বঙ্গবন্ধুর সৃজনী সত্তা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের ইতিহাস অভিন্ন। সংগ্রামমুখর জীবনের পরিধিতে জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এত ব্যস্ততা, বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের সারাংশ লিখেছেন তিনটি গ্রন্থে- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’,‘কারাগারের রোজনামচা’,‘আমার দেখা নয়াচীন’। এগুলোর মধ্যে আমরা পেয়ে থাকি এদেশের বাস্তবতা ও ইতিহাসের ঘটনাবলি। একইসাথে পেয়ে যাই আন্তর্জাতিক উপকরণ। এসব গ্রন্থে উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, নেতৃত্বের গুণাবলি,সাংগঠনিক দক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক ব্যক্তির রূপরেখা। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা নান্দনিক বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনচলার বাঁকে বাঁকে স্বদেশপ্রেমের এক মহাকাব্যিক রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন ছিল সেই সৌন্দর্যবোধের আবিরে রঞ্জিত। তাই তো তিনি হতে পেরেছিলেন রাজনীতির এক অমর কবি। বলা হয়ে থাকে কবির মৃত্যু নেই। কিন্তু বাঙালির জাতির স্রষ্টা এই রাজনীতির কবিকে ঘাতকের হাতে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবসে অনন্য সৃজনীশক্তির অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুসহ সেদিন নিহত সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্বদানের বিভিন্ন পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর সৃষ্টিশীল সত্তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমরা কম-বেশি অবহিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রকাশিত লেখক বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য সৃষ্টি বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা গ্রন্থ থেকেই আমরা তাঁর পঠনের বিষয়গত বৈচিত্র্য- রাষ্ট্র পরিচালনা পর্বে এসে পঠিত বিষয়ের বাস্তবসম্মত প্রয়োগের বহু নজির দৃশ্যমান হতে দেখি। একই সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের ভেতরেও পাঠাভ্যাস ও সাহিত্যপ্রীতি কত গভীর ভাবে প্রোথিত করতে পেরেছিলেন তাও আমরা প্রত্যক্ষ করি। বঙ্গবন্ধু সময় পেলেই বই পড়তেন, তা তাঁর ভাষণ, বক্তৃতা, চিঠিপত্র এবং প্রকাশিত গ্রন্থগুলো থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে সময় পেলে কলমও ধরতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ জীবদ্দশায় দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ অনেক কবির অনেক কবিতা যে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ও হৃদয়ে ছিল তা তাঁর উত্তরকালের নানা রাজনৈতিক ভাষণ-বক্তৃতায়ও স্পষ্ট হয়। বঙ্গবন্ধুর পাঠাভ্যাস ও লেখালেখি অনন্যসাধারণ সৃজনী সত্তা তাঁর ব্যক্তিত্বকে রাজনীতির কবিতে পরিণত করেছিলো বলেই বিশ্বাস করি।
বাঙালির গৌরবের ভিত্তি বঙ্গবন্ধু সব বিচারেই ছিলেন নান্দনিক। ছিলেন গণমানুষের জননেতা। নিরন্তর মানুষের কল্যাণের চিন্তায় থাকতেন নিমগ্ন। তবু চারপাশের সৌন্দর্য অবগাহনে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এমনকি জেলে বসেও তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন তার শৈল্পিক চোখ দিয়ে। শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারের রূপ’ তাঁকেও আকৃষ্ট করেছে। প্রতিদিন তিনি যেসব সৌন্দর্য অনুভব করেছেন তা তাঁর মনের ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যেতো। তার প্রমাণ মেলে তাঁর লেখাগুলোর পাতায় পাতায়। তাঁর নান্দনিকতা পিয়াসী মন প্রতি মুহূর্তের সৌন্দর্যবোধে পুলকিত হতো। রবীন্দ্রনাথের মতে আর্টের কাজই হচ্ছে, বিশ্বের যেটুকু আমাদের মনোহর করে সেইটুকু সযত্নে তার অন্য অংশ থেকে বিচ্ছন্ন করে আমাদের কাছে অবিমিশ্র উজ্জ্বল করে ধরা। সেই বিচারে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন এক বড়মাপের সৃজনী জীবনশিল্পী। তাঁর কলমের ডগায় শিল্পীর আঁচড় টানার মতোই তাঁর নৈমত্তিক নান্দনিক অনুভূতির চমৎকার প্রকাশ ঘটতে দেখি, নান্দনিক বঙ্গবন্ধুর স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্যবোধের আকর্ষণীয় প্রকাশ চোখে পড়ে। সৃজনশীল চিন্তার জগৎ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে পরিব্যাপ্ত ছিল। তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জগৎটি যেমন অনায়াসে বুঝতেন, তেমনি তার প্রকাশও বক্তৃতায় এবং লেখায় সহজভাবে করতে পারতেন। তাঁর রচিত তিনটি বই আমাদের সামনে এর উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুর সৃজনী লেখক সত্তার পূর্ণমাত্রার অনুষঙ্গ তাঁর রচিত বইয়ে ফুটে উঠেছে। যে রচনার শিল্প-সুষমা পাঠকের বোধের চেতনা পরিশীলিত করে। বঙ্গবন্ধু যে প্রচুর শিল্প-সাহিত্যের বই পড়তেন, তা তাঁর ভাষণ, বক্তৃতা, চিঠিপত্র আর গ্রন্থগুলো থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৪ বছর। পাকিস্তানি শাসকদের রুদ্ররোষে ২৪টি মামলায় ১৮ বার জেলে নিক্ষিপ্ত হন শেখ মুজিব। এর মধ্যে এক যুগ কেটেছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। বিস্তর কারাবাস এবং পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিচিত্র অত্যাচারও এই আপসহীন নেতার মনোবল ভাঙতে পারেনি। জেলজীবনকেও তিনি অত্যন্ত সৃষ্টিশীলভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর রচনাসম্ভার মূলত জেলজীবনেরই সৃষ্টি।
