চিঠি : বর্ণমালার পালকে মোড়া শব্দ পাখি
‘‘হয়তো আজই ঠিক পেয়ে যাব
একটা লুফে নেওয়ার মতো সুসংবাদ
একটা কিছু অনবদ্য নীল খামে
অনেকদিন পর আজ হয়তো ঠিকই পেয়ে যাব
সেই চিঠিখানি-
সেই পাখির শিস, ফুলের হৃদ্যতা, সেই আঙ্গুলের ছাপ!’’
মহাদেব সাহার ‘একটা কিছু সুসংবাদ চাই’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি এমন! একটা চিঠির জন্য কতটা উতলা হতে পারে মন? চিঠি বোধ হয় পাখিই। বর্ণমালার পালকে মোড়া শব্দ পাখি। যে শব্দের পরতে পরতে লেগে রয় মায়ার মোহ !
০১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘চিঠি লেখা দিবস’। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই দিনটিকে উদযাপন করেন। আকুতি জানান, একটি চিঠি চাই আমার ঠিকানায়। আছেন কেউ, পাঠাবেন? তবু, সব চিঠি কি গন্তব্যে পৌছাঁয়?
চিঠি লেখা খুব সোজা। এই চিঠি লেখাই খুব কঠিন! অন্তরের কতটা গভীর থেকে আসতে হয় একেকটি শব্দ, তা কেবল অন্তরাত্মা জানে। অনাগত শিশুর জন্য পরম স্নেহে মায়ের বোনা উলের মতো বুনতে হয় সেসব শব্দকে। জড়িয়ে নিতে হয় কাশ্মীরি শালের মতো।
একটি চিঠি কেবলই কাগজের ক্যানভাসে কলমের আঁচড় নয়। শুরুর সম্বোধন কিংবা শেষে ‘ইতি’-কথার মাঝখানে উঠে আসে অব্যক্ত কথামালা। যারা বহুকাল ধরে জিভের ডগায় আটকে থেকেও বের হতে পারেনি। চিঠি মানে নিঃসঙ্কোচ আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
মধ্যরাতের কফির কাপে কেউ প্রিয়জনের কাছে চিঠি লিখছে। কারও জন্মদিন এলো বলে, কতদিন ধরে একটি চিঠি দাঁড় করাচ্ছে কেউ ! দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দূর প্রবাস থেকে চিঠি আসবে শুনে ডাকপিয়নের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে বাড়ির বৌঠান। কাঙ্খিত চিঠি পাওয়ার পর আনন্দে ডানা ঝাপটাতে ইচ্ছে করে মুক্ত পাখির মতো। লাল ডাকবাক্সে জমা পড়ে রঙিন খামের উদ্দীপনা ! চিঠি কখনও আনন্দ নিয়ে আসে। কখনও দুঃখ বাড়ায়। কখনও সান্ত্বনা দেয়। কখনও সম্পর্কের ছায়ায় আগলে রাখার আশ্বাস দেয়।
১৮৪৫ সালে বিখ্যাত ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার তার প্রেমিকা জেনিকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘ঘুমাতে যাওয়া ও জেগে ওঠার ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে আমি আত্মহত্যা করছি। যখন তুমি এই চিঠি পাবে, তখন আমি মৃত।’ না, বোদলেয়ার নিজেকে শেষ করেননি। নিঃশেষ হবার আগ মুহূর্তেও তিনি চিঠি লিখতে চেয়েছেন। হয়তো চেয়েছিলেন, চলে যাওয়ার আগে স্মৃতি রেখে যাবেন।
বোদলেয়ার কি জানেন, চিঠি এখন সত্যিই স্মৃতির খামে বন্দি? এখন আর কেউ চিঠি পাঠায় না। রমরমা আধুনিকতার যুগে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, মেইলে প্রয়োজনে কথা হয়। চাইলেই পাওয়া যায় কাছের মানুষদের। এক চিঠির কত বিকল্প ! অথচ কী আশ্চর্য, কোনোটিই পারেনি চিঠিকে মুছে ফেলতে। আজও কেউ কেউ রাত জেগে চিঠি লেখে হারিয়ে যাওয়া কারও বেনামী ঠিকানায়। নয়তো গোটা আকাশটাই পড়ে আছে। আকাশের ঠিকানায় চিঠি পাঠালে শরতের পেঁজা তুলো মেঘ ঠিক ভাসিয়ে নেয়, মিলিয়ে দেয় সাগরের কোলে !
কত চিঠি লেখা হয় বটে, কিন্তু যায় না গন্তব্যে। হয়তো অধিকারটা নেই আর। কিংবা ওপারে অতিথি হয়ে যাওয়া কারও জন্য নিয়ম করে লেখা চিঠি রেখে দেয় বুকপকেটে। বুক পকেটে শূন্যতা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কোনো ক্লান্ত পথিক পথচলার রসদ পায় বন্ধুর দেওয়া চিঠিতে।
আমাদের চিঠি যুগ হারিয়ে গেছে। যেমন করে হারিয়ে গেছে বর্ষার সোঁদা মাটির ঘ্রাণ। যেমন করে হারিয়ে গেছে কড়া রোদে শুকানো আচারের গন্ধ। যেমন করে হারিয়ে গেছে প্রিয়জন। তেমনি করে চিঠিও আজ বিবর্ণ অতীত। চিঠি লেখা প্রসঙ্গে বিখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে দুর্দান্ত এক মন্তব্য করেছিলেন, 'আপনি চিঠি লিখতে পছন্দ করেন না? আমি করি, কারণ চিঠি লিখতে বসলে আমার মনে হয় অন্তত কিছু একটা করতে পারছি আমি।’
নির্বোধ যান্ত্রিকতায় চিঠি লিখুন। নিজেকে একটু উপলব্ধি করান, আপনি অনন্য। পাঠিয়ে দিন আকাশের ঠিকানায়। ঠিক আপনার মতো করেই সে চিঠি লুফে নেবে জাতিস্মর। নতুবা উড়তে থাকুক, একদিন হয়তো পৌঁছে যাবে গন্তব্যে।