অভিমত
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার হোক জীবন সম্পৃক্ত
আপনি কেন জাতীয় পুরস্কার পেলেন না? প্রশ্নটা শোনার পর কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। সেই নীরবতার মধ্যে পাল্টে গেল তাঁর অভিব্যক্তি। বুঝলাম তিনি বিব্রত। খানিকটা বিরক্ত। কিন্তু উজ্জ্বল মুখে অভিমানের কালো মেঘ বেশিক্ষণ জমিয়ে রাখলেন না। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে বললেন; ‘জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার! আমি কেন পাব?’
তাঁর এই ‘কেন’টা প্রশ্নকর্তাকে আরো বড় ধাক্কা দিল। বুঝলাম প্রশ্ন তখনই তাঁকে করতে হয়, যখন তিনি উত্তর দেওয়ার অবস্থায় থাকেন। আসলে তিনি কেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাননি সেই প্রশ্নের উত্তর তো অন্যদের দেওয়ার কথা। ‘তাই আমি কেন পাব?’ তাঁর এই প্রশ্ন অভিমানজাত। অনুযোগ মিশ্রিত। এবং আমাদের জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের মানদণ্ডের ওপর হালকা টোকা!
এ দেশে যারা জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা সবাই নিজেদের যোগ্যতায় পেয়েছেন। এই বিশ্বাসটা সর্বজনের হলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা মনে করা যায় না। কারণ, জাতীয় পুরস্কারের লম্বা তালিকায় চোখ রাখলে অনেক নামের পাশে এসে চোখ আটকে যাবে। মনে হবে- এরাও! অস্ফুট উত্তরও বেরিয়ে আসে। ‘রাজনৈতিক আনুগত্য!’ আবার পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে দু-একজন আছেন যাঁরা উদারতা দেখিয়ে বলতে পারেন : ‘আমার আগে এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য অন্তত ডজনখানেক লোক ছিলেন! আজও বুঝে উঠতে পারি না আমি কেন তাঁদের আগে পেলাম!’
যাঁদের উদ্দেশে প্রশ্ন, তাঁরা আজ অনেকেই নেই। তবে প্রশ্ন ঠিকই আছে। তাই তানভীর মাযহার তান্না বলতে পারেন : ‘আমি কেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাব?’ হ্যাঁ, কেন পাবেন? স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। সেটা তাঁর যোগ্যতা হতে পারে কি? শাফায়াত জামিলের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করছিলেন। এরপর প্রবাসী সরকার ক্রীড়া পরিষদ গঠন করলেন। প্যাটেল-আলী ইমাম-প্রতাপ হাজরারা উদ্যোগী হয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করলেন। তান্না ম্যানেজার হলেন। কোনো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল জাতীয় পতাকা ওড়ালেন। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’- জাতীয় সংগীত হয়ে বিদেশের মাটিতে বেজে উঠল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ক্রীড়াঙ্গন হয়ে গেল আরো একটা সেক্টর। সেই সেক্টরের একজন মুক্তিযোদ্ধা তান্না। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টা বিবেচনায় নাও আসতে পারে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিকতার ছোঁয়া এলো যে আবাহনীর হাত ধরে তাঁর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের অন্যতম সহযোদ্ধা তিনি। আবাহনীর প্রথম ফুটবল দলটাকে যাঁরা গুছিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম তানভীর মাযহার তান্না। ’৭২-এ কলকাতায় গিয়ে আবাহনীর আকাশি-নীল জার্সি আনলেন। অমলেশ সেন কলকাতা লিগে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর হয়ে খেলছিলেন। সঙ্গে তাঁকেও দেশে ফিরিয়ে আনলেন। সেই থেকে অমলেশ হয়ে গেলেন আবাহনীর। শেখ কামালের মৃত্যুর পর একসময় আবাহনীর সাধারণ সম্পাদক হলেন। দীর্ঘদিন আবাহনীর ফুটবল টিম চালালেন। এসব অবশ্য সংগঠক হিসেবে তাঁর যোগত্যার কোনো মাপকাঠি হতে পারে কি? জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য বিবেচ্য হতে পারে কি? জানি না।
তানভীর মাযহার তান্না। সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট টিমের সাবেক অধিনায়ক। ঢাকার লিগে আজাদ বয়েজের হয়ে দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেলেছেন। ’৮২-৮৩-তে বিজয় দিবস টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হয়ে ক্রিকেট ছাড়লেন। তারপর ক্রিকেট সংগঠক। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সহসভাপতি হলেন। সাধারণ সম্পাদক হলেন। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের এশিয়া কাপ আয়োজন করলেন বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। ’৯৬-এ আবার ফিরলেন। বিসিবির সহসভাপতি হিসেবে। পরবর্তীকালে হলেন বোর্ড পরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ দলের ম্যানেজার। এগুলো জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার জন্য কোনো প্যারামিটার হতে পারে কি?
