ভিন্ন চোখে
ম্যারাডোনা-ইমরানের ক্রীড়া-দর্শনেও কাস্ত্রো
ফিদেল কাস্ত্রো। অনেকে তাঁকে অনেকভাবে মনে রাখবেন। ইতিহাস ইতিহাসের মতো করে জায়গা দেবে তাঁকে। তবে একটা বলা যায়। ইতিহাসের পাতা একটা নয়। পাতার পর পাতা। কাস্ত্রোর নব্বই বছরের জীবন অনেক লম্বা ইতিহাস, যার মলাটে দুটো শব্দ হয়তো জ্বলজ্বল করবে—‘বিপ্লবী নেতা’।
সেই লোকটার মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে নানা প্রতিক্রিয়া। রাষ্ট্রনায়ক থেকে রাজনীতিবিদ। এঁদের কথা বাদ দিলাম। কারণ, তাঁদের অনেকের কাছে কাস্ত্রো ছিলেন একটা আদর্শের নাম। স্বপ্নের নাম। কারো কাছে রোমান্টিসিজমের প্রতিশব্দ। কিন্তু খেলার জগতের কিংবদন্তি দুই-একজনের কাছে কাস্ত্রো? সেখানেও তিনি কিংবদন্তি বিপ্লবী নেতা! আর বক্তা? পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ইমরান খান। ক্রিকেট গ্রহ থেকে ফুটবল গ্রহে ছুটলে সেখানেও পাবেন কাস্ত্রোভক্ত। বিখ্যাত ভক্ত। যিনি নিজেই কিংবদন্তি। ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কাস্ত্রোর সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল যার অনেক গভীর। যতটা আদর্শিক, তার চেয়ে অনেক বেশি আত্মিক। সম্পর্কটা এমন ছিল যে কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর ম্যারাডোনা বলতে দ্বিধা করেননি, ‘ফিদেল ছিলেন আমার বাবার মতো। আমি আমার দ্বিতীয় বাবাকেই যেন হারালাম।’
কাস্ত্রো। ইমরান। ম্যারাডোনা। এঁদের জীবন-দর্শনে মিল যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যায় অমিল! মিলে যাওয়া দর্শনটি হলো প্রতিষ্ঠানের সামনে মাথা না নুইয়ে নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা।
কাস্ত্রো—সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জলপাই রঙের পোশাকটাকে বানিয়ে ফেলেছিলেন শান্তির পতাকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির নাকের ডগায় বসে কী স্পর্ধাই না দেখিয়েছেন তিনি। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা। সে সময় থেকেই রাজনীতি আর মার্কসবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা। তারপর মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী আর দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। স্বৈরাচার উৎখাত করে তিনি আমেরিকার কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন সমাজতন্ত্র। মার্কিন হুমকি-ধমক উপেক্ষা করে তিনি দেশ চালিয়েছেন। আবার কারো কারো মতে দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই হেঁটেছিলেন স্বৈরাচারের পায়ের জুতো পরেই! তবে যত দিন বেঁচে ছিলেন, তিনি উগরে দিয়েছেন মার্কিনিদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ আর বিদ্বেষ। ঘন সবুজ জলপাই রঙের উর্দি পরা দাড়িওয়ালা মানুষটা বিশ্বে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক দেশের পতন দেখেছেন। তারপরও থেকেছেন নির্বিকার! চূড়ান্ত নির্বিকার থেকে বলেছেন—হয় সমাজতন্ত্র, না হয় মৃত্যু।
ফিদেল কাস্ত্রোর আর এক বিখ্যাত উক্তি ‘টুওয়ার্ডস ভিকট্রি, অলওয়েজ!’ এটাই বোধ হয় ক্রিকেটার ইমরানকে বেশি টেনেছে। অক্সফোর্ডপড়ুয়া ইমরান মাঠে জয়ের বিকল্প কখনো কিছু ভেবেছেন, বলা যাবে না। ইমরানের খেলোয়াড়ি জীবনে প্রথম এবং শেষ কথা ছিল জয়। সেখানেও সেই কাস্ত্রোর দর্শন—টুওয়ার্ডস ভিকট্রি অলওয়েজ। কাস্ত্রো যেমন বলেছিলেন, হয় সমাজতন্ত্র না হয় মৃত্যু। বাইশগজে ইমরানের দর্শনও তাই। হয় মারো, না হয় মরো। আবার ক্রিকেট ছেড়ে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়ার পর সমাজতন্ত্রের পথে না হাঁটলেও মার্কিন-বিদ্বেষ নীতিতে কাস্ত্রোর দেখানো পথে হাঁটাতেই বিশ্বাসী মনে হয় ইমরানকে। তাই পাকিস্তান সফরে এসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ লাহোরে ব্যাট হাতে নিয়েছিলেন, পাশে ইনজামাম। আর সেই ছবি দেখে ইমরান খান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ব্যাট হাতে ধরলেই লোকে ভুলে যাবে ওর হাতে রক্তের দাগ!’ পৃথিবীজুড়ে হিংসার রাজনীতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করেন ইমরান। তবে সেটা কতটা বিশ্বাস থেকে আর কতটা ক্ষমতার দৌড়ে টিকে থাকার জন্য, তা সময় নির্ধারণ করবে। তবে ক্রিকেট মাঠ বা রাজনীতির ময়দান সব জায়গায় ইমরানের গলায় একটা বিদ্রোহের সুর বিরাজ করে।
আর ম্যারাডোনা? তিনি চিরকালের এক চরিত্র। কাস্ত্রো যাঁর বন্ধু! অথচ তাঁর জীবন-দর্শনে কাস্ত্রোর প্রভাব আছে, বলা যায় না। শুধু প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানসিকতাটুকু ছাড়া। কাস্ত্রো কিংবা ইমরানের মতো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ তিনি মাড়াননি। জীবনবোধ বলতে যা কিছু সেটা নিজের জীবন থেকে পাওয়া। কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বটা চিরকালীন এক রহস্য ছাড়া আর কী!
তবে সন্দেহের অবকাশ নেই। ফিদেল কাস্ত্রো, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ইমরান খান—এঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের আকাশে উজ্জ্বল তারকা। লড়াইয়ের ময়দানে এরা সত্যিই নেতা। কাস্ত্রোর প্রয়াণে ক্রীড়ামহল নির্বিকার, নির্লিপ্ত থাকবে তাই বা হয় কীভাবে! ক্রীড়ামহলও তাই শোকবিহ্বল। একজন ইমরান খান, একজন ম্যারাডোনার প্রতিক্রিয়া সেটা তো শোকার্ত ক্রীড়ামহলেরই শ্রদ্ধা।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।