অলিম্পিক
বোল্ট-বন্দনা!
দেশের নাম জ্যামাইকা। ক্রীড়াবিদের পুরো নাম উসাইন বোল্ট। জ্যামাইকা দেশটি ছোট হলেও এই উসাইন বোল্ট যে এক যুগ ধরে বিশ্ব অলিম্পিকে উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছেন, তা সবাইকেই গৌরবান্বিত তো বটেই, আনন্দও দিয়ে আসছে ক্রীড়াঙ্গনে। বোল্ট পুরোদস্তুর আপাদমস্তক একজন অ্যাথলেট। তাঁর বর্তমান বয়স ৩০ বছর এবং ২১ আগস্ট ছিল জন্মদিন। তিনি এখন থেকে ১২ বছর আগে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিশ্ব অলিম্পিকে জ্যামাইকার হয়ে ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিক দিয়ে শুরু করেন। তার পরে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপর ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে তাঁর শিরোপা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তিনি কাকতালীয়ভাবে এসব খেলায় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ফেলেছেন, তা নয়। এর জন্য তাঁকে দীর্ঘ ১২ বছর কঠিন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
এবারের অলিম্পিকে মাত্র ১১৪.২১ সেকেন্ড ব্যয় করে তিনটি স্বর্ণ জিতে নিয়েছেন। সে হিসাবে ১২ বছরে তিনবারে সব ইভেন্ট মিলিয়ে ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট দৌড়ে সর্বমোট ৩২৫ সেকেন্ড, অর্থাৎ মাত্র ৫.৪২ মিনিট সময় ব্যয় করে তিনবারে সর্বমোট ৯টি স্বর্ণ জিতেছেন তিনি। টানা তিন অলিম্পিকে, তিনটি একই ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয়ের রেকর্ড, যাকে বলা হচ্ছে ট্রিপল ট্রিপল। এ নিয়ে বিশ্ব অলিম্পিকের ইতিহাসে কার্ল লুইস ও পাভো নুর্মির পর তৃতীয় রেকর্ড সৃষ্টিকারী অ্যাথলেট হলেন এই উসাইন বোল্ট। তবে এর জন্য তাঁর প্রবল মনোবল ও আশা-আকাঙ্ক্ষা তাঁকে এ সাফল্য এনে দিয়েছে বলে তিনি নিজেই একাধিকবার সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
প্রতিবার সাক্ষাৎকারের সময়ই তাঁকে খুবই আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। এমনটি কারো ক্ষেত্রেই স্পষ্টভাবে আর কখনো দেখা যায়নি। এমনকি এবারের শেষ ৪০০ মিটারের যে দৌড়ে তিনি অংশ নিয়েছিলেন, সেখানেও খুবই আত্মবিশ্বাসী হিসেবে ক্যামেরায়ও দেখা গেছে। ইভেন্টটি শুরুর মাত্র কিছুক্ষণ আগেও দেওয়া সাক্ষাৎকারে মনে হয়েছিল যে তিনি বলে যাচ্ছেন সাংবাদিকদের, ‘আপনারা বসেন, আমি সোনা এনে দিচ্ছি’ এমন টাইপের অনেকটা। আসলে করলেনও তাই। মাত্র ৩৭.৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে জীবনের ক্যারিয়ারের শেষ সোনাটি জিতে আরেকটি বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করলেন। তিনি বিশ্ব ক্রীড়া কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলী ক্লে এবং পেলের কাতারে নিজেকে স্থান করে নেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। আর শেষে এসে তাই করে দেখালেন। শেষ ভালো যার সব ভালো তার—এ প্রবাদটির সত্যতা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করলেন তিনি।
১৯৮৬ সালের ২১ আগস্টে জন্ম নেওয়া এ অসাধারণ ক্রীড়াবিদের এবারে রিও অলিম্পিকের পর্দা নামানের দিনেই ছিল তাঁর জন্মদিন। এবারে তাঁর জন্মদিনে তাই এটাই ছিল তাঁর জন্য সেরা উপহার। ২১ আগস্টে ৩১তম রিও অলিম্পিকের পর্দা নেমেছে, যা ২০২০ সালের আবার ৩২তম অলিম্পিক হিসেবে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে অবশ্য বোল্ট শুধু দর্শকই থাকবেন। কারণ, তিনি এবারের আসরের পর অবসরে যাচ্ছেন। তবে শেষের দিনে ফুটবলের সূতিকাগার খ্যাত ব্রাজিলীয় নেইমার বিশ্ব ফুটবলপ্রেমীদের জন্য একটি সুখবর দিতে পেরেছেন, সেখানে জার্মানিকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জিত হয়েছে। নেইমার এ সময়ের শুধু ব্রাজিলে নয়, গোটা বিশ্বের একজন অন্যতম সেরা ও জনপ্রিয় ফুটবলার। তবে এ খেলা জয়ের সুনাম নিয়ে নেইমার তাঁর দলের অধিনায়কত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন বলে জানান।
