মাশরাফির জন্মদিন
অসীম সাহসী এক ক্রিকেটযোদ্ধা
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অসীম সাহসী এক যোদ্ধার নাম মাশরাফি বিন মুর্তজা। বারবার গুরুতর ইনজুরিও যাকে টলাতে পারে না। কিছুকাল নিতান্তই বাধ্যবাধকতার বিরতি দিয়ে কঠিন সব অস্ত্রোপচারের পর আবারও দুর্দান্ত বেগে, আরো সাহসী হয়ে ফিরে আসেন খেলার মাঠে। সবকিছু উজাড় করে লড়েন মাঠের লড়াইয়ে।
বিশ্বের সব বাঘা প্লেয়ার যেখানে একবার বড়জোর এক-দুবার অস্ত্রোপচারের পরই খেলাকে গুডবাই জানিয়ে দেন, মাশরাফি সেখানে পরপর সাতবার সার্জারির পরও দিব্যি খেলছেন মাঠে। মাশরাফি এক বিস্ময় যেন। বিস্মিত গোটা ক্রিকেট দুনিয়া। এতবার সার্জারির পরও, এত মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ক্রিকেট মাঠে নেমেছেন, এমন নজির বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসে মাশরাফি বিনে দ্বিতীয়টি নেই। তিনি আমাদের নড়াইল এক্সপ্রেস। আমাদের ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলার। তিনি আমাদের ক্যাপ্টেন। দ্য ব্রেভ হার্ট ক্যাপ্টেন।
গত ১ অক্টোবর আফগানিস্তানের সঙ্গে তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ খেলার দিন বল করতে গিয়ে হঠাৎ করে পা মচকে পড়ে গেলেন মাশরাফি। যেন তিনি পড়লেন না, পড়ে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটস্তম্ভ। পড়ে গেল ১৬ কোটি ক্রিকেটভক্ত। একসঙ্গে সবার অন্তর মোচড় দিয়ে উঠল। আহ! মাশরাফি! মাশরাফি পড়ে গেছে! মাশরাফি পড়ে গেছে। গ্যালারিজোড়া দর্শকের চোখেমুখে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল মুহূর্তেই, তা মাশরাফির প্রতি দর্শকদের প্রবল ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।
মাশরাফি শুয়ে পড়েছেন। সকলে বিরাট আতঙ্কে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে সেদিকে। কিন্তু মাশরাফি তো মাশরাফিই। বহু বড় বড় আঘাত যাকে টলাতে পারেনি, ঠিক উঠে দাঁড়ালেন। গ্যালারির দর্শক হৈহৈ করে উঠল উচ্ছ্বাসে। চারদিকে রব উঠল মাশরাফি! মাশরাফি! কয়েক মিনিটের বিরতি শেষ করে আবারও নেমে গেলেন মাঠে। ছয় ওভার বল করে মাত্র ১৫ রান দিয়ে তুলে নিলেন আফগানিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোহাম্মদ শাহজাদের উইকেট। খেলা চলতে থাকল। তিনি পায়ের চোটটা কাউকে টের পেতে দিলেন না। চোট পাওয়ার পরও যেভাবে মরিয়া হয়ে ফিল্ডিং করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, এ কেবল মাশরাফির পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু ব্যথা আর কতক্ষণ লুকিয়ে রাখা যায়। খেলা শেষে ঠিকই জাপটে ধরল মাশরাফির বাঁ পা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠ ছাড়লেন তিনি।
এদিন খেলার মাঠে আরেকটি কাণ্ড ঘটে গেল। আফগানিস্তান ইনিংসের ২৯ ওভারের খেলা চলাকালে এক ভক্ত ছুটে এলো মাঠে। সঙ্গে আরো চার-পাঁচজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। মাশরাফি হঠাৎ খেয়াল করলেন, তাঁর দিকে ছুটে আসছে সবাই। খেলা চালু অবস্থায় এমন দৃশ্যে হঠাৎ করে তাঁর প্রচণ্ড ঘাবড়ে যাওয়ার কথা। প্রথমে খানিকটা গিয়েছিলেনও। সে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন খেলা শেষে। কিন্তু ছেলেটি দৌড়ে কাছে এসে যখন বলল, আমি আপনার ভক্ত। মাশরাফি পরিস্থিতি সামলাতে আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি।
ছেলেটিকে হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে তাকে আগলে রেখেছেন বুক দিয়ে। এই তো মাশরাফি। হৃদয় যার আকাশ-সমান। কলিজা যাঁর ক্রিকেট মাঠের চেয়েও বড়। খেলা শেষে তিনি বলেছেন, বিষয়টিতে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকলেও খেলার মাঠে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটি ঘটেছে। তার ভক্তকে যেন হেনস্তা না করা হয়, সে জন্যও অনুরোধ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে। তবে এভাবে খেলা চলা অবস্থায় মাঠে আসাকে তিনি নিরুৎসাহিতও করেছেন। এটা উচিত নয়। কিন্তু ছুটে আসা একজন ভক্তকে দ্বিধাহীন চিত্তে বুকে টেনে নিয়ে যেভাবে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন, তাতে উদ্বেলিত হয়েছে ম্যাশভক্তদের প্রাণ। সবাই বাহবা দিয়ে বলেছে, এই তো ক্যাপ্টেন। এই তো আমাদের বিশাল হৃদয় ক্যাপ্টেন ম্যাশ!
শুধু ক্রিকেটার হিসেবেই নন, ব্যক্তি মাশরাফিরও রয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা। যাপিত জীবনে চরম আনন্দপ্রিয় মাশরাফি অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের কারণে সকলের পছন্দের তারকা। নড়াইলের মানুষ মাশরাফি বলতে পাগল। শুধু নড়াইল কেন, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় মাশরাফির বিরাট দখলদারিত্ব।
কত বড় বুকের পাটা হলে একে একে সাতবার বাঁ পায়ে অস্ত্রোপচারের পরও মাঠে নামতে পারেন একজন ক্রিকেটার?
বিশ্ববিখ্যাত ইংল্যান্ড দলের অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ মাত্র একটি সার্জারির ভয়েই টাটা জানিয়েছেন ক্রিকেটকে। নিউজিল্যান্ডের গতিদানব শেন বন্ড দুবার সার্জারির পর আর মাঠে নামার সাহস করেননি। ক্রিকেট দুনিয়ায় মাশরাফিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি পরপর সাতটি সার্জারি করেও এখনো ক্রিকেট মাঠে হুঙ্কার ছেড়ে লড়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের কোনো প্লেয়ার যেখানে পারেননি, আমাদের এই অসীম সাহসী বেঙ্গল টাইগারটি সবকিছু তুচ্ছ করে খেলে যাচ্ছেন দেশের হয়ে।
ডাক্তাররা বলেছেন, আর একবার বড়সড় আঘাত পেলে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া বিনে গতি নাই। তবুও মাশরাফি খেলে যাচ্ছেন। যেন নিজের প্রতি তাঁর মায়া নেই কোনো। সব মায়া তাঁর ক্রিকেটের প্রতি। দেশের প্রতিই তাঁর সব ভালোবাসা।
কী প্রবল ভালোবাসা দেশের প্রতি থাকলে একমাত্র আদরের পাঁচ মাস বয়সী ছেলেকে হাসপাতালে রেখে নেমে যেতে পারেন হাজার মাইল দূরের মাঠে। এদিকে, প্রাণপ্রিয় পুত্র তাঁর তখন হাসপাতালে টাইফয়েডের সঙ্গে মূত্রাশয়ের সংক্রমণ রোগে মৃত্যুর মুখোমুখি। মাশরাফি ছেলেকে দেখতে দেশে ফেরেননি। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বসে থেকে ছেলের জন্য দোয়া করেছেন। মাঠে নেমেছেন দেশের মানুষের ভালোবাসার ঋণ শোধ করতে। এ কেবল বিশাল হৃদয় মাশরাফির পক্ষেই সম্ভব। তাই তো তাঁর বীরোচিত জবাব, দেশের মুক্তিযোদ্ধারা যদি পায়ে গুলি লাগার পরও দেশের জন্য যুদ্ধ করে যেতে পারেন, আমি কেন পায়ে সার্জারি নিয়ে খেলতে পারব না? খেলার মাঠে যখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে দেখি মাশরাফিকে, বারবার মনে হয় জন্ম তোমার সার্থক হে বঙ্গসন্তান। বঙ্গভূমি সত্যি ধন্য তোমার মতো নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেটযোদ্ধা পেয়ে।
২০০১ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক ঘটে। অভিষেক ম্যাচে ১০৬ রান দিয়ে তুলে নেন চারটি উইকেট। প্রথম ম্যাচেই তিনি ইঙ্গিত দেন যে মোহাম্মদ রফিকের মতো আন্তর্জাতিক মানের স্পিনার থাকলেও পেস বোলারের যে ঘাটতি ছিল এতকাল, সেই জায়গায় আসছেন তিনি। তবে ব্যক্তিগত তৃতীয় টেস্ট খেলার সময় তিনি হাঁটুতে আঘাত পান। এর ফলে তিনি প্রায় দুই বছর ক্রিকেটের বাইরে থাকতে বাধ্য হন। এরপর ইংল্যন্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলায়ও তিনি সফলতা পান। ৬০ রানে ৪ উইকেট নেওয়ার পর আবার তিনি হাঁটুতে আঘাত পান। এ যাত্রায় বছরখানেক মাঠের বাইরে থাকতে হয় তাঁকে।
