে গলফ র্যাংকিংয়ের প্রথম ষাটে অবস্থান করে এবারের আসরে মূল পর্বে খেলার সুযোগ করে নিয়েছেন আরেক বাংলাদেশি দেশসেরা গলফার সিদ্দিকুর রহমান। রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের অন্য সব প্রতিযোগীকে কোয়ালিফাই পর্বে উতরে তবে মূল পর্বে খেলতে হবে। সেখানে বাংলাদেশের পতাকা বহনের দায়িত্ব যথারীতি সিদ্দিকুর রহমানের কাছে অর্পিত হলো।
অলিম্পিক গেমস বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বোচ্চ সম্মানজনক প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। অলিম্পিক গেমস প্রত্যেক চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে এর দুটো প্রকরণ গ্রীষ্ম এবং শীতকালীন প্রতিযোগিতা প্রত্যেক দুই বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যার অর্থ দাঁড়ায় প্রায় প্রতি দুই বছর পরপর অলিম্পিক গেমসের আসর অনুষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিসের অলিম্পিয়া থেকে শুরু হওয়া প্রাচীন অলিম্পিক গেমস থেকেই মূলত আধুনিক অলিম্পিক গেমসের ধারণা জন্মে। ১৮৯৪ সালে ব্যারন পিয়ের দ্য কুবেরত্যাঁ সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) গঠন করেন। এই আইওসিই অলিম্পিক গেমস সংক্রান্ত সব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
অলিম্পিক আন্দোলন থেকেই বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে অলিম্পিক গেমসে অনেক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনগুলোর অন্যতম হলো শীতকালীন অলিম্পিকের প্রচলন। প্রতিবন্ধীদের জন্য প্যারালিম্পিক এবং কিশোর ক্রীড়াবিদদের জন্য যুব অলিম্পিক গেমস। এসব পরিবর্তনকে সার্থক করার জন্য আইওসিকে অনেক ধরনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কারিগরি দক্ষতা অর্জন করতে হয়েছে। এসব কিছুর মূলে যে কাজটি প্রাধান্য পেয়েছে সেটা হলো শান্তি ও সাম্যভিত্তিক একটি সুন্দর পৃথিবী নির্মাণ। কিন্তু সেটা কতটুকু সম্ভব হয়েছে? উল্টো অলিম্পিক বছর বছর বর্জন, মাদক, ঘুষ এবং সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার মতো নানা ধরনের বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই প্রতিযোগিতা বন্ধ ছিল এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই প্রতিযোগিতা সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়। এ রকম একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন ঠিকভাবে হলে যুদ্ধের দামামা কমবে, সে আশা পৃথিবীর শান্তিকামী সব জনগণের।
প্রাচীন গ্রিসে দেবতা জিউসের আবাসস্থল অলিম্পিয়ায় ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হতো। মূলত প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরাই এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। সাধারণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছাড়াও এই অনুষ্ঠানে মল্লযুদ্ধ, ঘোড়দৌড়, রথ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। প্রাচীন বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও এই প্রতিযোগিতা চলার সময়ে তা স্থগিত থাকত। এই যুদ্ধ এবং দ্বন্দ্বেও সাময়িক বন্ধ হয়ে যাওয়াকে ‘অলিম্পিকের যুদ্ধবিরতির নীতি’ বলা হতো।
অলিম্পিকের প্রেরণা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগের দিন ব্রাজিল সময় ১৫টা ২২ এবং বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা ২২ মিনিটে মশাল হাতে দৌড়ে অংশ নেন অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর প্রজ্বলিত মশাল হাতে নিয়ে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়ানো বিপুল জনতার তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ২০০ মিটার হেঁটে যান তিনি। মশাল নিয়ে হাঁটার সময় ড. ইউনুস এক হাতে মশাল উঁচু করে ধরে ছিলেন; আর অন্য হাত তুলে তিন আঙুল প্রদর্শন করছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল ‘তিন শূন্য’। এই তিন শূন্যর অর্থ হচ্ছে সামাজিক ও পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনে ‘শূন্য দারিদ্র’, ‘শূন্য বেকারত্ব’ ও ‘শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ’। তিনি অলিম্পিকের সব কর্মসূচিতে একটি সামাজিক মাত্রা যোগ করার জন্য এ প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। এবারের ব্রাজিলে অলিম্পিক মশাল বহনে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট থমাস বাখ নিজেই পছন্দ করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদকে। অলিম্পিক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের নামটা তাই উচ্চারিত হচ্ছে বেশ জোরেশোরেই।