হয়তো না! তাই তিনি বলতে পারেন, আমি কেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাব? হতাশা-আক্ষেপ-অভিমান মেশানো এই প্রশ্নের মধ্যে অন্যরকম গৌরব মিশ্রিত একধরনের অনুভূতিও যেন কাজ করে। এবং সেটা অহংকার আর তাচ্ছিল্যের অদ্ভুদ এক মিশেল। ‘আমি কেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাব?’ কী আছে এই প্রশ্নের ভেতর? এর বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু প্রশ্নটা যার মুখ থেকে বেরিয়েছে উত্তরও তিনি দিয়েছেন, ‘শেখ কামালকে জাতীয় পুরস্কার পেতে অপেক্ষা করতে হলো মৃত্যুর পর সাড়ে তিন দশক। আমি তাঁর বন্ধু। সহযোদ্ধা। টিমমেট। ক্রিকেট খেলেছি। বাস্কেটবল খেলেছি। ফুটবল চালিয়েছি। ক্রিকেট চালিয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ আয়োজন করেছি। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম ম্যানেজার হয়েছি। শেখ কামালের মৃত্যুর পর আবাহনীর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ক্লাব চালিয়েছি। দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। প্রাণের টানে খেলাধুলায় এসেছিলাম। ছিলাম। জাতীয় পুরস্কারের জন্য নয়। তবে দুঃখ একটা জায়গায়। পুরস্কারটাকে আমরা কোন মাত্রায় নামিয়ে এনেছি। শেখ কামালের আগে কারা পুরস্কার পেয়েছেন! পাচ্ছেন! মৃত্যুর পর কামালকে নিয়ে কত বিভ্রান্তি ছাড়ানো হয়েছিল। অপবাদ দেওয়া হয়েছে। এত বছর পর ওকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দিয়ে আরো একবার অপমান করা হচ্ছে! ’৭৫-এর পর আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে একুশ বছর সময় লেগেছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন সেই আওয়ামী লীগের এক দশকেরও বেশি সময় লাগল শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য এটা বুঝতে!’
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারকে বিতর্কিত করা হয়েছে প্রবর্তনের সময় থেকে। সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়াই পুরস্কার দেওয়া শুরু। এবং সেটা যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এক সাবেক ফুটবালার বলেই ফেললেন, ‘জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার তামাশার পর্যায়ে সেই শুরু থেকেই! তা না হলে মারি দা, রণজিৎ দা, হাফিজ ভাইয়ের আগে আমি কীভাবে পুরস্কার পেলাম!’ গোলাম সারোয়ার টিপু কীভাবে খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পরই পুরস্কার পেলেন তিনি নিজেই জানেন না! তানভীর মাযহার তান্নার মুখে প্রশ্ন, ‘আমি কেন জাতীয় পুরস্কার পাবো!’ এই প্রশ্নগুলো এক ধরনের ক্ষোভের দহন থেকে। জাতীয় পুরস্কারে অনিয়ম দেখে।
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের শুরু থেকেই অনিয়ম। আলগা জিহ্বার গোলাম সারোয়ার টিপু সেটা মনে করিয়ে দিলেন। ‘হাফিজ রশীদ, আব্বাস মির্জা। অনেক বড় ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তো খেলেছেন কলকাতায়। স্বাধীন বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডে কখনো ফুটবল খেলেননি তাঁরা। অথচ তাঁদেরই পুরস্কৃত করা হলো আগে! যে দেশ বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি পাওয়ার আগে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকা ওড়াল। ভারতের মাটিতে ফুটবল খেলল। মুক্তিযুদ্ধে তহবিল জোগাড় করল। ফুটবলে জাতীয় পুরস্কার দিতে হলে সবার আগে দিতে হবে সেই দলটাকে। কিন্তু কী দেখেছিলাম আমরা? যে কারণে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরও বড় অস্বস্তি নিজের মনে। এই পুরস্কারে আনন্দের চেয়ে যন্ত্রণাই বেশি।’ তানভীর মাযহার তান্নার প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া গেল গোলাম সারোয়ার টিপুর কথায়। সেই সঙ্গে তিনি আরো একটা তথ্য জানিয়ে দিলেন। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ফুটবলার হাফিজ রশীদ ছিলেন অবাঙালি। পুরস্কার দেওয়ার এক বছর পরই তিনি চলে যান পাকিস্তানে! আর জাতীয় পুরস্কারের মর্যাদা বাংলাদেশের ধুলাবালিতে গড়াগড়ি খেল। সে সময় যারা পুরস্কার দিয়েছিলেন উত্তর দেওয়ার জন্য তাঁদের অনেকেই এখন নেই। প্রশ্ন অবশ্য তাকেই করতে হয়, যখন তিনি উত্তর দেওয়ার অবস্থায় থাকেন।
একজন তানভীর মাযহার তান্নার অপ্রাপ্তি আর একজন গোলাম সারোয়ার টিপুর প্রাপ্তির মধ্যে কী অদ্ভুদ এক মিল! যাদের প্রশ্ন প্রাপ্তির সীমানাকে নিমিষে গুঁড়িয়ে দেয়। তাই জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার জীবন সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। দেওয়া হোক যোগ্যতার মাপকাঠিতে। রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনা করে নয়। গত এক দশকে বাংলাদেশে ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর হাতে জাতীয় পুরস্কার। সেটা দেখে উচ্ছ্বসিত হবেন ক্রীড়ানুরাগীরা। খানিকটা বিতর্কমুক্ত হবে জাতীয় পুরস্কার। আর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তদের নামের পাশে ব্রাকেটবন্দি শব্দটা মনে করিয়ে দেয়; সময়ের চেয়ে কতো পিছিয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনা।
পাদটীকা : তান্নার অপ্রাপ্তি। টিপুর প্রাপ্তি। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার নিয়ে বিপরীতমুখী দুটো প্রশ্নকে মিলিয়ে দেয় এক মোহনায়।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।