ক্রিকেট
অদম্য মিরাজের এগিয়ে যাওয়া
বাবা মো. জালাল হোসেন একজন অটোরিকশা ড্রাইভার। আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যেই বেড়ে ওঠা পরিবার থেকে ক্রিকেট খেলার প্রতি কোনো সমর্থন ছিল না; ক্রিকেট খেলতেন অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়েই। মেহেদি হাসান মিরাজের ক্রিকেটযাত্রা শুরু হয়েছিল খুলনার কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমির কোচ মো. আল মাহমুদের হাত ধরেই। ওই একাডেমি থেকে বয়সভিত্তিক বাছাইয়ে প্রথমেই অনূর্ধ্ব-১৪ দল, অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৯ দল এবং অধিনায়কত্বেরও সুযোগ পান।
গত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের কথা মনে পড়ে? বাংলাদেশ সেমিফাইনালে হেরে তৃতীয় হয়েছিল। বাংলাদেশের যুবারা যদিও ফাইনালে উঠতে পারেনি, কিন্তু ব্যাটে-বলে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য দেখিয়ে সেই যুবাদের একজনই কিন্তু ওই সিরিজের টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। মিরাজই প্রথম ক্রিকেটার, যিনি যুব বিশ্বকাপে টানা চার ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। ছয়টি ম্যাচে ১৭.৬৬ গড়ে ১২টি উইকেট, সমসংখ্যক ম্যাচ খেলে করেছেন ২৪২ রান। ফলস্বরূপ পুরো টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি।
নিজের জাত চিনিয়ে এসেছেন অনেক আগেই। অপেক্ষা ছিল, কবে জাতীয় দলে ডাক পাবেন তরুণ এই বিস্ময়। অবশেষে সেই স্বপ্নের দিনটাও বাস্তব রূপ লাভ করে চট্টগ্রাম টেস্টের মধ্য দিয়ে। কোচ এবং পুরো টিম ম্যানেজমেন্ট যখন একাদশ সাজানো নিয়েই হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখনো হয়তো সবাই এতটা আশা নিয়েও মিরাজের অভিষেকের কথা ভাবেননি। যাই হোক, অভিষেক হয়ে গেল মিরাজের, তাও ইংল্যান্ডের মতো ক্রিকেটের এক অন্যতম শক্তিধর প্রতিপক্ষের সঙ্গেই।
প্রথম টেস্টের প্রথম দিন, ফিল্ডিংয়ে নামে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের দলীয় স্কোর মাত্রই ১৮। ঠিক তখনই যেন নিজের টেস্ট অভিষেক উইকেটটা নেবেন বলে ঠিক করলেন মিরাজ! অসাধারণ এক ঘূর্ণিতে অনেকটা বোকা হয়ে তাকিয়েই নিজের স্টাম্প ভেঙে যাওয়া দেখলেন বেন ডাকেট, যেটি কি না এই বিস্ময়-বালকের প্রথম টেস্ট উইকেট হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অধিনায়ক মুশফিকের রিভিউয়ে ২১ রানেই আবার মিরাজের নতুন স্বীকার গ্যারি ব্যালান্স। দলীয় সংগ্রহ বড় করার লক্ষ্যে দারুণ খেলতে থাকা রুটকে স্লিপে সাব্বিরের হাতে ক্যাচ বানিয়ে এবং দলীয় ইনিংস একাই টেনে নিয়ে যাওয়া মইন আলীকেও অসাধারণ স্পিনে কাবু করে মুশফিকের হাতে নিজের উইকেট বিলিয়ে দিতে বাধ্য করলেন।
অনেক আশা-ভরসা ও স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা টেস্টের দিকে থাকিয়ে ছিলাম সবাই। দ্বিতীয় টেস্টে প্রথম ইনিংসেও আবার মিরাজের পাঁচ উইকেট। কুক, ব্যালান্স, আলী, বেয়ারস্ট্রোরা একে একেই মিরাজ-ধাঁধায় আটকে গেলেন। ১৪৪ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড যখন লজ্জায় পড়তে যাচ্ছিল, তখন অসাধারণ এক ঘূর্ণিতে আদিল-ওকসের ৯৮ রানের পার্টনারশিপ ভেঙে দ্রুতই ইংল্যান্ডের বড় লিড নেওয়ার চেষ্টায় লাগাম টেনে ধরেন এই মিরাজ। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে বংলাদেশও তখন ভালো একটা লিডের দিকে এগোতে থাকে। ইমরুল কায়েস, মাহমুদউল্লাহ ও সাকিবের ব্যাটে ভর করে ২৭৩ রানের টার্গেট ফাইটিং স্কোরই ছিল নিঃসন্দেহে।