২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর ওয়ানডে ক্রিকেটে মাশরাফির অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচে তিনি ৮ ওভার ২ বলে ২৬ রান দিয়ে ঝুলিতে ভরেন ২টি উইকেট। ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার চোটের কারণে দলের বাইরে যেতে হয়েছে মাশরাফিকে। চোটই তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ২০১১ সালের দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ।
২০০৯ সালে অধিনায়কের দায়িত্ব কাঁধে আসার পর থেকে বহু ঝড়ঝাপ্টা গেছে তাঁর ওপর দিয়ে। বারবার ইনজুরিতে পড়েছেন। আবার ফিরে এসেছেন দোর্দণ্ড প্রতাপে। তাঁর কালেই বাংলাদেশ ক্রিকেট সবচেয়ে স্বর্ণসময় পার করছে বর্তমানে। তাঁর নেতেৃত্বেই একের পর এক ধরাশায়ী হয়েছে বাঘা বাঘা সব দল। বাংলাদেশকে এখন আর ক্রিকেটের উদীয়মান শক্তি বলে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না কেউ। বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন বিশ্বের অন্যতম এক ক্রিকেট শক্তি। যে গতিতে এগোচ্ছে দল, তাতে খুব বেশি দেরি নেই, যেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট ‘ক্রিকেট শক্তি’ থেকে ‘ক্রিকেট পরাশক্তি’রূপে আবির্ভূত হবে। তারও নেতৃত্ব মাশরাফিই দিয়ে যাবেন এমনই বিশ্বাস ম্যাশভক্তদের। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে সফলতম অধিনায়ক হিসেবে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি স্থান করে নিয়েছেন প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীর অন্তরে অন্তরে।
তবে মাশরাফিকে এই বিষয়টিও একেবারে না ভাবলে চলবে না, তার ওপর এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট নির্ভর করে আছে। নিজের স্বার্থে না হলেও অন্তত দেশের স্বার্থেই তাকে সুস্থ থাকতে হবে। খেলাকে খেলা হিসেবেই নিতে হবে। এত চাপ নেওয়ার কিছু নেই। গত ম্যাচে যেভাবে আঘাত পাওয়ার পরও মাঠের লড়াইয়ে টিকে ছিলেন, ততটা দরকার ছিল বলে মনে হয় না। মাশরাফিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে মাশরাফি একজনই। তাঁর অতিরিক্ত আবেগ বা শিশুসুলভ পাগলামি করে খেলার মাঠে অতিরিক্ত চাপ নিয়ে শরীরের ওপর প্রেশার নেওয়াটা উচিত হবে না। মাশরাফিকে সুস্থ থাকতে হবে। আরো বহুদিন দিতে হবে ক্রিকেটের নেতৃত্ব।
দেশের ক্রিকেটে আরো অনেক ভালো ভালো বিশ্বসেরা প্লেয়ার আছেন, আরো অনেকেই আসবেন, খেলায় যোগ্যতায় হয়তো এগিয়ে যাবেন অনেক দূরে, তবে মাশরাফি অদ্বিতীয়ই রয়ে যাবেন। জীবন বাজি রেখে দেশকে ভালোবেসে এমন পাগলের মতো মরিয়া ক্রিকেট খেলোয়ার হয়তো বহু শতাব্দীতে একজনই আসে। মাশরাফির জন্য অপরিসীম ভালোবাসা। ভালোবাসা সব বেঙ্গল টাইগারের জন্য। জয় হোক বাংলাদেশ ক্রিকেটের। জয় হোক মাশরাফির।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।