ঠিক এ রকম একটি কাজই করেছিলেন মাত্র কিছুদিন আগে কোপা আমেরিকা বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হওয়ার পর আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি। তিনিও ফুটবল দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে মেসির ভক্তকুলের মধ্যে চরম হতাশার জন্ম দিয়েছিল তখন। তাঁদের ক্রীড়ানৈপুণ্যের কারণে তাঁরাও একেকজন পেলে কিংবা মোহাম্মদ আলীর মতো হয়ে ওঠার পর্যায়ে রয়েছেন। ‘দি গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ নামে পরিচিত বিশ্ব অলিম্পিকের এ আসরে বাংলাদেশ শুধু সব সময়ই পর্যটক কিংবা পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। প্রতিবারেই কোনো না কোনো ইভেন্টে কেউ না কেউ একটু আশার সঞ্চার করলেও শেষ পর্যন্ত তা আর বাংলাদেশের পতাকায় লাল-সবুজের রঙে উজ্জ্বলতা লাগাতে পারে না।
এবার গলফার অ্যাথলেট হিসেবে সিদ্দিকুরের কিছুটা সম্ভাবনা দেখা গেলেও শেষ হাসি হাসাতে পারেননি তিনি। তবে সে ক্ষেত্রে এক মস্কোপ্রবাসী বাংলাদেশি রিদমিক জিমন্যাস্ট আমাদের কিছুটা হলেও মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছেন। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে মস্কোতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্গারিটা মামুন স্বর্ণপদক অর্জন করে একসঙ্গে দুই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে খুশি করতে সক্ষম হয়েছেন। রিটার বাবা আবদুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলের সন্তান। তিনি আশির দশকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য মস্কো গমন করে সেখানে আন্না নামের এক রুশ নারীকে বিয়ে করে সেখানেই স্থায়ী হন। রিটার মা আন্না নিজেও একজন রিদমিক জিমন্যাস্ট ছিলেন। বর্তমানে ২০ বছর বয়সী রিটা মামুন তাঁর মায়ের কাছ থেকেই এ বিদ্যা রপ্ত করতে সমর্থ হন, যা তাঁকে এ সাফল্য অর্জন করতে সহায়তা করেছে। তবে খেলায় পদক তালিকার দিকে তাকালে একটি বিষয় এখানে খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আর তা হলো—শীর্ষ দশে সব সময় বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোই স্থান পেয়ে থাকে। এখানে নিম্নোক্ত পদক তালিকাগুলো দেখলে তাই বোঝা যাবে। এখানে দেশের নাম, স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ ও মোট ইত্যাদি ভাগে যথাক্রমে প্রকাশ করা হলো। (১) যুক্তরাষ্ট্র : স্বর্ণ-৪৩, রৌপ্য-৩৭, ব্রোঞ্জ-৩৬ এবং মোট পদক-১১৬; (২) গ্রেট ব্রিটেন : স্বর্ণ-২৭, রৌপ্য-২২, ব্রোঞ্জ-১৭ এবং মোট পদক-৬৬; (৩) চীন : স্বর্ণ-২৬, রৌপ্য-১৮, ব্রোঞ্জ-২৬ এবং মোট পদক-৭০; (৪) রাশিয়া : স্বর্ণ-১৭, রৌপ্য-১৭, ব্রোঞ্জ-১৯ এবং মোট পদক-৫৩; (৫) জার্মানি : স্বর্ণ-১৭, রৌপ্য-১০, ব্রোঞ্জ-১৪ এবং মোট পদক-৪১; (৬) জাপান : স্বর্ণ-১২, রৌপ্য-৮, ব্রোঞ্জ-২১ এবং মোট পদক-৪১; (৭) ফ্রান্স : স্বর্ণ-৯, রৌপ্য-১৭, ব্রোঞ্জ-১৪ এবং মোট পদক-৪০; (৮) দক্ষিণ কোরিয়া : স্বর্ণ-৯, রৌপ্য-৩, ব্রোঞ্জ-৯ এবং মোট পদক-২১; (৯) অস্ট্রেলিয়া : স্বর্ণ-৮, রৌপ্য-১১, ব্রোঞ্জ-১০ এবং মোট পদক-২৯ এবং (১০) ইতালি : স্বর্ণ-৮, রৌপ্য-১১, ব্রোঞ্জ-৭ এবং মোট পদক-২৬। এ পদক তালিকা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে সবাই উন্নত অর্থনীতির দেশ।
এদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও গ্রেট ব্রিটেন বিশ্ব ক্রিকেটেও ভালো করে, অন্যদিকে জার্মানি ও ইতালি বিশ্ব ফুটবলে ভালো করে থাকে। আর বাকিরা কোনো খেলাই তেমন ভালো করতে পারে না। আমরা ক্রীড়ামোদীরা সব সময়ই সকলের সাফল্যের পক্ষে, কিন্তু বিশ্ব অলিম্পিকে তারা সব সময়ই ভালো করে থাকে। কেন ভালো করে, সে জন্য একটি গবেষণা হতে পারে। অর্থনীতির জন্যই ভালো করে কী না! আর বাংলাদেশ কেন ফি-বছর অকৃতকার্য হয়, সেখানেও গবেষণার দাবি রাখে। সেখানে বোল্টের মতো ক্রীড়াবিদদের ধারাবাহিক সাফল্যের পেছনে কী রয়েছে, তা-ও গবেষণা করে বের করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে ক্রীড়ায় আরো বেশি অর্থ বিনিয়োগ দেশে ভালো ক্রীড়াবিদ তৈরি করতে হবে। জাপানের টোকিওতে ২০২০ সালের অলিস্পিকে আমরা চাই বাংলাদেশ পদক পাবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।