মাশরাফির ১৫ বছর
দেখেছেন পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের তলদেশ
দেড় দশক। ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টালে অনেকটা সময়। আর দেড় দশকে যিনি পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের তলদেশ সবই দেখে ফেলেছেন, তার কাছে এটা শুধু সময় নয়। আরো অনেক কিছু। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সার্কিটে দেড় দশক পার করে মাশরাফি বিন মুর্তজা নির্লিপ্ত, নির্বিকার! আর তাঁর এই অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিল, তিনি সময়ের সঙ্গে বসবাস করা মানুষ। যদিও আগামী দিনের ক্রিকেট গবেষকদের কাছে তাঁর অতি মানবীয় কর্মকাণ্ড গবেষণার বিষয় হতে পারে।
১৫ বছরে সাতবার অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে হয়েছে তাঁকে। ডাক্তারের কাঁচি-ছুরির নিচে রাখতে হয়েছে তাঁর পা। ইনজুরির সঙ্গে বারবার লড়াই করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার রেকর্ড গড়তে না চাইলেও গড়ে ফেলেছেন তিনি! ক্যারিয়ারে দাঁড়ি পড়তে পড়তেও আবার বাঁক পরিবর্তন করে বাইশগজে ফিরেছেন মাশরাফি। এটাই তাঁর বড় ক্রিকেটীয় কৃতিত্ব, যা কোনো দিন পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে না। সামনের দিকে ছুটে চলা বাংলাদেশ ক্রিকেট আর ক্রিকেট প্রেস একদিন হয়তো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপতে চাইবে।
এবং সেটাই হবে সবচেয়ে বড় ভুল! পরিসংখ্যান নয়। মাশরাফিকে মাপা উচিত তাঁর সময় আর পারিপার্শ্বিকতা দিয়ে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে মাশরাফি দুটো সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শুরুটা এমন সময় যখন টেস্ট ক্রিকেটের উত্তাপটা বাংলাদেশের গায়ে ভালোভাবে লাগেনি। অথচ নড়াইল থেকে উঠে আসা সদ্য কৈশোর পেরোনো এক তরুণ লাল বল হাতে আগুন ঝরানোর ইঙ্গিত দিলেন। টেস্ট দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক। আবার বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছে, সেই সময় মাশরাফি শুধুই সাদা বলের বোলার! আধা দশকের বেশি সময় টেস্ট ক্রিকেটই খেলা হয় না মাশরাফির! এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে নিউজিল্যান্ড সফরের সময় ওয়েলিংটন পোস্ট যাকে লিখল, ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ তিনি এখন শুধুই একজন মিডিয়াম পেসার। ডাক্তারদের ছুরি-কাঁচির সৌজন্যে তাঁকেও কাট করতে হয়েছে তাঁর গতি। ইনজুরি তাঁর বোলিংয়ের গতি কমিয়েছে; কিন্তু মানসিক শক্তি কমাতে পারেনি। তাই বারবার ফিরে আসতে পেরেছেন।
বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটে ফাস্ট বোলিং করতে পারে। সেই বিজ্ঞাপনের প্রথম মডেল অবশ্যই মাশরাফি। কিন্তু ভাগ্য সেই লোকটার সঙ্গে বারবার নির্মম রসিকতা করেছে। তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে ফাস্ট বোলিংয়ের ভয়ংকর সেই সৌন্দর্য। অনেক কিছু কেড়ে নিয়েও ক্রিকেট-ঈশ্বর তাঁকে বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন দারুণ এক টিমম্যান হিসেবে। সিংহ হৃদয়ের মানুষ হিসেবে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সফলতম অধিনায়ক হিসেবে।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সফল এক অধিনায়ক মাশরাফিকে দেখে বাঙালির হৃদয়ের গহিনে বাজে গভীর এক মর্মর বেদনা। অনুচ্চারিত হাহাকারের মতো বাজে এ দেশের ক্রিকেটে, ‘আহ, টেস্ট ক্রিকেটেও যদি এই লোকটাকে বাংলাদেশ পেত ক্যাপ্টেন হিসেবে!’ মুশফিকের অধিনায়কত্বের প্রতি অগাধ আস্থা রেখেও কথাটা লিখতে হলো। টেস্টেও মাশরাফি অধিনায়ক থাকলে মুশফিক গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে এবং সামনে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের ক্রিকেটটা উপভোগ করার সুযোগ পেতেন। তাঁকে নিয়েও টিম ম্যানেজমেন্টের ছেলেখেলাটা বন্ধ হতো।
‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ শব্দটা ইনজুরি নামক ক্রিকেটীয় জংশনে রেখে মাশরাফি চলে এসেছেন নতুন স্টেশন, যার নাম ক্যাপ্টেন ম্যাশ। মাশরাফি থেকে এখন তিনি ম্যাশ। এবং সেটা বেশি পরিচিতি আর প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাঁর অধিনায়কত্বের কারণে। মাশরাফির ক্রিকেটীয় জীবনের অনুচ্চারিত দুঃখের নামও বোধহয় ক্যাপ্টেন্সি! টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যার পা রাখা, সেই লোকটা টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র চার সেশন! ক্রিকেট-ঈশ্বরের নিজের হাতে লেখা মাশরাফির ক্যারিয়ারের চিত্রনাট্যে তাঁকে বারবার যেমন বীর হিসেবে বসিয়েছেন অন্য রকম এক উচ্চতায়, তেমনি অনেক জায়গায় তাঁকে বানিয়েছেন ‘ট্র্যাজিক হিরো’।
টেস্ট ক্রিকেটে তো অবশ্যই। ৩৬ টেস্ট খেলে কখনো ইনিংসে পাঁচ উইকেট পাননি! অবিশ্বাস্য মনে হবে। গোটা একটা টেস্টে অধিনায়কত্ব করতে পারেননি। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি! আসলে প্রতিভা এমন এক বস্তু, যা সব জায়গায় সব সময় চকচক করে না। ঔজ্জ্বল্য ছড়ায় না। প্রতিভার উপযুক্ত লালন-পালন না হলে তা সব জায়গায় আলো ফেলে না। মাশরাফির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যদিও ১৫ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পার করে এসে মাশরাফি বলতে পারেন, ‘এটাই জীবন। ভালো-মন্দ সবকিছু থাকে জীবনে। আমি ভাগ্যবান। আমি তো ভালো দিকটাই বেশি দেখলাম!’ আসলে এই হচ্ছেন মাশরাফি।
ক্রিকেট মাঠে সাফল্যের পাশাপাশি ওর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ জীবন। পরিণত, অভিজ্ঞ মাশরাফির কাছে জীবনের বেশি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিজের পরিবার। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। কিন্তু এক দশক আগের মাশরাফির কাছে জীবন একটু বেশি বর্ণময় ছিল কী, ক্রিকেট-বন্ধুত্ব আর মাস্তিতে? অবশ্য আজকের মাশরাফি পেশাদারিত্বের সিল মারা এক মোড়কে। বাইরে থেকে দেখে তাঁর ভেতরের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-বেদনা-হতাশা বোঝা কঠিন। সাফল্যে মোড়ানো জীবনটাকে যেমন তিনি দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন ব্যর্থতা-উপেক্ষা-অসম্মান-আর বিষাদের ছোঁয়া লাগা এক জীবনকেও! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর পার করে এসে বাস্তব চেতনায় সেই দিনগুলোকে কি জীবন থেকে খারিজ করে দিতে পারবেন মাশরাফি?
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।