রিও অলিম্পিক উৎসবে মেতে উঠেছে গোটা বিশ্ব। পৃথিবীর তিন বিলিয়ন মানুষ টেলিভিশনে অলিম্পিকের সরাসরি সম্প্রচার উপভোগ করবে। শতাব্দীপ্রাচীন এই ক্রীড়া উৎসবের এবারের আসর বেশ কিছু নতুন ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে অনুষ্ঠেয় প্রথম অলিম্পিক আসর এটি। তবে দক্ষিণ গোলার্ধের তৃতীয় আসর। এর আগে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ও সিডনিতে অলিম্পিকের আসর বসেছিল। প্রতিযোগী দেশের সংখ্যার দিক দিয়েও রেকর্ড গড়েছে রিও অলিম্পিক। এবারের আসরে অংশ নিচ্ছে ২০৭টি দেশ। দক্ষিণ সুদান এবং কসোভো প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছে। এবারের অলিম্পিকে হচ্ছে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ অলিম্পিয়ানের অংশগ্রহণের রেকর্ড। ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে বেঁচে ফেরা নেপালের ১৩ বছর বয়সী গৌরিকা সিং সেই রেকর্ডের মালিক হচ্ছেন। অলিম্পিকের ইভেন্ট তালিকায় আবারও জায়গা করে নিয়েছে গলফ। সর্বশেষ ১৯০৪ সালে মিশৌরি অলিম্পিকে গলফ ইভেন্ট তালিকায় স্থান পেয়েছিল। এক শতাব্দী পর গলফের প্রত্যাবর্তনের পাশাপাশি নতুন ইভেন্ট হিসেবে যুক্ত হয়েছে রাগবি সেভেন। অলিম্পিকের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছে শরণার্থীদের একটি দল। ১০ সদস্যের এই দলের সদস্যরা সমস্যাসংকুল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থেকে ইউরোপের নানা দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই এই মানবিক উদ্যোগ। বিশ্বজুড়ে জঙ্গি হামলা ও সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেছে অলিম্পিক কমিটি। ক্রীড়াবিদ এবং দর্শকদের নিরাপত্তা দিতে ৮৫ হাজার সেনাসদস্য ও পুলিশ মোতায়েন করেছে ব্রাজিল।
এসব কিছুর পরও অলিম্পিকের পর্দা উঠে গেলেই সবার মনোযোগ খেলাতেই আটকে থাকবে বলে আশা। অবশ্য বিশ্বের সেরা ক্রীড়াবিদদের আগেই দর্শকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল রিও। সাম্বার দেশ বলে খ্যাত ব্রাজিলের জাঁকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সে বার্তাই দিল। লন্ডন অলিম্পিকে যে অনুষ্ঠান দিয়ে চমকে দিয়েছিলেন অস্কারজয়ী পরিচালক ড্যানি বয়েল। রিও হাজির করে তার নিজস্ব ঐতিহ্য। ইদানীং উদ্বোধন কিংবা সমাপনী অনুষ্ঠানে যতই চাকচিক্য বাড়ুক; শেষ পর্যন্ত আসল তারকা ক্রীড়াবিদেরাই। ১৭ দিনের এই আয়োজনে আসল আলো তো ছড়াবেন তাঁরাই। ট্র্যাকে উসাইন বোল্ট ঝড় তুলবেন। টানা তিন অলিম্পিকে নয়টি সোনা জয়ের অবিশ্বাস্য এক কীর্তি গড়তেই রিওতে এসেছেন জ্যামাইকার গতিদানব। মত পাল্টে অবসর ভেঙে ফিরে এসেছেন ‘জলদানব’ মাইকেল ফেল্পস। ১৮টি সোনাসহ ২২টি অলিম্পিক পদক অবশ্য গতবারই ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব দিয়েছে মার্কিন সাঁতারুকে।
তবে অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এখানে বোল্ট-ফেল্পসের সঙ্গে বাকিরাও সমান মর্যাদায় আতিথ্য পাবেন। অলিম্পিক ভিলেজ যেন সত্যিকারের এক সাম্যবাদী গ্রাম হয়ে ওঠে সে আশা সবার। ৩০৬টি সোনার জন্য যেখানে প্রায় ১২ হাজার অ্যাথলেট থাকবেন, সেখানে বোল্ট আর সিদ্দিকুরের মধ্যে দৃশ্যত কোনো পার্থক্য নেই। বাংলাদেশ নামের ছোট্ট এই দেশটির অভ্যুদয়ের ৪৫ বছর হতে চলেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরেও বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে ৩২ বছর ধরে। কিন্তু সেই পতাকার ওড়াউড়ি শুধু যেন মার্চপাস্টেই সীমাবদ্ধ! পদকমঞ্চে দেখা মেলেনি কখনো! এবার একটু একটু আশার বিন্দু যেন জমছে। সিদ্দিকুরসহ এবারের অলিম্পিকে থাকছেন বাংলাদেশের সাত ক্রীড়াবিদও। তাঁরা অন্তত পরের প্রজন্মে এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে চাইবেন, ‘আমরাও পারি।’
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়