এ যেন চিঠি নয়, পুরোটাই ভালোবাসা!
বেশ আগের কথা, রিদিতা তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। সেদিন শ্রেণিকক্ষে লুকিয়ে চিঠি পড়ছিল। এমন সময় দেখে ফেলে তার বন্ধু-বান্ধবেরা। বুঝে ফেলে কার চিঠি। এরপর সবার সেকি হাসি! সেই হাসি দেখে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরী।
শ্রেণিকক্ষের এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত সরে পড়ে হৃদয়। লজ্জা ও ভয় দুটোই কাজ করছিল তার মাঝে। চিঠির পেছনের নায়ক যে সে-ই। শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলেও মনের ভয় দূর হচ্ছিল না—যদি স্কুল শিক্ষকরা জেনে যান! তাহলে নির্ঘাত মার খেতে হবে। আর বাবা-মা জেনে গেলে পড়তে হবে ভীষণ লজ্জায়।
সময় গড়ায়, প্রেম গাঢ় হতে থাকে হৃদয় আর রিদিতার। শ্রেণিকক্ষে দুজন দুজনের দিকে তাকাত, আর লাজরাঙা হাসি দিত। সে সময়ের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে লুকিয়ে-চুকিয়ে হতো তাদের এই চোখাচোখি। কথাও হতো। কিন্তু, সেই সুখ আর বেশি দিন সয়নি। দুই পরিবারে রটে যায় তাদের প্রেমকাহিনি।
দশম শ্রেণির মধ্যভাগ। দুজনের প্রতি কড়া নিষেধাজ্ঞা আসে পরিবার ও স্কুল থেকে। মারধরেও কমতি ছিল না। তারপর আর সামনা-সামনি কথা বলতে পারেনি রিদিতা-হৃদয়। ফলে, নিজেদের মনের কথা আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে ওঠে চিঠি। তবে, তা ডাকপিয়নের মাধ্যমে নয়। চিঠির জন্যও তাদের করতে হয় গোপন পরিকল্পনা। ঠিক করতে হয় নির্দিষ্ট স্থান। সেখানে মাটির বুকে পড়ে থাকত চিঠি। পরে সুবিধামতো সময়ে মাটি থেকে তুলে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ত তারা।
মাধ্যমিক পরীক্ষার আগ পর্যন্ত গণ্ডিবদ্ধ সমাজের চোখ ফাঁকি দিয়ে এভাবে কাটে রিদিতা-হৃদয়ের। এরপর হৃদয় এক কলেজে, রিদিতা ভর্তি হয় অন্যটিতে। ফলে, চিঠির গোপন স্থান দুজনের অভিন্ন সড়কে না হওয়ায় প্রেমের স্রোতে পড়ে বাধা।
এর মধ্যে মুঠোফোনে বাজার সয়লাব। বদলে যেতে থাকে চিঠির যুগ। সেখানে স্থান করে নেয় ম্যাসেজ, কল। এ সময় হৃদয়ের হাতে মুঠোফোন উঠলেও ছিল না রিদিতার। অন্যদিকে, কড়া নজরে রাখা হতো তাকে। অনিয়মিত হয়ে পড়ে তাদের চিঠি আদান-প্রদান।
হৃদয়ের ব্যাকুল মন ভিজে থাকত সব সময়। সুযোগ পেলে কারও কারও মাধ্যমে হতো চিঠি বিনিময়। এক সময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।
হৃদয় যাদের মাধ্যমে চিঠি পেত বা দিত, তাদের কাছে বারবার জানতে চাইত—রিদিতা চিঠি দিয়েছে বা নিয়েছে কিনা? কিন্তু, বাহকের কাছ থেকে না পেত তার চিঠি, না মিলত খোঁজ। মন খারাপ হয়ে যেত হৃদয়ের। বিষন্ন মনের আকুলতা ফুটে উঠত চিঠির পর চিঠিতে। যে চিঠিগুলো পায়নি তার সঠিক ঠিকানা। তবে, হৃদয় অপেক্ষায় থাকত—এই বুঝি চিঠি এলো তার প্রেয়সীর কাছ থেকে।
এভাবে সময় বয়ে যায়। রিদিতার কলেজে আসা-যাওয়াও বন্ধ হয়। হঠাৎ খবর আসে—রিদিতাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। হতভম্ব হয়ে পড়ে হৃদয়। কোনোভাবেই মানতে পারে না সে। কিন্তু, আর কিছুই করার ছিল না তার। রিদিতার কাছ থেকে একটি চিঠি পাওয়ার অপেক্ষা তাকে ভাসিয়ে নেয় দিন থেকে রাতে, রাত থেকে দিনে। কেটে যায় বছরের পর বছর।
এক দশক পর, যখন মুঠোফোন সবার হাতে হাতে, তখন ডাকপিয়নের ডাকে চমকে ওঠে হৃদয়। খাঁকি খামের ওপরে ভাসছে চেনা সেই অক্ষর। লেখা তার নাম।
চিঠি হাতে তখনও দাঁড়িয়ে হৃদয়। ডাকপিয়ন কখন যে চলে গেছে, জানে না সে। আশপাশের সব শব্দও যেন নিরব, পা চলছে না তার। ভালোবাসার স্নায়ু তাকে মোহাচ্ছন্ন করে তোলে। খোলে খাম। বেরিয়ে আসে ২৮ পৃষ্ঠার চিঠি। একের পর এক পাতা উল্টে যায়, আর প্রতিটি পাতাজুড়ে লেখা গল্পগুলো হৃদয়কে নিয়ে যায় সেই ছেলেবেলায়, কৈশরে, তারুণ্যে। হৃদয়ের মনে হতে থাকে—এ যেন চিঠি নয়, পুরোটাই ভালোবাসা!
লেখক : সাংবাদিক