২৭৩ টার্গেট! জিততে হলে সাকিব-মিরাজকেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হতো। কিন্তু ক্যাপ্টেন কুক আর বেন ডাকেটের সাবলীল ব্যাটিং ক্রমেই টার্গেট ছোট করে নিয়ে আসছিল। দলীয় রান যখন বিনা উইকেটে ১০০, চা বিরতি থেকে ফিরে এসে যেন এক নতুন উদ্যমে স্পিনশৈলী দেখাতে লাগলেন মিরাজ।
চা বিরতির আগেও যেই পিচে ঠিকমতো বল ফেলতে অসুবিধা হচ্ছিল, বিরতির ঠিক পরপরই কুক-ডাকেটের শত রানের পার্টনারশিপ ভাঙলেন মিরাজ। স্টাম্পের পেছন থেকে মুশফিক যেভাবে ‘একটা উইকেট, একটা উইকেট’ বলে চিৎকার করে যাচ্ছিলেন, মিরাজ যেন অধিনায়কের ডাকই শুনলেন। বেন ডাকেটের দিকে ধেয়ে আসা স্পিন ঘূর্ণি আটকানোটা একটু অসম্ভবই ঠেকছিল, ফলস্বরূপ বোল্ড এবং পাখির মতো দুই হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মিরাজের উদযাপন। তরুণ এ বিস্ময়ের স্পিন ঘূর্ণিতে ইংল্যান্ডের লম্বা ব্যাটিং লাইনআপ একের পর এক যেন ছোট হতে শুরু করল। সারা সিরিজেই কুক ও রুট রানে ছিলেন না তেমন, কিন্তু এ দুজনই ভয়ংকর হয়ে ওঠার শঙ্কা ছিল; কিন্তু মিরাজের শিকার হয়ে দ্রুতই ফিরে গেলেন জো রুট এবং খুব বেশি স্থায়ী হতে পারেননি কুকও। ম্যাচের সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্টও ছিল হয়তো কুকের উইকেটটা। শেষ দিকে মিরাজের সঙ্গে সাকিবও জ্বলে উঠলে তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার এক অপূর্ব মেলবন্ধনে বিনা উইকেটে ১০০ থেকে আরো ৬৪ রান যোগ করতেই অলআউট ইংলিশরা। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২ উইকেট। ম্যাচটা যেন একা এই মেহেদি মিরাজেরই।
পুরস্কার বিতরণী পর্বে পুরস্কার নিতে এসেও মুখে কোমল হাসি নিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন মুশফিকুর রহিম ভাই, সাকিব ভাই, তামিম ভাইয়ের কথা বলে, যাঁরা কি না মাথার ওপর ছায়ার মতো সব সময় সাপোর্ট দিয়ে গেছেন তাঁকে। এই মিরাজের বক্তব্যই তো বলে দেয়, এই জয় বাংলাদেশ দলের অবিশ্বাস্য এক টিমওয়ার্কের জয়।
চট্টগ্রামে টেস্ট অভিষেকেই ৭ উইকেট, মিরপুর টেস্টে গুনে গুনে নিলেন ১২ উইকেট। আর তাতেই র্যাঙ্কিংয়ে ৩৩তম স্থানে চলে আসে মিরাজের নাম। এ যেন আরো অনেক বড় বিস্ময়, অবিশ্বাস্য এক অর্জন। ঢাকা টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়ে ১২৯ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিলেন বাংলাদেশের ডানহাতি অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক বড় বড় ক্রিকেট লিজেন্ডের কাছ থেকে বাংলাদেশের পাশাপাশি মিরাজের প্রশংসায়ও ভেসে আসছে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ফাস্ট বোলার জেসন গিলেস্পি ইংল্যান্ডের প্রতি ‘সমবেদনা’ জানিয়ে যেমন লিখলেন, ‘এই জয় বাংলাদেশের জন্য বিরাট অর্জন! কী দুর্দান্ত দুটি টেস্ট দেখলাম।’
একাডেমি থেকে বয়সভিত্তিক বাছাইয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ২৫ হাজার টাকা জিতেছিলেন মিরাজ। সেই থেকে তাঁর বাবাও খেলার প্রতি বাধা দেওয়া কমিয়ে দিতে শুরু করেন। খেলা থেকে ফিরেই ঘরে এসে মার খাওয়া, ভয়ে ক্রীড়া সরঞ্জাম বন্ধুর বাড়িতে রেখে আসা—সবই যেন একটু একটু করে বদলে যেতে লাগল। সেই লুকোচুরি করেও ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাওয়া, দারিদ্র্য আর প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নিজের লক্ষ্যের দিকে একাগ্র থাকা। এই মিরাজকে কে-ই বা দাবিয়ে রাখতে পারবে। পারেনি ইংল্যান্ডও। মিরাজ এগিয়ে যাবেই আর তাঁর কাঁধে ভর করে এগিয়ে যাবে স্বদেশ।
এই ‘মিরাজ’ ই তো এক বাংলাদেশ।।
লেখক : সাবেক সভাপতি, স্পোর্টস সাস্ট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।