হাঙ্গেরির খ্যাতিমান দার্শনিক ও চিন্তাবিদ লুকাচ বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতিই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, রাজনীতি সেই লক্ষ্য সাধনের একটি উপায় মাত্র।’ এই অসাধারণ উক্তির তাৎপর্য পৃথিবীর খুব কম রাষ্ট্রনায়ক উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যেসব রাষ্ট্রনায়ক পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তর ঘটিয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই রাজনীতিবিদের পাশাপাশি সংস্কৃতিমনস্ক, সাহিত্যপ্রেমী, চিন্তাবিদ ও লেখক ছিলেন। পৃথিবীর সব ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রনায়কই মূলত লেখক, দার্শনিক বা চিন্তক; তা না হলে তিনি শুধুই রাজনীতিক মাত্র। ফলে সংস্কৃতিমনস্কতা তাঁদের ব্যক্তিত্ব গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই যে সকল রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, রাষ্ট্রদর্শন ও মানবিকতার আদর্শগত তাত্ত্বিকতায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন, তাঁরা লেখক-বুদ্ধিজীবী ও চিন্তানায়ক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর এই সৃজনী সত্তার ভিত রচিত হয়েছিল কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ছাত্রাবস্থাতেই। বেকার হস্টেলে তাঁর কক্ষটি পরিণত হয়েছিল পূর্ব বাংলা থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের প্রধান কেন্দ্রে। তৎকালীন বেকার হস্টেলের আবাসিক শিক্ষক ও পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান তাঁর স্মৃতিকথায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সহজাত গুণের প্রশংসা করেছেন। কলকাতা জীবনে তিনি অনেক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের অনেকে পরবর্তী সময়ে লেখক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কলকাতা ও ঢাকা কেন্দ্রিক অনেক লেখক-সাংবাদিকের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটে সে সময়েই। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির গভীর অনুরাগী ছিলেন তিনি। বিশ্বসাহিত্য ও ইতিহাস নিবিড়ভাবে অধ্যয়নের পাশাপাশি লেখালেখিতেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা অসামান্য তিনটি স্মৃতিকথায় গণমানুষের মুক্তির কান্ডারির পাশাপাশি একজন গভীর পাঠক ও মননশীল লেখকের উজ্জ্বল পরিচয় ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাঠকালে আমরা দেখতে পাই সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির যৌথ মিথস্ক্রিয়ায় ষাটের দশকে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। এটি সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্বের কারণে। বলশেভিক বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন লিও তলস্তয়ের সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে যেমনটি বলেছিলেন, ‘সত্যিকারের মহৎ শিল্প-সাহিত্যে বিপ্লবের কোনো না কোনো মর্মগত অংশের প্রতিফলন ঘটবেই।’ শিল্প, সাহিত্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুও লেনিনের ধারণাই পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণ বা মুক্তির চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিল্প-সাহিত্য রচিত হতে পারে না। ফলে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রাণ।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে বলেছিলেন,‘শিল্প-সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে এদেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা, সাহিত্য-শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাদের কল্যাণে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে, লেখনীর মাধ্যমে তার মুখোশ খুলে দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন,‘আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম হাতে হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে।...আমি সাহিত্যিক নই, শিল্পী নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও বাকশৈলীর মত সহজাত লেখকও ছিলেন বলে মনে করেন খ্যাতিমান লেখক ও অনুবাদক অধ্যাপক ড. ফকরুল আলম। তিনি বলেছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারে রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পড়লে একজন পাঠক সহজেই তার প্রতিভার পরিচয় পাবেন। রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও বাকশক্তিতে তিনি যেমন নান্দনিক ছিলেন, লেখালেখিতে তাঁর দক্ষতা, গঠনমূলক বর্ণনার জন্য তাঁকে সহজাত লেখক হিসেবেও গণ্য করা যায়।’’ বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থ তিনটি পাঠে অভিন্ন একটি মূল সুর বাজে, আর তা হলো- অন্তরঙ্গতা। তাঁর রচনা কৌশল বা উপস্থাপনার ভঙ্গিটাই এমন যে তিনি যেন বৈঠকখানায় বসে সমবেত লোকজনের সামনে কথা বলছেন। সেই শ্রোতা প্রথমত তিনি নিজে। ওইটুকু আস্থা তাঁর নিজের ওপর ছিল। ফলে এমন কোনো ভাষা বা ঘটনার বিবরণ ছিলো না যা পড়ে জেলখানার কর্মকর্তারা লেখাগুলো বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। আবার অনেকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে যেমন বঙ্গবন্ধুর মতো লোকের একটি সহজ সচ্ছলতার সৃষ্টি হয় তেমনি ভাষা ও বক্তব্যে সততা, নিষ্ঠা ও পরিশীলনের বিষয়টিও চলে আসে। এ সব বিষয়ই গ্রন্থ তিনটিকে মহিমামণ্ডিত করে তুলেছে। ফলে সৃজনশীল মহৎ গ্রন্থের যা কিছু মাহাত্ম্য তার সকল রূপ-রস-গন্ধ এবং আলো-ছায়ার খেলা খুব ভালোভাবেই গ্রন্থ তিনটিতে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে পাঠ তাঁর অনন্য সৃজনী সত্তার সাথে নিবিড় পরিচয় ঘটায় পাঠকের, হয়ে ওঠেন পরম স্বজন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা