ক্রিকেট
১৯ পেরোনোর আগেই ১৯ উইকেট যাঁর
উনিশ পেরোনোর আগে তাঁর নামের পাশে ১৯ উইকেট! এবং সেটা মাত্র দুই টেস্টে। তবে হ্যাঁ, সেটা জিম্বাবুয়ে কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নয়। দুর্বল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে! না। ভ্রূ কুঁচকানোর দরকার নেই। ভুল কিছু পড়ছেন না। ‘দুর্বল’ ইংল্যান্ড।
বাংলাদেশে আসার আগে ১৩৩ টেস্ট খেলা অ্যালিস্টার কুকের নামের পাশে টেস্টে ১০ হাজারের বেশি রান। জো রুটকে বলা হয় বিরাট কোহলি, স্টিভেন স্মিথের সঙ্গে একই সরণিতে থাকা ব্যাটসম্যান। মইন আলী লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট করে বহুবার ম্যাচ জিতিয়েছেন। ম্যাচ বাঁচিয়েছেন। লোয়ার অর্ডারে বেন স্টোকস, জনি বেয়ারস্টো। প্রত্যেকে ব্যাট করতে পারেন। এক থেকে এগারো প্রত্যেকের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সেঞ্চুরি আছে। তারপরও দলটা দুর্বল! আর এ রকম একটা দল বেছে নিয়ে ইংলিশ নির্বাচকরা টেস্ট ক্রিকেটকে অপমান করেছেন! এটা লজ্জাজনক! বক্তার নাম বব উইলিস। ভদ্রলোক একসময় ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন। দুর্দান্ত ফাস্ট বল করতেন। বাউন্সার দিতে অভ্যস্ত ছিলেন। খেলা ছাড়ার পরও তিনি বাউন্সার দিলেন। সেটা না লাগল ব্যাটসম্যানের শরীরে, না উইকেটকিপার আটকাতে পারলেন। আসলে লাইন-লেন্থ ঠিক না থাকা বাউন্সার ক্রিকেটের ভয়ংকর সৌন্দর্যের সঙ্গে এক ধরনের রসিকতা। বব উইলিস সেই রসিকতাই করলেন।
বব উইলিস। অনেক বড় নাম। বিখ্যাত ক্রিকেটার। প্রখ্যাত ক্রিকেট ভাষ্যকার। তবে তিনিও যে রসিকতার পাত্র হতে পারেন, সেটা আগে ভাবা যায়নি। যেমন ভাবা যায়নি বব ডিলানের মতো বিখ্যাত লোক নোবেল নিয়ে উক্তি করে সমালোচিত হবেন। আসলে সব বব-ই বোধ হয় মাঝেমধ্যে একটু এলোমেলো হয়ে যান!
বব উইলিসের সাক্ষাৎকার নিতে হলে পাউন্ডের প্রসঙ্গটা আগে আসে। পাউন্ড গুনলে তাঁর সাক্ষাৎকার পাওয়া কঠিন কিছু নয়। যতটা কঠিন ছিল ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের জন্য অনূর্ধ্ব-১৯-এর বাংলাদেশি এক অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজকে সামাল দেওয়া। তারপরও বব উইলিসের কাছে খুব বিনীতভাবে জানতে ইচ্ছে করে—মিস্টার বব, ইংল্যান্ড যদি বাংলাদেশের বিপক্ষে দুর্বল দল বেছে নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটকে অপমান করে থাকে, তাহলে তাদের সবল দলটা কী হতে পারত? আর এই দল যদি এতই দুর্বল হয়ে থাকে, তাহলে সেই একই দল নিয়ে ইংল্যান্ড কেন ভারতে যাচ্ছে পাঁচ টেস্ট সিরিজ খেলতে? আসলে ইংলিশদের আভিজাত্য আর ঐতিহ্যের ঘটি ফুটো হয়ে গেছে। সেখান থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে, আপনি টের পাচ্ছেন না। তাই তিন দিনের মধ্যে বাংলাদেশের কাছে টেস্ট হারের পর আপনি লাইন-লেন্থ খুঁজে না পেয়ে এলোমেলো বাউন্সার ছুড়ছেন! পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের সাফল্যকে অপমান করছেন। একই সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটকেও।
মেহেদি হাসান মিরাজের অফস্পিনে বিদীর্ণ ইংল্যান্ড ক্রিকেট। আর তাতে যন্ত্রণাকাতর বব উইলিস থেকে ইয়ান বোথাম। সবাই। স্যার ইয়ান বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য এই জয়টা অনেক সুখের। অনেক স্বস্তির। তবে ওদের প্রমাণ করতে হবে দেশের বাইরে। নিখাদ সত্যি কথা। কিন্তু সত্যিইটা কি ইংল্যান্ডের জন্যও প্রযোজ্য নয়? তাঁরা কি ভেবেছিলেন, শ’দুয়েক বছর শাসন করে যাওয়া বাংলা এখনো তাঁদেরই আছে। এটা তাঁদের দেশের মাটি। তাঁদের পছন্দের সবকিছু পারেন? তা না হলে অ্যালিস্টার কুকই বা কেন বলবেন, ‘কন্ডিশনই দায়ী!’ বাংলাদেশে কুক কি ইংলিশ কন্ডিশন আশা করেছিলেন? আর ইংল্যান্ড সফরে অন্য দেশগুলো যখন যায়, তাদের জন্য ইংলিশরা কি অন্য কোনো কন্ডিশন আমদানি করে রাখে?
আসলে রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ইংলিশদের কথাবার্তা, মানসিকতায় এখনো রাজতন্ত্রের ছোঁয়া। রাজপুরুষদের জন্য প্রতিকূলতা থাকবে না। আর থাকলে সেই প্রতিকূলতা জয় করার জন্য অন্যরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। এটাই ওরা আশা করে। সে রকম একটা মানসিকতা নিয়ে হয়তো বাংলাদেশ সফরে এসেছিল ইংলিশরা। বাংলাদেশে এসে এ রকম স্পিনিং চক্রবুহ্যে ঢুকতে হবে, যেখান থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়, সেটা তারা ভাবতে পারেনি। আর সেই চক্রবুহ্য থেকে বের হওয়ার রাস্তাটাও তাদের অজানা।
আসলে মেহেদি মিরাজের অফস্পিন খেলার মানসিক কোনো প্রস্তুতি ইংল্যান্ডের ছিল না। শুধু মিরাজ কেন, বাংলাদেশের স্পিনের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের কোনো প্ল্যানিং ঠিকঠাক ছিল না। যে কারণে ও রকম হুড়মুড় করে ধসে পড়ে গেছে ইংলিশদের ইনিংস। ৬৪ রানে ১০ উইকেট হারিয়েছে তারা! হয়তো তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, ভুলটা কোথায় হচ্ছে। তাদের ঠিক জানা ছিল না, করপোরেট জগৎ থেকে ধার করে ক্রিকেটেও ইমরান খান একটা বাক্যের আমদানি করেছিলেন—‘ম্যানেজমেন্ট অব ইনিংস।’ অবশ্য ইংরেজদের যা মানসিকতা তাতে ইমরান খানের কথা ভাবতে গেলে তাদের জাত্যাভিমানে আঘাত লাগতে পারে।
তবে নিজের আবির্ভাবেই ইংলিশদের বড় আঘাত দিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ। দুই টেস্ট সিরিজে ১৯ উইকেট! সনাতনী ব্যাটসম্যানশিপ দিয়ে ওকে সামলাতে পারল না ইংলিশরা। এতে ইংলিশরা অপমানিত হতে পারে। তবে বাকি ক্রিকেটবিশ্ব বিস্মিত হলো ১৯ পেরোনোর আগে তাঁর বিস্ময় সৃষ্টিকারী আবির্ভাবে। ইংলিশরা টুপি খুলে তাঁকে স্যালুট নাই বা করল।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।